১৯৯১ সালের বিধানসভা নির্বাচন। গ্রামের নির্বাচক তালিকায় নাম, অথচ চাকরিসূত্রে বাস করি অন্যত্র। ভোট দেওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট দিনে কর্মস্থল থেকে গ্রামে ফিরে বেলা তিনটে নাগাদ ভোটকেন্দ্রের লাইনে দাঁড়াতে তৎকালীন শাসক দলের এক স্থানীয় নেতা হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। কাছে যেতে বললেন, “আমরা ভাবিনি, তুমি এতটা উজিয়ে ভোট দিতে আসবে। দেখলাম, ভোটটা নষ্ট হবে, তাই তোমার ভোটটা আমরা দিয়ে দিয়েছি।”
বহু কাল হল গ্রাম ছেড়ে পুর এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছি। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সকাল সকাল পুরসভার ভোট দিয়ে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে দুই মহিলার কথা শুনছিলাম। বলছিলেন, “ভালই হল। বোতাম টেপার কষ্টটুকু আর করতে হল না। গিয়ে শুনলাম, আমার ভোট পড়ে গিয়েছে।”
দুটো ঘটনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান প্রায় ৩১ বছর। অনেকেই বলবেন, দুটোই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু লক্ষণীয়, এই দীর্ঘ সময়কালে দেশের তথা রাজ্যের আর্থ-সামাজিক তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বদলেছে শাসক, বদল হয়েছে ভোট-প্রক্রিয়া। নির্বাচকদের সচিত্র পরিচয়পত্র প্রদানের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে তৎকালীন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশনের হাত ধরে ভারতীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন এসেছে, তাকে অনেকেই বৈপ্লবিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। পেপার ব্যালটের পরিবর্তে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার শুরু হওয়ার পর ভোট গ্রহণ এবং গণনা সহজতর হয়েছে।
কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি। ভারতে ও পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থাকে অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। বরং দিন যত এগোচ্ছে, নির্বাচন প্রক্রিয়া যেন বিভীষিকাময় হয়ে উঠছে। লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত, পুরসভা, এমনকি শিক্ষালয় পরিচালন সমিতি বা সমবায় সমিতি, কোনও নির্বাচনই এই অরাজকতা থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। এক দিকে পেশিশক্তির আস্ফালন বাড়ছে, এবং অপর দিকে প্রবল রাজনৈতিক চাপ ও কৌশলে প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা প্রকট হয়ে উঠছে। প্রকৃত ভোটদাতাকে ভোটদানে বাধা, ভীতি প্রদর্শন, বুথ দখল, ভোটকর্মীদের নিগ্রহ, বিরোধী পোলিং এজেন্টকে ভোটকেন্দ্র থেকে বার করে দিয়ে অবাধ ছাপ্পা, ভোটযন্ত্র ভাঙচুর, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, এমনকি সংবাদমাধ্যমের উপর নির্মম আঘাত যেন ভোট-প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক জায়গাতেই স্থানীয় স্তরের নির্বাচন, বিশেষ করে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত এবং পুরসভার নির্বাচনে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে না পারায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় সূচিত হচ্ছে।
কিছু কিছু রাজনীতিবেত্তা এত কাল বলে এসেছেন, যথার্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে নির্বাচকের যে সমাজ-সচেতনতা, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রয়োজন, ভারতীয় জনগণের সিংহ ভাগের মধ্যে তার খুব অভাব। ফলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে আম নাগরিকের একটা বড় অংশ যাবতীয় প্রচার, প্রলোভন এবং প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে স্ববিবেচনাপ্রসূত মত প্রকাশে অসমর্থ। কিন্তু সম্প্রতি এ রাজ্যের আইএমএ-র নির্বাচন ঘিরে ঘটে যাওয়া ধুন্ধুমার কাণ্ড সেই মতবাদকেও নস্যাৎ করে দিয়েছে। জয়ের মরিয়া নেশায় সমাজের উঁচুতলার সুশিক্ষিত ডাক্তারবাবুরা নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে রাখা লোভ, কুশিক্ষা, অনৈতিকতা এবং অসহিষ্ণুতার যে নগ্ন রূপটি প্রকাশ করে ফেললেন, তা নজিরবিহীন।
শুধুমাত্র নির্বাচনের জন্যে এই পাহাড়প্রমাণ অপচয় এবং তাকে কেন্দ্র করে এই কুৎসিত কুনাট্য থেকে মুক্তির কি কোনও উপায় নেই? উপায়টা হয়তো লুকিয়ে ‘ডিজিটাল ভারত’ স্বপ্নের মধ্যে। বিগত কয়েক বছর ধরে ভারত সরকার এই ডিজিটাল ভারত গড়ার প্রচার করে আসছে। উন্নত পরিকাঠামো এবং বর্ধিত ইন্টারনেট সংযোগের হাত ধরে ইতিমধ্যে বহু সরকারি পরিষেবা অনলাইনে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’, এক কথায় অধিকাংশ সরকারি পরিষেবা পাওয়ার জন্যে মোবাইল ফোন নম্বর সংযুক্তিকরণ প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে গিয়েছে। ফলে ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, দেশের প্রান্তিক মানুষেরাও ইন্টারনেট সংযোগ-যুক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রায় দু’বছর ধরে চলা লকডাউনে পড়াশোনাও চলেছে অনলাইনে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তো স্কুলের শেষ ধাপের ছাত্রছাত্রীদের ট্যাব বা মোবাইল ফোন কেনার টাকা দেওয়ার প্রকল্পও চালু করেছে। এই যখন সার্বিক চিত্র, তখন সমগ্র নির্বাচন প্রক্রিয়া অনলাইনে করার ভাবনাটা নিশ্চয়ই আকাশকুসুম নয়। এতে এক দিকে পেশিশক্তির আস্ফালন এবং কারচুপি কিছুটা হলেও কম হবে, অপর দিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং বিপুলতর শ্রমদিবস বাঁচানো যেতে পারে।
অনেকে হয়তো বলবেন, এখনও এমন বহু প্রান্তিক এবং দরিদ্র মানুষ আছেন, মোবাইল ফোন যাঁদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখনও যাঁদের আধার কার্ড কিংবা রেশন কার্ডে মোবাইল সংযুক্তিকরণ সম্ভব হয়নি, তাঁদের বিনামূল্যে মোবাইল ফোন এবং নির্বাচনকালীন সময়ের জন্যে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া যেতে পারে।
তবে সবার আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কারণ এ দেশে ভাতের থালা থেকে শ্বাসবায়ু, পুরোটাই রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।