অবিশ্বাস্য মনে হলেও, আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে দিল্লি থেকে সর্বভারতীয় খবরের সরাসরি সম্প্রচার হত বাংলায়। রাজনৈতিক চালচিত্রে রোমহর্ষক সব পরিবর্তনের প্রথম ঝলক, সে জরুরি অবস্থাই হোক, বা ইন্দিরা গান্ধীর দিল্লির পুনর্দখল, সবই লোকে শুনত নিজের মাতৃভাষায়। শুনত, কারণ, তখনও আকাশবাণীর জমানা, ঘরে-ঘরে টিভি ঢোকেনি। এই অবস্থাটা প্রথম বদলাল ১৯৮২ সালে, যখন দূরদর্শনে দিল্লি থেকে শুরু হল সরাসরি রঙিন সম্প্রচার। সে বছরই ভারতে এশিয়াড হল। নয়াদিল্লি পুরো ভোল বদলে ফেলল, আর ভারতবাসীও সরাসরি চলন্ত ছবি দেখতে শিখে গেল। সে বার হকিতে ভারতীয় দল সাত গোল খেল পাকিস্তানের কাছে। পরের বছরই ক্রিকেটে হল বিশ্বজয়। দুটোই গণস্মৃতিতে এখনও অক্ষয়। আরও এক বছর পরে, হামলোগ গোটা দেশে সুপারহিট হল। ভারতে এককেন্দ্রিক ভাষা এবং বিনোদন-ব্যবস্থার সূত্রপাত হল।
পশ্চিমবঙ্গে তখন প্রবল পরাক্রমী বাম সরকার। তাদের ‘মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’ স্লোগানের মধ্যেই, রসিকতার মতো, ক্রমশ প্রাইম-টাইম দখল করে পর পর আসতে লাগল বুনিয়াদ, নুক্কড়, সার্কাস-এর মতো হিন্দি সিরিয়াল। স্থানীয় ভাষায় সম্প্রচারের সময় রইল কেবল সন্ধেটুকু। বিনোদন-ক্ষুধার্ত কিশোর-কিশোরীরা ভালবেসে ঝপাঝপ শিখে নিল হিন্দি। সর্বভারতীয় সংবাদ শুরু হল হিন্দি এবং ইংরেজিতে। তার চেয়েও যেটা গুরুত্বপূর্ণ, এই প্রথম রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের ভাষা ও আঞ্চলিক ভাষার বিভাজন তৈরি করা হল সরকারি ভাবে। দূরদর্শনে রবিবারের সন্ধেটুকু দখল করল হিন্দি সিনেমা। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্য ভাষার সিনেমাও দেখানো শুরু হল, দুপুরে। বলা হল, ‘আঞ্চলিক ভাষার সিনেমা’।
পুরোটাই হল যেন অলক্ষ্যে। অথচ রাজ্যে তখন সর্বস্তরে বাংলাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠছে মুহুর্মুহু। প্রাথমিক থেকে তুলে দেওয়া হল ইংরেজি। কিন্তু তার মধ্যেই বাংলাভাষী আকাশবাণীর যুগ শেষ হয়ে দ্বিভাষিক দূরদর্শন-যুগ শুরু হয়ে গেল, শিশির-পতনের মতো নিশ্চুপে।
১৯৮৪ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এলেন রাজীব গান্ধী। ১৯৮৬ সালে তৈরি হল নতুন রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি। প্রতি জেলায় একটা করে নবোদয় বিদ্যালয় তৈরির কথা ঘোষণা করা হল। একই রকম নিশ্চুপ দ্রুততায় কেন্দ্রীয় বোর্ডের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর দাপটেরও সূচনা হল শহরে, শহরতলিতে। শুরুতে শিক্ষা ছিল সংবিধানের রাজ্য তালিকায়। জরুরি অবস্থার সময় তাকে নিয়ে আসা হয় যৌথ তালিকায়। তাকে আবার রাজ্যের অধিকারে ফেরত নিয়ে যাওয়ার কথা আর উচ্চারিতই হল না কখনও, এমনকি অ-কংগ্রেসি কেন্দ্রীয় সরকারের জমানাতেও।
১৯৮৯ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ। এক দিক থেকে বিজেপি, এবং অন্য দিক থেকে বাম দলগুলি সমর্থন জোগানোর কথা ঘোষণা করল। ভারতীয় দূরদর্শনের ইতিহাসে প্রথম বার তা সরাসরি দেখা গেল দিল্লির স্টুডিয়ো থেকে, হিন্দি এবং ইংরেজিতে। দেশ হাঁ করে দেখল সেই দৃশ্য— চূড়ান্ত ভাবে স্থির হয়ে গেল, শুধু বিনোদন নয়, সর্বভারতীয় রাজনীতির ভাষাও ওই দুটোই। বাংলা বা অন্যরা নেহাতই আঞ্চলিক। পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ ইতিহাসেও প্রথম বার, দূরদর্শনের কল্যাণে তৈরি হল এক দ্বিভাষিক তরুণ প্রজন্ম, যারা গড়গড়িয়ে হিন্দি বলতে, বা অন্তত বুঝতে পারে। সত্তরের জাতকরা, যারা শিশুবয়স কাটিয়েছে নুক্কড় কিংবা আরও পরে রামায়ণ দেখে, তারা এমনিই শিখে ফেলল উত্তর ভারতের এই ভাষাটাকে— ভাষাশিক্ষায় সত্যিই তো খুব বেশি দিন সময় লাগে না। গণ অবচেতনে তৈরি হল এমন এক বোধ যে, সর্বভারতীয় মানেই হিন্দি বা ইংরেজি, বাকি সব আঞ্চলিক। এই বোধকে কাজে লাগানোর জন্য তৈরিই ছিল কেন্দ্রীয় বোর্ড। হইহই করে চলতে শুরু করল তাদের স্কুলগুলো, যার মূল ফোকাসই ছিল হিন্দি এবং ইংরেজিতে। একই সঙ্গে তারা লক্ষ্য করেছিল মধ্যবিত্তের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে। উল্টো দিকে বাম সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল গরিব মানুষ— ইংরেজির চাপে একটি ছাত্রও যেন স্কুলছুট না হয়। অথচ, চাকরি বা শিক্ষা, কিছুতেই স্থানীয় ভাষাকে বাধ্যতামূলক করা হল না। ফলে শহুরে মধ্যবিত্ত একটু-একটু করে মুখ ঘুরিয়ে নিতে শুরু করল রাজ্য বোর্ড তথা বাংলা মাধ্যম থেকে।
ব্যাপারটা এত স্পষ্ট করে তখন অবশ্য বোঝাই যায়নি, কারণ আপাতদৃষ্টিতে বাংলা সংস্কৃতির তখন এক উত্থানের সময়। ১৯৯২ সালে তোমাকে চাই নিয়ে উপস্থিত হলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়। শুরু হয়ে গেল নব্বইয়ের দশক, যখন বাংলা গানের চালচিত্র দেখে মনে হচ্ছিল, বিপ্লব আসন্ন। জীবনমুখী বা ব্যান্ড, নানা তকমায়, বা তকমাহীন ভাবে বাংলা গান তখন আকাশ ছোঁয়ার লক্ষ্যে উড়ছে। এমনকি যে বাংলা সিনেমা আশির দশকে এক রকম দেহ রেখেছিল, নব্বইয়ের মাঝামাঝি থেকে তাতেও ফিরতে শুরু করে দিল মধ্যবিত্ত দর্শক। কিন্তু ফিরে তাকালে বোঝা যায়, এই উত্থান ছিল কেবল উপরিতলে, কারণ ওই একই সময়ে চলছিল আরও এক বিপুল পরিবর্তন, যার পোশাকি নাম উদারীকরণ। প্রবল বিক্ষোভের মধ্যেই তার চাকা ঘুরছিল। বন্ধ হচ্ছিল সরকারি চাকরির দরজা, উঠে আসছিল নতুন নতুন পেশা। নব্বইয়ের শেষেই বস্তুত ভারতে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব হয়ে গেল— ‘ওয়াই-টু কে’ নামের অদ্ভুত এক বস্তুর সূত্র ধরে, যার নাম পশ্চিমবঙ্গ তো দূরস্থান, গোটা দুনিয়ায় এর আগে কেউ কখনও শোনেনি। সম্পূর্ণ বদলে গেল, চাকরির জগতের চালচিত্র। খাস কলকাতার উপকণ্ঠেই, আশির দশকে তথ্যপ্রযুক্তির কেন্দ্র ছিল প্রায় শান্তিনিকেতনীয় পরিবেশে টিমটিমে কয়েকটা বাড়ি। নব্বইয়ের শেষে এসেই তা হয়ে গেল জমজমাট বহুতলের সারি, হাজার-হাজার তরুণ-তরুণীর কর্মক্ষেত্র। পাল্লা দিয়ে চালু হল আরও বহু বেসরকারি ক্ষেত্র। বন্ধ হতে শুরু করল পুরনো সিনেমাহল, তৈরি হতে শুরু করল মল, মাল্টিপ্লেক্স। মধ্যবিত্তের উচ্চাকাঙ্ক্ষা শক্তপোক্ত আকার পেল।
এই বহু স্তরে বিস্তৃত ঝাঁ-চকচকে শিল্পক্ষেত্রে, সমস্ত বিভিন্নতা সত্ত্বেও একটা জিনিস ছিল ধ্রুব— এখানে বাংলা ভাষার জায়গা ছিল নীচে। তার কিছুটা বিদেশি খদ্দেরদের চাহিদার কারণে। খানিকটা ঔপনিবেশিক মানসিকতা। কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল দীর্ঘ দিন ধরে সযত্ননির্মিত গণ অবচেতন যে, ‘উন্নততর’ মানেই হিন্দি বা ইংরেজি। এর উল্টো দিকে কখনও কোনও আওয়াজ ওঠেনি, কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা করা হয়নি। সরকারি কাজ চালু হয়নি বাংলায়। শিক্ষায় বা সরকারি পরীক্ষায়, স্থানীয় ভাষা বাধ্যতামূলক করার কথা ভাবা হয়নি। সরকারি চাকরিতে, যদিও তা ক্রমশ কমে আসছিল, বাংলা ছিল নেহাতই ঐচ্ছিক। ফলে, মতাদর্শগত ভাবে এ ভাষা তো আঞ্চলিক হয়েই ছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হল ‘বাংলা কোনও কাজের ভাষা নয়’ এই বোধ। স্থানীয় পরিষেবা ক্ষেত্রেও যাঁরা স্মার্ট হতে চান, তাঁরা পারলে ইংরেজি, না পারলে হিন্দি বলতে শুরু করলেন— অনেক ক্ষেত্রে অকারণেই। অন্য ভাষা হয়ে উঠল মর্যাদার প্রতীক। নতুন সহস্রাব্দের শুরুর দিকেই শিক্ষাজগতে সুস্পষ্ট হয়ে গেল খাড়াখাড়ি বিভাজন। রাজ্য সরকারি শিক্ষা হয়ে দাঁড়াল গরিবের যষ্টি। আর যাঁরা জীবনে উন্নতি করতে চান, সেই শহুরে মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নবিত্তও, কাজ এবং মর্যাদা পেতে হবে বলে ইংরেজি-হিন্দি-কেন্দ্রীয় বোর্ডকে আঁকড়ে ধরলেন। পুরনো অভিজাতদের ছেলেমেয়েরা তো আগে থেকেই ইংরেজি মাধ্যমে যেতেন। আশি বা নব্বইয়ে বেড়ে উঠেছেন, নতুন বাংলা গানে, নতুন সিনেমার রিলিজ়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন যাঁরা, তাঁরাও ছেলেমেয়েদের ভর্তি করতে শুরু করলেন ইংরেজি মাধ্যমে। প্রক্রিয়াটা চক্রাকার। রাজ্য বোর্ডের বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোর মান পড়তে শুরু করল। যাঁরা চান, তাঁদের পক্ষেও ‘ভাল’ স্কুল খুঁজে বার করা মুশকিল হতে থাকল।
বিগত কুড়ি বছরের ইতিহাস এই প্রক্রিয়ার জোরদার হওয়ারই ইতিবৃত্ত। গোটা রাজ্যে প্রক্রিয়াটা একই, তা নয়। বিপুল জনসংখ্যার কারণে গ্রামবাংলার বেশির ভাগ জায়গাতেই রাজ্য বোর্ডের বাংলা স্কুলই এখনও একমাত্র গন্তব্য, সেখান থেকে ভাল ছাত্ররা উঠেও আসছে। কিন্তু কলকাতা ও শহরতলির চিত্র মোটের উপর এটাই, বাকি অঞ্চলেও প্রবণতা ওই দিকেই। এই পুরো সময়টা জুড়েই ‘সর্বভারতীয়’ ভাষা তার মতাদর্শগত বিস্তার বাড়িয়েই চলেছে। কলকাতার এফএম-এ বাংলা গান শুনতে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। মাল্টিপ্লেক্সে বাংলা সিনেমা খুঁজে পাওয়া কঠিন। হিন্দি-ইংরেজিতে পোক্ত ‘সচেতন’ জনসমষ্টির মধ্যে তা নিয়ে কোনও হেলদোলও নেই। এর মধ্যে তৈরি হয়েছে অজস্র সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেল, যাদের পরিচয় ‘ন্যাশনাল চ্যানেল’। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে হিন্দি ব্যবহারের চাপ ক্রমশ বর্ধমান। রাজ্য সরকারের তরফে চাকরি কিংবা শিক্ষায় স্থানীয় ভাষা বাধ্যতামূলক করার কোনও লক্ষণ নেই। বাকি সমস্ত রাজনৈতিক শক্তিও ভাষার প্রশ্নটা, আশির দশক থেকে এখনও এড়িয়েই চলেছে। মনে হয়, বাংলা ভাষাটা উঠে গেলেই সবাই স্বস্তি পায়। যে কারণে, বহুভাষিক যুক্তরাষ্ট্র থেকে, দ্বিভাষিক সর্বভারতীয়ত্বে এই নাটকীয় চলন, খুব মসৃণ ভাবেই হয়ে গেল গত চল্লিশ বছরে।