বঙ্গাব্দের সঙ্গে শশাঙ্কর নাম জড়ানোর চেষ্টার ইতিহাসভিত্তি নেই
King Shashanka

বঙ্গাব্দ বিতণ্ডার ইতিবৃত্ত

অব্দ (সংস্কৃত), সাল (ফারসি), সন (আরবি) শব্দগুলি বাংলা শব্দভান্ডারে দোআঁশলা ছাপিয়ে, তেআঁশলা মিশেল, বছরের আনাগোনার দ্যোতক।

Advertisement

রণবীর চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:৫৯
Share:
ইতিহাসপত্র: রাজা শশাঙ্কের প্রথম মেদিনীপুর তাম্রশাসন।

ইতিহাসপত্র: রাজা শশাঙ্কের প্রথম মেদিনীপুর তাম্রশাসন। সৌজন্য: পুরাতাত্ত্বিক রজত সান্যাল।

বঙ্গাব্দ ১৪৩১ ফুরিয়ে এল, নতুন অব্দকে পথ করে দিতে। এ আর নতুন কী কথা। তবে বঙ্গাব্দ নিয়ে গত বছরদশেক ধরে লাগাতার যে সব কথা কানে আসছে, তাতে পেশাদারি ইতিহাসচর্চার নিরিখে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

Advertisement

অব্দ (সংস্কৃত), সাল (ফারসি), সন (আরবি) শব্দগুলি বাংলা শব্দভান্ডারে দোআঁশলা ছাপিয়ে, তেআঁশলা মিশেল, বছরের আনাগোনার দ্যোতক। বর্ষগণনা পত্তন করার সূচনাপর্ব দিয়ে অব্দ, সাল, সন ইত্যাদি চিহ্নিত হয়, তার সঙ্গে যিনি এই বিশিষ্ট কালগোনা শুরু করলেন, তাঁরও একটি সংশ্লেষ ঘটে যায়। সেই ব্যক্তি প্রায়ই ক্ষমতা-ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত থাকেন। খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে খ্রিস্টের অবিচ্ছেদ্য যে যোগ, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে জুলীয় বর্ষগণনারীতি, যার সূচনা ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ১৫৮২-তে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি-র উদ্যোগে গ্রেগরীয় পদ্ধতিতে খ্রিস্টাব্দ-বর্ষ হিসেবের সংস্কার হল। ইউরোপের ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের সঙ্গে ক্রমে তার বিশ্বজোড়া দাপট হল।

পয়গম্বর মহম্মদ যখন মক্কা থেকে মদিনায় চলে এলেন, তাঁর পবিত্র স্মারক হিসেবে খলিফা উমর (৬৩৪-৪৪ খ্রিস্টাব্দ) যে ইসলামি হিজরি গণনার প্রবর্তন করলেন, তার ধারাবাহিক প্রয়োগ চলেছে ৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে। অনুরূপ নজির ভারতে বহুপ্রচলিত বিক্রমাব্দ, তার শুরু ইন্দো-পার্থীয় রাজা প্রথম আজেস-র হাতে ৫৭ খ্রি পূ-তে; পরে এই অব্দ বিক্রমাদিত্যের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল। শকাব্দের প্রতিষ্ঠার (৭৮ খ্রিস্টাব্দ) সঙ্গেও উপমহাদেশে শক/কুষান শাসনের পরিচয় বিধৃত। আর এক সুপরিচিত অব্দ গুপ্তাব্দ-র আরম্ভ ৩১৯-২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে, প্রথম স্বাধীন গুপ্ত রাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসন লাভের স্মারক হিসেবে। অব্দ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে রাজনীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক ।

Advertisement

এখন, বঙ্গাব্দ প্রচলন ঘটানোর কৃতিত্ব কার, তা বলার আগে বঙ্গাব্দের সূচনা কবে, তা ঠিক করা দরকার। বঙ্গাব্দ তার নতুন শতকে, অর্থাৎ পঞ্চদশ শতাব্দীতে যখন পা রাখল, ইংরেজি নতুন শতকের (একবিংশ) এবং নয়া (তৃতীয়) সহস্রকের দেখা পেতে আরও কয়েক বছর সবুর করতে হবে। বাংলা সন ১৪০০-র আরম্ভ ইংরেজি ১৪ এপ্রিল, ১৯৯৩; আর তা শেষ হল ১৯৯৪-এর ১৪ এপ্রিল। সুতরাং, বঙ্গাব্দের সূচনা ৫৯৩-৯৪ খ্রি থেকে (১৯৯৩-৯৪ থেকে ১৪০০ বাদ দিতে হবে)।

গত এক দশক যাবৎ পয়লা বৈশাখের প্রাক্কালে শোনা যাচ্ছে এই অব্দটির প্রবর্তনের কৃতিত্ব বাংলার শক্তিশালী শাসক শশাঙ্কেরই প্রাপ্য। এই দাবি মানার সমস্যা অনেক। প্রথম সমস্যা হল, ৫৯৩-৯৪ থেকে পরবর্তী হাজার বছর ধরে এমন কোনও নথিবদ্ধ দলিল নেই, যার দ্বারা বর্ষ-সংক্রান্ত সংখ্যাটিকে বঙ্গাব্দের সঙ্গে নিশ্চিত ভাবে, নির্দ্বিধায় শনাক্ত করা যায়। অতএব, বঙ্গাব্দের প্রয়োগ যে ১৫৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দের আগে ঘটেছিল, তার প্রমাণ নেই। রাজনীতির হিসেবে বাংলায় তখন মোগল অধিকার কায়েম হয়েছে (১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দ), আকবরের দৌলতে। আবুল ফজলের প্রখ্যাত আইন-ই-আকবরি অনুসারে আকবর নতুন অব্দ এবং নতুন মাস-গণনা পদ্ধতি প্রবর্তনে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন, কারণ ইসলামি চান্দ্রমাসভিত্তিক হিজরি সনে ছিল তাঁর গভীর অনীহা। সুতরাং বাদশাহের শাসনের ঊনত্রিশতম দৈববর্ষে (১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দ) চান্দ্রবর্ষ-গণনাকে রদ করে দিয়ে, নতুন সৌরবর্ষ-নির্ভর অব্দ চালু হল— ইলাহি সন। বাদশাহের মসনদে আসীন হওয়ার তারিখ চান্দ্রবর্ষ হিজরি অনুসারে ৯৬৩ বা খ্রিস্টাব্দে ২১ মার্চ, ১৫৫৬। সেই সুবাদে ১৫৮৫ সালে জারি করা নতুন সৌরবর্ষ গণনারীতিকে (অর্থাৎ ইলাহি অব্দকে) ১৫৫৬ সালে আকবরের রাজত্ব-সূচনার সঙ্গে মেলানো হল। ১৫৫৬ থেকে চান্দ্র-হিজরি সন ৯৬৩-কে বিয়োগ যদি করেন, তা হলে বিয়োগফল দাঁড়ায় ৫৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দ। ইলাহি অব্দের শুরু হল ২১ মার্চ, ১৫৮৪ থেকে।

এই তারিখটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। ওই দিনটি মহাবিষুব দিবস, অর্থাৎ দিন এবং রাত্রির কালগত দৈর্ঘ্য সমান-সমান। এর পরের ধাপ ছিল সৌরবর্ষ পদ্ধতির সঙ্গে ফসলি সনকে জুড়ে দেওয়া, যে-হেতু মহাবিষুব দিবস নাগাদ প্রধান শস্য খেত থেকে ঘরে উঠতে থাকে। ফসলি সন প্রবর্তন করার সঙ্গে ভূমিরাজস্ব সংগ্রহ করার তাগিদ তো দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। তা হলে বঙ্গাব্দ প্রচলনের মূলে আছে সৌরবর্ষ ইলাহি অব্দ এবং ফসলি সনের যুগপৎ ব্যবহার, যার প্রাচীনতম নজির মেলে আকবর বাদশাহের শাসনকালেই, কোনও ভাবেই এই ব্যবস্থার কোনও পূর্বসূরি নির্দেশ করা যাবে না। আকবরের চান্দ্র-হিজরি অব্দটির সংস্কারসাধনই বঙ্গাব্দের সূচনাকে শনাক্ত করার প্রকৃত চাবিকাঠি ।

উদাহরণ দেওয়া যাক। বিষ্ণুপুরের একটি মন্দির-লেখতে দুইটি কালগণনা-পদ্ধতির যুগ্ম প্রয়োগ লক্ষণীয়। শকাব্দ ১৬০৮, যা ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দর সমার্থক। সঙ্গে আছে সন ১০৯৩, সেটি বঙ্গাব্দ অনুযায়ী। ১৬৮৬ থেকে ১০৯৩ বাদ গেলে থাকে সেই ৫৯৩ খ্রি। এই সন তথা বঙ্গাব্দের অন্য অভিধা, যবন নৃপতে শকাব্দ, যেটি সুপরিচিত শকাব্দ থেকে আলাদা। তাই নারদীয় পুরাণের একটি পুঁথির তারিখ শক ১৭২৩ আর যবন নৃপতির শকাব্দ ১২৩৮ একই খ্রিস্টাব্দে, ১৮০১-০২, মিলে যায়। “আকবরের রাজত্বের পূর্বে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ ব্যবহারের নিশ্চিত প্রমাণ নেই”—ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের এই অভিমতের মান্যতা অনস্বীকার্য ।

এ বার আসি শশাঙ্ক প্রসঙ্গে (৬০০ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ তো বটেই; হয়তো ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দ অবধিও তাঁর রাজত্বকাল)। তিনি কনৌজের হর্ষবর্ধনের (৬০৬-৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ) ও কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার (৬০০-৫০ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক এবং প্রবল শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। বঙ্গাব্দের সূচনাকাল ৫৯৩-৯৪ সালে শশাঙ্ক বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করতে পারেন না; যে-হেতু স্বাধীন রাজা হিসেবে তিনি দেখা দেবেন ৬০০ খ্রিস্টাব্দের পর। স্বাধীন শাসক না হলে নতুন অব্দ জারি করার সুযোগ এবং বৈধতাও থাকে না। তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকার প্রথম প্রকাশ, রটাসগড়ে (বিহারের সাসারাম) পাওয়া একটি সিলমোহরের ছাঁচ অনুসারে মহাসামন্ত (অধীনস্থ শাসক) হিসাবে। সূর্যসিদ্ধান্ত-র ভিত্তিতে শশাঙ্ককে বঙ্গাব্দ চালু করার কৃতিত্ব দিতে যাঁরা উৎসাহী, তাঁদের জানা দরকার ওই উপাত্তটির কালনির্ণয় নিয়ে সমস্যা আছে। কারও মতে উক্ত গ্রন্থ পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত; বিকল্প রচনাকাল হল অষ্টম শতক। দুই সম্ভাব্য রচনাকালের কোনটি শশাঙ্কের শাসনকালের ধারে-কাছে আসে?

তাঁর রাজত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর স্বনামে জারি করা ভূমিদানের দলিল। পাঁচটি তাম্রপট্ট মেলে, যার মধ্যে তিনটি বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে পাওয়া। তার দু’টিতে প্রশাসনিক এলাকা দণ্ডভুক্তি, অর্থাৎ অধুনা দাঁতন ও সন্নিহিত অঞ্চল, তার চৌহদ্দি ওড়িশার উত্তর ভাগ অবধি বিস্তৃত। তৃতীয় তাম্রশাসনটি পশ্চিম মেদিনীপুরের এগরার নিকটস্থ পাঁচরোল থেকে আবিষ্কৃত। শেষ দলিলটি তারিখবিহীন। অন্য দুই দলিলে তাঁর কেবলমাত্র রাজ্যবর্ষ ৮, আর একটি প্রত্নলেখতে ১৯ রাজ্যাঙ্কের উল্লেখ আছে; সম্বত শব্দটি-ই নেই। চতুর্থ তাম্রলেখ এসেছে ওড়িশার গঞ্জাম থেকে। সেই এলাকায় শশাঙ্কের অধীনস্থ শাসক দ্বিতীয় মাধবরাজ তাম্রশাসনের কাল নির্দেশ করে দিলেন ৩০০ গুপ্তাব্দ = ৬১৯-২০ খ্রি। কিমাশ্চর্যম্! মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক চারখানি নিজের জারি করা একটি দলিলেও বঙ্গাব্দ দূরে থাক, কোনও অব্দ-ই ব্যবহার করলেন না! বঙ্গাব্দ চালু করার কৃতিত্ব যে রাজার উপর চাপানো হচ্ছে, সেই অতি পরাক্রান্ত শাসক নিজেই বঙ্গাব্দ ব্যবহারে বিরত। শশাঙ্ক নিজের জোরেই ইতিহাসে পাকা জায়গা করে নিয়েছেন, বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতার বাড়তি তকমা লাগানো এক মহা গোলমেলে কারবার।

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধাগোবিন্দ বসাক, রমেশচন্দ্র মজুমদার, দীনেশ্চন্দ্র সরকার, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, আব্দুল মমিন চৌধুরী প্রমুখ বঙ্গাব্দ-বিষয়ক যে কৃতিত্বের সঙ্গে শশাঙ্কের নাম কদাচ জুড়লেন না, সেই দাবি যে সব মহামহোপাধ্যায় জোর গলায় তুলছেন, তাঁদের বুকের পাটা আছে, তা বলতেই হবে। শশাঙ্ক-কে বঙ্গাব্দস্রষ্টা বলে প্রচার করা শুধু ভ্রান্ত নয়, অতি বিপজ্জনক।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের চারমূর্তির টেনিদা প্রায়ই বলত, ‘চালাকি ন চলিষ্যতি’। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘অতি-ইচ্ছার সঙ্কট’ নিয়ে। তবে আগে তো আমাদের বুঝতে হবে কোনটা চালাকি, কোনটাই বা অতি-ইচ্ছা, কেন তা বিপজ্জনক। তার পর তো তা রোধ করার চেষ্টা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement