শিক্ষাক্ষেত্রে বিতণ্ডায় বরং লেখাপড়ার প্রসঙ্গ আসুক
Political interference

নতুন করে ভাবা

দুই বিপরীত লক্ষণ যেন একই বৃন্তে দু’টি কুসুম। তবু বিদ্যাচর্চা ও হিংসা-অশান্তির অবিচ্ছেদ্য যোগ মেনে নিতে বাধে। যোগটা ছিন্ন করা যাবে কী করে?

Advertisement

সুকান্ত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৫ ০৭:২৪
Share:
উপলক্ষ: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ। ৫ মার্চ, ২০২৫।

উপলক্ষ: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ। ৫ মার্চ, ২০২৫। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

আমার অধ্যাপক জীবন কেটেছে বাংলার দু’টি অগ্রণী বিদ্যাকেন্দ্রে। তাদের ছাত্রেরা বিশ্ব জুড়ে মেধার স্বাক্ষর রেখেছে। আরও বড় কথা, দু’টিই পাঠ ও গবেষণার সক্রিয় মেধাকেন্দ্র, লাভ করেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। সমান সত্য, উভয় শিক্ষাপ্রাঙ্গণে বিক্ষোভ অশান্তি আলোড়ন নিত্য লেগে আছে। তাতে লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটে, রাজনৈতিক বিতণ্ডায় আবহ তেতে ওঠে, থেকে থেকে হিংসায় ফেটে পড়ে।

Advertisement

দুই বিপরীত লক্ষণ যেন একই বৃন্তে দু’টি কুসুম। তবু বিদ্যাচর্চা ও হিংসা-অশান্তির অবিচ্ছেদ্য যোগ মেনে নিতে বাধে। যোগটা ছিন্ন করা যাবে কী করে?

প্রথমেই বলি কী ভাবে যাবে না। চত্বরে পুলিশ ফাঁড়ি বসানোর মতো অবিমৃশ্যকারিতায় কখনওই নয়। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ছাত্র-শিক্ষকরা তাঁদের বিদ্যায়তনকে এ ভাবে দেগে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হবেন। সেই সঙ্গে মানসিক চাপে ভুগবেন, অস্বস্তি বোধ করবেন শিক্ষাপ্রাঙ্গণে বাইরের নজরদারির এই স্থূল প্রকাশে। আর যারা প্রতিবাদ-আন্দোলনে পারদর্শী, তারা পেয়ে যাবে বিরোধিতার একটা প্রত্যক্ষ ভরকেন্দ্র, সেটাই হয়ে উঠবে অশান্তির উৎস।

Advertisement

আর অবশ্যই সমাধান মিলবে না চিন্তা ও ভাবপ্রকাশে পাহারা বসিয়ে। ভারতে আজ নানা রাজ্যে ছাত্র-শিক্ষকরা মত প্রকাশে, ইচ্ছামতো পঠনপাঠন বা গবেষণায়, অতিথি পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ে চাপে থাকেন, ভয়ে থাকেন, ফলে ভাবনাচিন্তা কৌতূহল ব্যাহত হয়। শেষ অবধি নিষেধগুলো মনে গেঁথে আত্মীকৃত হয়ে যায়, অবাধ জ্ঞানচর্চার তাগিদটাই যায় হারিয়ে। দেশ জুড়ে এই পোষ-মানা বিদ্যার পত্তন চলছে; সাধনায় মোক্ষলাভ ঘটলে ভারত পরিণত হবে তাসের দেশে। অন্তত এইটুকু বৌদ্ধিক বৈশিষ্ট্য বাংলার বজায় থাক।

স্বাধীনতার কিন্তু একটা শর্ত আছে। পরের খবরদারিতে যাদের অতি সঙ্গত আপত্তি, তাদের উপর দায়িত্ব বর্তায় নিজেদের নজরে রাখতে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে: রবীন্দ্রনাথের ভাষায় উত্তেজনার আগুন পোহাবার আগে— আগুন ধরাবার আগে তো বটেই— ভেবে দেখতে তাতে অভীষ্ট ফল মিলবে কি না, অনভিপ্রেত ফলই বা কী হতে পারে।

স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বাংলার ছাত্রসমাজে বিক্ষোভ-আন্দোলনের ধারা চলে আসছে। গুরুতর পরিস্থিতিতে তার দাম আছে, দরকার আছে। যাদবপুরের ‘হোক কলরব’ আন্দোলনে ছাত্র-শিক্ষক প্রায় নির্বিশেষে যোগ দিয়েছিলেন, কারণ সে দিন প্রবল পরিচালন সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। বৃহত্তর সমাজে এমনকি বিদেশেও যথেষ্ট সমর্থন মিলেছিল। একই ছবি দেখা গেল আর জি কর আন্দোলনে।

প্রশ্ন ওঠে যখন বিক্ষোভ-মিছিল-অবরোধের গৎ বাঁধা প্রয়োগ হয় প্রত্যেক তাৎক্ষণিক উপলক্ষে। যাঁর কাছে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে (প্রায়ই উপাচার্য বা অধ্যক্ষ), সমাধান সর্বদা তাঁদের হাতে থাকে না। এ বারও দেখা গেল, যাদবপুরের বিশৃঙ্খলা উপলক্ষ করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি আস্ফালন হানাহানি বিষোদ্গারে মাতল, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বিষয়গুলো ধামাচাপা পড়ল। আন্দোলনকারীরা বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্রগোষ্ঠী। তারা বিচার করতে যথেষ্ট সক্ষম, এই ক্লান্ত জঙ্গিপনা আজ ক্রমহ্রাসমান লাভের বিন্দুতে পৌঁছেছে কি না, বিচার করা দরকার শিক্ষার স্বার্থে, শিক্ষায়তনের স্বার্থে, তাদের নিজেদের স্বার্থে।

একটা অতীব গুরুতর বিষয় কখনও আলোচিত হয় না। আইআইটি বা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো যাদবপুরের কোনও সুনিশ্চিত অর্থবরাদ্দ নেই। রাজ্য সরকার বেতন এবং ন্যূনতম রক্ষণাবেক্ষণের খরচ জোগায়, তাতেও আজ টান পড়ছে। ভবন নির্মাণ, যন্ত্রপাতি পরিকাঠামো, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা আদানপ্রদান ইত্যাদি, সর্বোপরি গবেষণার প্রতিটি পয়সা— সব কিছুই প্রশাসন আর অধ্যাপকমহলের বাড়তি উদ্যোগে ‘উপার্জন’ করতে হয় সরকারি-অসরকারি নানা সূত্র থেকে, আর পাঁচটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়। যাদবপুরে (বা যে কোনও রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে) গবেষণার পরম্পরা এই ভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়, তার সুফল পৌঁছয় সর্বকনিষ্ঠ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্র পর্যন্ত।

যাদবপুরের সারস্বত প্রতিষ্ঠা এই দুর্দিনেও মিলিয়ে যায়নি: তার সাক্ষ্য কেন্দ্রীয় সরকারের বার্ষিক সমীক্ষা ও একাধিক আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন। এই উৎকর্ষের শক্ত ভিত অধ্যাপককুলের একাংশের অব্যাহত গবেষণার ধারায়, আর গবেষণাকর্মীদের অনামী বাহিনীর বিপুল শ্রমে। এই কৃতী তরুণ-তরুণীদের পারিশ্রমিক সামান্য, নিয়োগ অস্থায়ী, এঁদের মেধার পূর্ণ সদ্ব্যবহারে সমাজ ও সরকারের পরম অনীহা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের সিংহভাগ এই নেপথ্য কর্মকাণ্ডের কল্যাণে। অর্থসূত্রের হদিস পাওয়া, আলোচনা বোঝাপড়ার মাধ্যমে তা কার্যকর করা, যন্ত্রপাতি পরিকাঠামো জড়ো করে ধাপে ধাপে যথাসময়ে কাজ শেষ করা কতটা দুষ্কর, যাঁরা জানেন তাঁরাই জানেন।

এক-এক প্রস্ত অশান্তি অবরোধ কর্মবিরতিতে এই উদ্যোগ প্রবল ঘা খায়। আর্থিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া আটকে যায়, অর্থদাতা ও সহযোগী সংস্থার আগমন বন্ধ হয়, উপকারী শুভার্থীরা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। জনমানসে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা অবশ্যই ইতিবাচক নয়। আন্দোলনে নামার আগে সব পক্ষ যেন এ দিকটা এক বার ভাবেন।

সরকারের হেলদোল নেই, কারণ সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারের আগ্রহ প্রতীয়মান নয়। প্রতিবাদের পদ্ধতি যা-ই হোক, ছাত্রদের আজকের দাবি তো অন্যায় নয়। সত্যিই তো, বছরের পর বছর ছাত্র সংগঠনের নির্বাচন হবে না কেন? এটা অপ্রাপ্তির হিমশৈলের চূড়া মাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহী সভাগুলিতে— যেমন কোর্ট, কর্মসমিতি, ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল— শিক্ষক (তথা শিক্ষাকর্মী ও ছাত্রদের) নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই, কারণ অবিশ্বাস্য ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু দিন কোনও বিধি (স্ট্যাটিউট) নেই। এক ভূতপূর্ব রাজ্যপাল শুনে আঁতকে উঠেছিলেন; তাঁর উদ্যোগেও বরফ গলেনি।

প্রচলন ভেঙে ডিন নিয়োগ করছে রাজ্য সরকার, নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষককুল নয়, যদিও শিক্ষকদের সঙ্গে প্রশাসনের আদানপ্রদানে ডিনের মৌলিক ভূমিকা। শিক্ষকপদে বিপুল ঘাটতি, কিছু বিভাগে অর্ধেক পদ খালি। অন্য কোনও সংস্থার সঙ্গে, এমনকি সরকারস্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, গবেষণার চুক্তি করতে সরকারের ছাড়পত্র লাগে; তাতে বছর ঘুরে যায়, কখনও বা প্রস্তাবটাই তামাদি হয়ে যায়। সরকারি কর্তৃত্বের বহর বাড়তে বাড়তে আজ কর্মসমিতির বৈঠক ডাকতে বিকাশ ভবনের অনুমতি লাগে। উপাচার্যদের অস্তিত্বের সঙ্কট: রাজ্য আর রাজ্যপালের বন্ধ্যা বিতণ্ডায় বাংলার অর্ধেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো যাদবপুরেও স্থায়ী উপাচার্য নেই; অতএব নেই নিবন্ধক, অর্থসচিব, অসংখ্য অধ্যাপক। এ বার গোলযোগের পর রাজ্যপাল উপাচার্যদের ডেকে শিক্ষাচত্বরে শান্তি ফেরানোর এলাহি পরিকল্পনা করেছেন। তার জন্য কিন্তু প্রথমেই দরকার স্থায়ী উপাচার্য: রাজ্যপালই সেই নিয়োগ মাসের পর মাস আটকে রাখছেন।

রাজ্যপালের প্রতিপালক কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অস্তিত্ব ভুলতে বসেছে, বিশেষত রাজ্যটি বিরোধী-শাসিত হলে। ইউজিসি-র করুণ হাল, তার তহবিল তলানিতে ঠেকেছে। শিক্ষা মন্ত্রকের সরাসরি অনুদান চরম অনিশ্চিত। ক’বছর আগে অতর্কিতে বিনা ব্যাখ্যায় ১০০ কোটির বরাদ্দ মাঝপথে বন্ধ হওয়ায় যাদবপুরে বহু প্রকল্প থমকে গেছে, কাজ হারিয়েছেন কয়েকশো প্রকল্পকর্মী। ‘ইনস্টিটিউট অব এমিনেন্স’-এর যাত্রাপালায় সম্প্রতি কেন্দ্র ফের তার কার্পণ্যের দায় চাপাল রাজ্যের উপর। বিদ্যায়তনের ‘এমিনেন্স’ স্পষ্টতই বিদ্যাচর্চায় নয়, অর্থবলে: তাই যাদবপুর বা তামিলনাড়ুর আন্না বিশ্ববিদ্যালয় মেধার নিরিখে নির্বাচিত হয়েও ছিটকে যায়, ভিতপুজোর আগেই স্বীকৃতি পায় ধনকুবের-পোষিত জিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়।

দায় তাই কার্যত পুরোপুরি রাজ্যের উপর বর্তাচ্ছে। রাজ্য যতই অর্থক্লিষ্ট হোক, শিক্ষা খাতে, সর্বোপরি শিক্ষক নিয়োগে, বরাদ্দ না করলেই নয়। তাও যদি না জোটে, আরও বেশি দরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে চরে খাওয়ার স্বাধীনতা দেওয়ার: যে পথে এত দিন অর্থ মিলেছে, দেশ-বিদেশে সংযোগ ঘটেছে, ক্যাম্পাসে নানা চর্চাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে, সেই পথগুলি আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা।

চিরাচরিত প্রতিবাদ-বিক্ষোভের বদলে ছাত্র-শিক্ষক সকলেরই নতুন করে ভাবতে হবে, তথ্য দিয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে ঘাটতি আর অনাচার তুলে ধরে, সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন আর প্রস্তাবের চাপ অব্যাহত রেখে, যথার্থ বিদ্যানুরাগীর ভূমিকায় নেমে মন্ত্রী-আমলাদেরও বাধ্য করা লেখাপড়ার দিকে মন দিতে। মিটিং-মিছিল-আলোড়নে কর্তারা নির্বিকার: তাঁরা জানেন, রাজনৈতিক দলগুলি এ বার আসরে নামবে, শিক্ষার মোক্ষম প্রশ্নগুলি থেকে নজর ঘুরে যাবে। সেই প্রশ্ন তুলে চেপে ধরলেই বরং কর্তারা কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে পড়বেন, আজ নয় কাল বাধ্য হবেন অন্তত একটা জবাবদিহি করতে, চাই কি বিহিত করতে। বিক্ষোভ-আন্দোলনে আবদ্ধ থেকে আমরা তাঁদের বড় সহজে রেহাই দিচ্ছি। কৌশলগত কারণেই নাহয় শিক্ষাক্ষেত্রের বিতণ্ডায় লেখাপড়ার প্রসঙ্গ আসুক। আশা থাক, কালে কালে সত্যিই শিক্ষা নিয়ে সবার চৈতন্য আসবে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement