এক মাস ধরে ‘আমরা’ আন্দোলনের পথ হাঁটছি। ‘আমরা’ মানে কারা? খবরের কাগজ, সমাজমাধ্যমের ছবি বলছে, এই ‘আমরা’র মধ্যে ছাত্রছাত্রীরা আছেন, গৃহবধূ আছেন, চাকরিরত মানুষ আছেন। দেখছি স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত মানুষদের, সুন্দরবনের নৌকার উপর দাঁড়িয়ে থাকা আটপৌরে শাড়ি পরা মহিলাদের, অ্যাপক্যাব চালকদের, আইনজীবীদের, শিক্ষকদের, গবেষকদের— কে নেই সেই মিছিলে!
সবাই আছেন, কিন্তু সবার হয়ে আছেন কি? আমি আমার অধ্যাপিকা সহকর্মীকে প্রশ্ন করি, তিনি অমুক দিনে অমুক জায়গায় মিছিলে হাঁটবেন কি না। ঠিক সেই সময়, আমার সামনে ঝাঁট দিচ্ছিলেন যে সহায়িকা দিদি, তাঁকে সেই একই প্রশ্ন করি কি? আমরা সহকর্মীদের সঙ্গে হাঁটি, গবেষক বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটি, একই আবাসনে থাকা প্রতিবেশীর সঙ্গে হাঁটি। আটপৌরে শাড়ি পরা মহিলাটি তাঁর মতো হাঁটেন, তাঁর মতো শাড়ি পরা অন্যদের সঙ্গে। যৌনকর্মীর সন্তানরা নিজেদের মতো হাঁটেন।
আমরা এক সঙ্গে হাঁটি না কেন? আমরা হাত বাড়াই চেনা হাতের দিকে কেন? আমি বিখ্যাত মানুষটির দিকে হাত বাড়াতে চাই, আমার আপ্ত সহায়িকা দিদির দিকে নয় কেন? যৌনকর্মীর সন্তানরা দক্ষিণ কলকাতার স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীর মিছিলে আমন্ত্রিত হয় না কেন?
বিশ্বজনীন নারীবাদের তৃতীয় ঢেউ জানিয়েছিল একটি কথা— নারীবাদ, নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ তখনই সফল, যখন তা শোষণের সব ধাপকে, সব শ্রেণির মেয়েদের এক সঙ্গে নিয়ে চলতে পারে। আমরা বেশির ভাগই অবশ্য সেই সমতা থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকি। যাঁদের ‘ভাল মেয়ে’ মনে করি, যাঁরা আমাদের সামাজিক দাঁড়িপাল্লায়, জেন্ডার রোলের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ, শুধু তাঁদের বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়েরই প্রতিবাদ করি আমরা। অন্যথা করি না। ‘খারাপ মেয়ে’— তাঁরা যৌনকর্মী হতে পারেন, আমার সামাজিকতায় গ্রহণযোগ্য বা আমার মতো এক সামাজিক শ্রেণির বাসিন্দা না হতে পারেন— ‘ওঁদের’ বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়ের বিচার আমরা চাই কি? যদি বা চাই-ও, এমন তীব্র ভাবেই কি চাই?
যৌনকর্মীদের বিরুদ্ধে ঘটা যৌন-হিংসার কথাই ধরা যাক। ৮৭% যৌনকর্মী ধর্ষণের শিকার হন তাঁদের কর্মক্ষেত্রে। ৭৫% আইনি ব্যবস্থা করতে চেয়ে, বা পুলিশের কাছে গিয়ে আবারও যৌন-হিংসার শিকার হন। গত বছর, নিরোধক-বিহীন যৌনসম্পর্ক করতে না চাওয়ার ‘অপরাধ’-এ খুন হন বেঙ্গালুরুর এক যৌনকর্মী। প্রতিবাদ দূর অস্ত, সেই খবর আমরা জানতেও পারিনি।
গত পাঁচ বছরে ৪৫% বেড়েছে দলিত মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনা। প্রত্যেক দিন, ভারতে অন্তত দশ জন দলিত মেয়ে ধর্ষণের অভিযোগ করেন থানায়। নীরবে অত্যাচারিত হয় আরও কত জন। গত কয়েক মাসের মধ্যে ঘটা কয়েকটি উদাহরণ দিই। উত্তরপ্রদেশের বাগপতে ১৮ বছর বয়সি একটি দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করে ফুটন্ত তেলের কড়াইতে ফেলে দেওয়া হয়। চেন্নাইতে গৃহসহায়িকা হয়ে কাজ করতেন একটি ১৯ বছর বয়সি দলিত মেয়ে। ডাক্তারি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। প্রতিনিয়ত তাঁর অর্থনৈতিক অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ধর্ষণ করা হত তাঁকে। বিহারে ধর্ষণের পরে খুন হয় দু’টি নাবালিকা দলিত মেয়ে। গত বছর গাজ়িয়াবাদে একটি ন’বছরের দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করে তার বাড়িওয়ালা। এ ভাবে কি বিচার চেয়েছি আমরা, একটি ঘটনাতেও? ভারতে গ্রামীণ কর্মক্ষেত্রে ৭০ শতাংশেরও বেশি মহিলা যৌন-লাঞ্ছনার শিকার হন। মহারাষ্ট্রের বীড় অঞ্চলে করা অরিজিতা মিত্তলের গবেষণা বলে, ফসল বড় হয়ে গেলে মাঠে নামতে চান না মহিলা-চাষিরা, কারণ উঁচু ফসলের পিছনে অনেক সময় লুকিয়ে থাকে ধর্ষকরা। তাঁদের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার দাবি কেউ করেন না।
অতীতের কথা যদি বাদও দিই, আর জি কর-কাণ্ডের পরও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যতগুলি ধর্ষণ-লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে গেল, তার মধ্যে ক’টির বিচার চেয়েছি আমরা? স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন, এই প্রশ্নটি কোনও ভাবেই তিলোত্তমার উপরে ঘটা ভয়ঙ্কর নির্যাতনের ঘটনাকে ছোট করে দেখানোর জন্য নয়। শুধু এটুকু মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে, আমাদের প্রতিবাদের ইচ্ছাও কিন্তু সব ক্ষেত্রে সমান নয়। আমাদের ‘বাড়ির মেয়ে’ হয়ে ওঠার মতো ছিলেন না এই নির্যাতিতারা, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাড়ির কর্মক্ষেত্রে ওঁরা ধর্ষিত হননি, তাই কি আমরা প্রতিবাদ করিনি?
আমাদের গৃহসহায়িকা যদি তাঁর নাবালিকা মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়েই কাজে আসেন, জানান যে, বস্তির বাড়িওয়ালা মেয়েটির সঙ্গে এমন কিছু করেছে যে ডাক্তার দেখাতে হয়েছে, সে স্কুলেও যেতে পারছে না, তাকে একা বাড়িতেও রেখে আসা যাচ্ছে না— সম্ভবত আমরা ভেবে নেব, বস্তি-টস্তিতে এমন ঘটনা ‘খুবই স্বাভাবিক’। বড় জোর গৃহসহায়িকার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলব, ডাক্তার দেখিয়ো। হয়তো দু’এক জন মেয়েটিকে নিয়ে হাসপাতালেও যেতে চাইবেন, পুলিশে অভিযোগ করতে চাইবেন। অভিজ্ঞতা বলে, তাঁকে গৃহসহায়িকাই বলবেন, “ছেড়ে দিন দিদি, থানা পুলিশ করার দরকার নেই!” আমার স্নাতকোত্তর স্তরে পড়া মেয়ের যতখানি নিরাপত্তা প্রয়োজন, এই মেয়েটিরও ততটাই, ভাবতে পারব কি ‘আমরা’?