চাই প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন
COVID-19

স্বাভাবিক সময়ে যা কাজ করে, ঝঞ্ঝার মুখে তা হয়তো বিকল

লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থা ফের মাথা তুলেছে।

Advertisement

সব্যসাচী কর

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২১ ০৫:১৩
Share:

লকডাউন ফিরে এসেছে। এ বার অবশ্য গত বছরের মতো দেশজোড়া নয়— এ বার তা বিকেন্দ্রীভূত, রাজ্য সরকারগুলি নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে লকডাউন নিয়ে। কিন্তু ভারতে কোভিড-অতিমারির দ্বিতীয় তরঙ্গ এ বার এতই ভয়ঙ্কর যে, কার্যত সব রাজ্যই গত বছরের পথে হেঁটেছে।

Advertisement

লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থা ফের মাথা তুলেছে। ছবিটা হয়তো গত বছরের মতো করুণ, নগ্ন নয়, কিন্তু এ বারের দুর্দশা আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা, কারণ গত দফার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এখন জানি যে, আগে থেকে সব খুলে দিলে তা তৃতীয় তরঙ্গের দিকে এগিয়ে যাওয়া হবে। সেই কারণেই ২০২০-র অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়াটা জরুরি, সেই মতো উপযুক্ত পদক্ষেপ করাটাও দরকার, যাতে ভবিষ্যতে এ রকম দুর্দশায় পড়লে আমাদের পরিযায়ী শ্রমিকরা যথাযথ সাহায্য হাতে পান।

২০২০ সালে পরিযায়ী শ্রমিক সঙ্কট সংক্রান্ত অধিকাংশ বিশ্লেষণই মূলত লকডাউন বিষয়ক নীতির দিকে আঙুল তুলেছে, নীতির ব্যর্থতা কী করে এই সঙ্কট ডেকে এনেছে তা দেখিয়েছে। এই সব সমালোচনা কাজের ঠিকই, তবে একটা গোড়ার ব্যাপার এ সব বিশ্লেষণে অনুপস্থিত। তা হল, এই নীতি-ব্যর্থতার উৎস আসলে ভারতের শ্রমবাজারের প্রতিষ্ঠানগুলির গভীর দুর্বলতার মধ্যে নিহিত। এই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাগুলি শনাক্ত করে সেগুলোর সংশোধনে মন না দিলে, পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্য করা কেবল কঠিনই নয়, অসম্ভবও হয়ে দাঁড়াবে।

Advertisement

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বলতে আমরা কী বুঝি, তাদের দুর্বলতা শুধরানো কেনই বা এত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আগে বোঝা দরকার। সোজা কথায় বললে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি হল সেই সব কলকব্জা ও নাটবল্টু, যা নিশ্চিত করে যে, সার্বিক ভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বিশেষত জননীতিগুলি ঠিকঠাক কাজ করবে। কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করে অর্থনীতির বৃহত্তর পরিসরে (যেমন আইনি পরিকাঠামো, তা সম্পত্তির অধিকার বা চুক্তিগত বোঝাপড়া ইত্যাদি নিশ্চিত করে); অন্য প্রতিষ্ঠানগুলি কাজ করে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে (যেমন ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপ্সি কোড বা আইবিসি, অর্থব্যবস্থার মসৃণ কার্যকারিতা নিশ্চিত করে)। এই প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্বল হলে তার জেরে প্রণীত নীতিগুলির পক্ষে তাদের লক্ষ্যপূরণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিষ্ঠান সহায়ক না হলে শ্রেষ্ঠ নীতিও ব্যর্থ হতে পারে।

২০২০ সালে তা হলে কোন শ্রমবাজার প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয়েছিল? এ ক্ষেত্রে আগে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তফাত বোঝা দরকার। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি সরকার ও বেসরকারি অস্তিত্বগুলির মধ্যে সম্পর্ক কী হবে, তা ঠিক করে দেয়। বেসরকারি অস্তিত্ব মানে এখানে ব্যক্তি, বেসরকারি সংস্থা ইত্যাদি। অন্য দিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি বেসরকারি ক্ষেত্রে, যেমন সংস্থা ও ব্যক্তির মধ্যে, কিংবা দু’টি সংস্থার মধ্যে যোগাযোগ ও কর্মকাণ্ড চালু রাখে। ভারতে গত তিন দশকে যে বাজারমুখী সংস্কারগুলি হয়েছে, তাতে দু’টি নির্দিষ্ট ধরনের শ্রমবাজার সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে— প্রথমটি বেসরকারি; এবং দ্বিতীয়টি সরকারি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি হল তৃতীয় পক্ষ মারফত চুক্তিভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, সেখানে শ্রমের বাজারের নিয়ন্ত্রক হল বেসরকারি ঠিকাদারেরা। এই ব্যবস্থায় বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের কাজে শ্রমিকদের ভাড়া করার ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের উপর নির্ভরশীল। এই শ্রমিকরা সংস্থার বেতনভুক নন, তাঁদের মজুরি দেয় ঠিকাদার, যে কিনা নিজে পয়সা পায় সংস্থার কাছ থেকে। এই ব্যবস্থায় সংস্থাগুলোর খরচ বাঁচে, কারণ চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা দিতে হয় না, মজুরিও নিয়মিত শ্রমিকদের তুলনায় কম। সংস্থার হাতে শ্রমিক নিয়োগ ও ছাঁটাইয়ের ক্ষমতাও অনেক বেশি। এই তৃতীয় পক্ষ-নিয়ন্ত্রিত শ্রমবাজার নামক প্রতিষ্ঠানটির সূচনায় ভারতে শ্রম সম্পর্কই পাল্টে গেল— এক নতুন গোত্রের কর্মসংস্থান হল বিপুল সংখ্যায়।

দ্বিতীয় প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনটি ঘটল নির্মাণক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধি না ঘটায়। তার ফলে, দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কর্মক্ষম শ্রমশক্তির বৃদ্ধির হারের সঙ্গে তাল মেলাতে পারল না। বেকারদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করার চাপ তৈরি হল নীতিনির্ধারকদের উপর। তার ফলে তৈরি হল একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, যার একমাত্র কাজ বাজার অর্থনীতিতে কর্মহীনতার সমস্যার মোকাবিলা করা। এটিই গ্রামীণ অঞ্চলে কর্মসংস্থান প্রকল্প, যা এখন ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট (এনআরইজিএ) নামে পরিচিত।

২০২০-র পরিযায়ী শ্রমিক সঙ্কট আসলে অতিমারির সম্মুখে এই সব প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার সঙ্কেত দেয়। লকডাউন হওয়ামাত্র বহু ঠিকাদার ‘নিখোঁজ’, এমন ঘটনাও ঘটেছে। তার মানে, কাজ ধরে রাখার কোনও উপায়ই সেই শ্রমিকদের ছিল না। অন্য দিকে, লকডাউনে শ্রমিকদের কাজ ধরে রাখতে ইচ্ছুক সংস্থাগুলোও শেষে তা পারেনি, কারণ শ্রমিকদের টাকা দেবে যে, সেই ঠিকাদারই তো নিখোঁজ। এই প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্কটের মূল কারণ ঠিকাদারদের জন্য কোনও প্রণোদনা না থাকা, যা থাকলে তারা লকডাউনের অনিশ্চয়তার মধ্যেও কাজ চালিয়ে যেত। প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্তের এহেন সীমাবদ্ধতা অতিমারিতে প্রকট হয়ে উঠেছে। এই সমস্যা আরও জটিল হয়েছে, আমাদের দেশের সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা, বিশেষত এনআরইজিএ, শহরাঞ্চলের সঙ্কটের কথা ভেবে তৈরিই হয়নি। এমন কোনও ব্যবস্থা ছিল না যার মাধ্যমে শহরাঞ্চলে যাঁরা কাজ হারিয়েছেন তাঁদের কাছে রোজগারের টাকা পৌঁছনো যায়। এই অবস্থায় লক্ষ লক্ষ মানুষ যে শহরে আটকে না থেকে, নিজেদের স্বাস্থ্য ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামে ফিরতে চাইবেন, এতে আশ্চর্য কী।

এ থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি? এটাই যে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ্য যা, সঙ্কটের সময় তা না-ও থাকতে পারে। সুতরাং প্রতিষ্ঠানগুলিকে সঙ্কটের কথা, সঙ্কটকালে সমাধানের কথা মাথায় রেখে কর্মপদ্ধতির রূপরেখা তৈরি করতে হবে। শ্রমবাজারের থেকেই একটা উদাহরণ দিই। নতুন ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড’-এ নির্দিষ্ট মেয়াদের চুক্তির চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। তার ফলে নিয়োগকারী সংস্থার হাতে শ্রমিক নিয়োগ ও ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নমনীয়তা থাকছে। এর ফলে ঠিকাদার-প্রথা তুলে দেওয়া যেতে পারে। তাতে সুবিধা হল, ভবিষ্যতে কোনও সঙ্কটে শ্রমিকদের রোজগারের টাকা বা আর্থিক সহায়তা পৌঁছনো সরাসরি সংস্থার মাধ্যমেই করা যায়।

সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষার প্রশ্নে বলতে হয়, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সঙ্কটকালে কেউ তাঁর কর্মক্ষেত্রে থেকে যাবেন না কি গ্রামে বা অন্যত্র নিজের বাড়িতে ফিরবেন, সে সিদ্ধান্ত ব্যক্তির এবং তাঁর বাড়ির লোকেদের। তবে তাঁরা যেখানেই থাকুন না কেন, সুরক্ষা ও সহায়তা যদি সেখানেই পৌঁছনো যায়, তা হলে গত বছর শ্রমিকদের হেঁটে-ফেরার যে দৃশ্য আমরা দেখেছি, অন্তত তার পুনরাবৃত্তি হবে না। দেশের যে কোনও প্রান্তে একই রেশন কার্ডের মাধ্যমে গণবণ্টনের সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থাটি এ ক্ষেত্রে একটা ঠিক পদক্ষেপ। আমরা দেখেছি, লকডাউনে শুধু খাওয়ার খরচই নয়, অন্যান্য ব্যয়ও কেমন বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। হাতে নগদ টাকাই এই সমস্যার অন্তত কিছুটা সমাধান করতে পারে। মোট কথা হল এই, আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কেবল স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই সুদক্ষ হলে চলবে না। সঙ্কটেও তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি, দিল্লি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement