সকালে কচিকাঁচারা বিটি রোডের সামনে এসে দাঁড়াল। স্কুলবাস আসবে। কিন্তু সবার নাকে রুমাল! কারণ, ডাইনে-বাঁয়ে সদ্য গজানো দুটো খোলা ভ্যাটের উপচানো বর্জ্য প্রাণঘাতী দুর্গন্ধে প্রভাতী বাতাস ‘আমোদিত’ করেছে! পচা খাবারের মহোৎসবে কাকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বাচ্চাগুলো অস্থির। কখন বাস আসবে, কখন নরককুণ্ডের দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি মিলবে! কিন্তু স্থায়ী আবাসিকদের কী হবে? পালাবেন কোথায়?
ছবিটা এই অঞ্চলেরই বিশেষত্ব— ভাবা ভুল। এটি নগর কলকাতার সাম্প্রতিক স্থিরচিত্র। শহর ও শহরতলির ব্যস্ত, জনবহুল সড়ক বিটি রোডের দু’ধারে, বিশেষত পানিহাটি পুরসভা অঞ্চলের অলিগলিতে, বাড়ির চার পাশে পচা বর্জ্যের স্তূপ জমতে জমতে নরককুণ্ড!
নগরায়নের নেতিবাচক চিহ্নগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলিতে স্পষ্টতর। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা আর গ্রামের মানুষের শহুরে পেশায় স্থানান্তর শহরে বস্তি বাড়াচ্ছে। জবরদখল (স্কোয়াটার) আর যত্রতত্র অপরিকল্পিত আবাসন গড়ে উঠছে। নগরায়ন সরাসরি বর্জ্য উৎপাদন করে। আর অবৈজ্ঞানিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশের অবনতি ঘটাচ্ছে। নগরায়ন বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার পরিবর্তন, ভোগবাদ কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে (সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট) জটিল করেছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতা, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, প্রযুক্তির ভুল প্রয়োগ, পুর এলাকার কঠিন বর্জ্যের প্রতি মানুষের উদাসীনতা পরিস্থিতিকে দুর্বিষহ করছে।
গবেষণা বলছে, দেশে ৩০৮৪টি বর্জ্য ফেলার জায়গা, তা ১০০০ হেক্টর জমি দখল করেছে। জায়গাগুলি পরিবেশগত বড় সমস্যা। কারণ বর্জ্য-নির্গত মিথেন গ্যাসই নয়, দূষিত হচ্ছে জল ও মাটি। আইনমতে, স্তূপীকৃত কঠিন বর্জ্যের উচ্চতা যেন ২০ মিটার না ছাড়ায়। বহু ক্ষেত্রেই নির্দেশটি লঙ্ঘিত। তাই ভারত বিপুল জনসংখ্যা, বিরাট আবর্জনার কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর পরিমাণ প্রতি বছর প্রায় ১.৩ বিলিয়ন টন, যা বিশ্বের মোট বর্জ্যের এক তৃতীয়াংশ! আশঙ্কা, ২০২৫-এ ভারতের শহরাঞ্চলে বর্জ্য উৎপাদন হবে জনপ্রতি ০.৭ কেজি। ১৯৯৯-এর তুলনায় প্রায় ছয় গুণ বেশি।
কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দিল্লি, কেরল, মহারাষ্ট্র ছাড়াও ছত্তীসগঢ়, ত্রিপুরা, সিকিম, গোয়ার মতো ছোট রাজ্যগুলোও পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে এগিয়ে। গবেষণা বলছে, এ রাজ্যে ১২৩টি বর্জ্য ফেলার জায়গা। পরিবেশ দফতরের তথ্যানুসারে, পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক গড়ে ১৫০০০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হয়। তার বড় জোর ১০% পুনর্ব্যবহার হয়। বাকিটা যায় ভাগাড়ে। ফলে, ভাগাড়ের জমি কমছে, বাড়ছে দূষণ। নির্দিষ্ট সময়ের পরেই বর্জ্য থেকে বিষাক্ত গ্যাস ও রাসায়নিক বার হয়। যেমন মিথেন, সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড। শরীরে ঢুকলে, লিভারের ক্ষতির আশঙ্কা।
কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলির অন্যতম। দেড় কোটিরও বেশি মানুষের এই শহর প্রতি দিন প্রায় ৪,০০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদন করে। যা ঠিক ভাবে নিষ্কাশন হয় না। লোকে রাস্তায় আবর্জনা ফেলে। ড্রেনগুলি আটকে থাকে। স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। শহরের রিসাইক্লিং প্লান্ট-এর সংখ্যা সমস্ত বর্জ্য পরিচালনার জন্য অপর্যাপ্ত। বেশির ভাগ বর্জ্যই উপচে পড়া ল্যান্ডফিলগুলোতে (ভরাটকরণের জমি) জমা হয়।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার তিনটি পর্ব। বর্জ্য সংগ্রহ, বর্জ্য পরিবহণ, বর্জ্য নিষ্পত্তি। সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করেন বা বাসিন্দাদের বর্জ্য ফেলার ড্রপ-অফ পয়েন্ট তৈরি করেন। সংগৃহীত বর্জ্য যায় ট্রিটমেন্ট বা পরিশোধন কেন্দ্রে। এই পর্বে বাছাই করা পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্যকে ভেঙে নতুন পণ্য তৈরির যোগ্য করা হয়। নয়তো উচ্চ তাপমাত্রায় পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। পোড়ানো হলে বাতাসে ক্ষতিকারক দূষক ছড়াতে পারে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত পর্যায় নিষ্পত্তি। নিষ্পত্তির বিকল্পগুলির মধ্যে আছে ল্যান্ডফিল, জ্বালিয়ে দেওয়া, পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা। কলকাতায় নিষ্পত্তির সবচেয়ে চালু পদ্ধতি ল্যান্ডফিল। ল্যান্ডফিলগুলোতে বর্জ্য পুঁতে মাটি দিয়ে ঢাকা হয়। কলকাতায় পর্বগুলির সম্পাদন কোনও স্তরেই যথাযথ নয় বলে অভিযোগ।
শহরের কাছেপিঠে ভাগাড় তৈরির জমিও মিলছে না। ভাগাড়ের জন্য নির্দিষ্ট জমিতেও নাকি নেতারা অর্থের বিনিময়ে প্রোমোটিং-এ উৎসাহ দেন। গড়ে ওঠে বহুতল আবাসন। তখনই কাছেপিঠে গজায় অপরিকল্পিত আনাজ-মাছের বাজার, বাণিজ্যিক এলাকা। নতুন করে জমে বর্জ্য। অনেক বহুতল সকালে পুরকর্মীদের বর্জ্য না দিয়ে রাস্তার ভ্যাটগুলোতে ফেলছে। সমস্যা বাড়ছে। শুধু নাগরিকরাই নন, স্বাস্থ্যহানিতে ভুগছেন জনস্বাস্থ্য কর্মীরাও। কলকাতা পুরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মীরা নানা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত। সন্দেহ, সারা দিন বর্জ্য ঘাঁটার কারণেই সমস্যা।
দিনের পর দিন, ভাগাড়ে জঞ্জাল ডাঁই করার পরিণাম কলকাতা আর শহরতলির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। বহুকালের পুরনো ভাগাড় ধাপা বন্ধের মুখে। ভাগাড়ের নতুন জমি খুঁজতে প্রশাসনের নজর পূর্ব কলকাতার জলাভূমির দিকে। শহরের উপকণ্ঠে প্রমোদনগর ভাগাড়ও ক্রমশ বুজছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, ভাগাড়ে জমা মিথেন থেকে আগুন জ্বলে ধোঁয়া ছড়াতে পারে। আশপাশের বাতাস হয়ে ওঠে বিষবাষ্প। প্রমোদনগরের বাসিন্দারা এই বিপদ নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। এখনও বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে দক্ষিণেশ্বরের দিকে গেলে সেই কটু গন্ধ নিশ্চিত করবে আপনি এখনও কল্লোলিনী কলকাতার গন্ধবিভোর গণ্ডি পেরোতে পারেননি!