আগামী কাল শ্রী শ্রীমা সারদার ১৭২ তম জন্মতিথি।
সময়টা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। ভারতীয় সমাজ নানান সংস্কারে আচ্ছন্ন: ধর্মীয় ভেদাভেদ, জাতপাতের সমস্যা, পদে পদে নিষেধের বেড়াজাল— বাল্যবিবাহ, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, সপত্নী-সমস্যা ও অকালবৈধব্য প্রভৃতি নানা সমস্যায় জর্জরিত। রান্নাঘর ও আঁতুড়ঘরের বাইরে জগতে নারীদের ভূমিকা পুরুষের চোখে ছিল নামমাত্র। এ রকম এক সময় ও সমাজেই, ১২৬০ বঙ্গাব্দের ৮ পৌষ বাংলার এক নিভৃত পল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীমা সারদা দেবী। আর পাঁচ জন সাধারণ পল্লিবালিকার মতোই, একান্নবর্তী পরিবারে থেকে ও মানিয়ে চলেছেন। প্রথাগত বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। বাল্যেই হয়েছে বিবাহ। বড় দিদি হিসেবে ভাইদের সংসারের দেখাশোনা করেছেন, প্রতিপালন করেছেন পিতৃহারা ভাইঝি রাধুকে। আবার শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের পর তিনিই হয়ে উঠেছেন সঙ্ঘজননী। স্বদেশি-বিদেশি সব ভক্তকে কাছে টেনেছেন। কুটনো কুটেছেন, রান্নার আয়োজন করেছেন, সবাইকে খাইয়েছেন, তাঁদের এঁটো কুড়িয়েছেন, বাসন মেজেছেন। রক্ষণশীল, সংস্কারবদ্ধ পরিবেশে জীবন থেকেও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমন্বয়ের যে ভাব ফুটিয়ে তুলেছেন তা আমাদের অবাক করে।
ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার প্রাণই তো এই সমন্বয়। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনাদর্শ ও চেতনা জুড়ে এই সমন্বয়, তারই পরম্পরা মায়ের জীবন ও আচরণে, ভাবে ও ভাবনায়। শ্রীরামকৃষ্ণের কথা ‘যে সমন্বয় করেছে, সেই-ই লোক’— শ্রীমা সারদা দেবী যেন তারই মূর্ত রূপ। তাঁর কাছে সন্ন্যাসী-গৃহী, বৈষ্ণব-শাক্ত, হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান, উচ্চ-নীচ, ছোট-বড়, সকলেই সমান। সবার প্রতি তাঁর সমদৃষ্টি। আজীবন সমন্বয় সাধনায় ব্যাপৃত থেকেছেন, নানা ঘটনা তার উদাহরণ। সে কালে অব্রাহ্মণকে পায়ে হাত দিয়ে ব্রাহ্মণের প্রণাম করা চলে কি না তা নিয়ে সমাজে দ্বিধা, কিন্তু তাঁকে দেখছি, রাধুকে বলছেন এক ডাক্তারকে প্রণাম করতে। ডাক্তার জাতিতে কায়স্থ আর রাধু ব্রাহ্মণের মেয়ে, অতএব এই প্রণামে কথা উঠল। তিনি উত্তরে বললেন, “ডাক্তারবাবু কত জ্ঞানী, বিদ্বান; তাঁকে প্রণাম করবে না?” মানুষের চরিত্র, জ্ঞান, কর্মই পরিচয় তাঁর কাছে। সাগরপার থেকে আসা ‘ম্লেচ্ছ মেয়ে’ মার্গারেট নোবলকে আপন করে নিলেন মুহূর্তেই, আর এক বিদেশিনির আকুল মিনতিতে পুরুষ ও সাহেব ফোটোগ্রাফারের সামনে বসলেন ছবি উঠবে বলে। এই সবই আজকের বিচারে সহজ, কিন্তু সমসময়ের প্রেক্ষিতে গণ্ডি-ভাঙা উদারতা। স্বামী বিবেকানন্দ চিঠিতে লিখছেন, “শ্রীশ্রীমা এখানে (কলিকাতায়) আছেন। ইউরোপীয়ান ও আমেরিকান মহিলারা সেদিন তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। ভাবতে পার, মা তাঁদের সঙ্গে একসঙ্গে খেয়েছিলেন!”
যাঁর অন্তরে সমন্বয় সুপ্রতিষ্ঠিত, সমদর্শিতা তাঁর লৌকিক ব্যবহারে প্রতি পদে প্রকাশ পায়। মায়ের পিতৃহারা ভাইঝি রাধুর পোষা বিড়ালের জন্য মা এক পোয়া দুধের বন্দোবস্ত করেছিলেন। বিড়ালটি মায়ের পায়ের কাছে শুয়ে থাকত। কিন্তু জ্ঞান মহারাজ এক দিন তাকে প্রহার করছেন দেখে মায়ের মুখ বেদনার্ত হল। পরে তাঁকে মা এমনও বলেছিলেন, “ওদের ভেতরেও তো আমি আছি।” আমজাদের গল্প অনেকেরই জানা। নিম্নবর্ণের মুসলমান মানুষটি মায়ের বাড়ির দেওয়াল প্রস্তুত করছিলেন। মা তাঁকে নিজের ঘরের বারান্দায় খেতে বসিয়েছেন, আর তাঁর আর এক ভাইঝি নলিনী উঠানে দাঁড়িয়ে দূর থেকে ছুড়ে ছুড়ে খাবার পরিবেশন করছেন। মা দেখে বললেন, “অমন করে দিলে মানুষের কি খেয়ে সুখ হয়? তুই না পারিস, আমি দিচ্ছি।” খাওয়ার পর আমজাদ এঁটো পাতা তুলে নিয়ে গেলে মা উচ্ছিষ্ট স্থানটিতে জল ঢেলে ধুয়ে দিলেন। নলিনীদি তো তটস্থ হয়ে বলে উঠলেন, “ও পিসিমা, তোমার জাত গেল!, এর পরেই মায়ের সেই বিখ্যাত কথাটি: “আমার শরৎ যেমন ছেলে, এই আমজাদও তেমন ছেলে।” শরৎ মহারাজ অর্থাৎ সন্ন্যাসীপ্রবর স্বামী সারদানন্দের পাশে, তাঁর কাছে আমজাদেরও পরিচয় সম-সম্তান রূপে। যে সমাজে ছুঁলেই জাত যায়, হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়িতে যে সময় সীমাবদ্ধ, শ্রীমা সারদা দেবী সেখানে এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
তাঁর সময়টি পেরিয়ে গিয়েছে। সমাজ, মূল্যবোধ, শিক্ষা, অধিকারের দাবি, পাল্টেছে সব কিছুই। অনেক কিছুই আজ মানুষের আয়ত্তে। আবার আজও হাতের বাইরে কত কিছু— কায়িক, বাচিক ও মানসিক হিংসা, স্বার্থপরতা, সর্বোপরি ধর্মবিশ্বাস ও মতবাদের সঙ্কীর্ণতা আর জাতপাতের দোহাই দিয়ে বিনাশের চেষ্টায় আজও চার পাশের কিছু মানুষ উদগ্র, উন্মত্ত। আমরা যাঁরা উত্তরণের পথ খুঁজছি তাঁদের কাছে উপায় হতে পারে তাঁর সমন্বয়ধর্মী উদার মানসিকতাকে জীবনে ও আচরণে গ্রহণ করা, তাকে জীবনচর্যার অঙ্গাঙ্গি করে তোলা। ধর্মবিশ্বাস-নির্বিশেষে কয়েকটি জীবনের বার্তা এই পথে আমাদের সহায়ক হতে পারে, শ্রীমা সারদা দেবীর জীবনও তেমনই একটি। আর কে-ই বা এমন সহজ করে বলতে পারেন, “দোষ দেখবে নিজের, জগৎকে আপনার করে নিতে শেখো”?
প্রধান শিক্ষক, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয় নরেন্দ্রপুর