Indian Railways

‘কু’ আছে, ঝিকঝিক নেই

রেল-দুর্ঘটনা ছোটই হোক বা বড়, তার কি কোনও কমবেশি হয়েছে? পরিসংখ্যান কী বলছে? সরকারি বয়ান সদুত্তর দেয় না। একটি সমীক্ষা বলছে, ২০১৩-১৪ থেকে ২০২৩-২৪ এই সময়ে ট্রেন-দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে ৩৭%।

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:০৬
Share:

মধ্যবিত্ত ট্রেনের কামরায় বেশ এক সংসার তৈরি করে। রোজকার বৃত্ত থেকে কয়েক ঘণ্টার মুক্তি আসে ট্রেনের কামরায়। সেই অনুভব তছনছও হয়ে যায়, হঠাৎ ট্রেন খুব জোরে ব্রেক কষলে। যাত্রীরা ভয়ে কেঁপে ওঠেন, কোনও বিপদ...? বিপদ সত্যি আসে, আবার কখনও যাত্রা নির্বিঘ্ন হয়। কিন্তু যদি না হয়, যেমন ঘটেছিল ২০২৩-এর ৩ জুন?

Advertisement

বালেশ্বরে তিনটি ট্রেনের দুর্ঘটনায়, একটি মালবাহী ও দু’টি যাত্রিবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে (ছবি) মৃত ২৯১, আহত ন’শোর বেশি। সে বছরই ১১ অক্টোবর বিহারে নর্থ-ইস্ট এক্সপ্রেসের ছ’টি কামরা লাইনচ্যুত হয়, আট জন মারা যান, সত্তরেরও বেশি আহত। ২৯ অক্টোবর অন্ধ্রপ্রদেশে বিশাখাপত্তনম-রায়গড়া এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়, ১৪ জন মৃত, ৫০ জন আহত। ২০১৭-তে পুরী-হরিদ্বার উৎকল এক্সপ্রেস মুজাফ্‌ফরনগরে লাইনচ্যুত হয়, ২০ জন মারা যান। ২০২২-এর অগস্টে বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেসের ছ’টি কামরা আলিপুরদুয়ারে লাইনচ্যুত হয়, অন্তত ন’জনের মৃত্যু হয়। গত বছর জুনে শিয়ালদহগামী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনায় মৃত অন্তত ১৫।

যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলা হয়, বলা হয় না সর্বাত্মক ক্ষয়ক্ষতির ধরন, আতঙ্কের পরিমাপ। বড় দুর্ঘটনা ছাড়াও গত তিন বছরে রেল-দুর্ঘটনা ঘটেছে আরও বেশ ক’টি। নিহতের সংখ্যা শূন্য, তাই হয়তো তত কথা হয়নি। গত ৯ এপ্রিল হাওড়া-সেকেন্দ্রাবাদ ফলকনামা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় কোনও মৃত্যু নেই, তবে দুর্ঘটনার ধরনটি অদ্ভুত। ট্রেনের শেষ পনেরোটি বগি হঠাৎ করে আলাদা হয়ে যায় বাকি ট্রেন থেকে, চালক বুঝতেও পারেননি তা! ৩০ মার্চ বেঙ্গালুরু-কামাখ্যা এক্সপ্রেস কটকের কাছে লাইনচ্যুত হয়, চারটি কামরা ছিটকে পড়ে সাত জন আহত হন।

Advertisement

রেল-দুর্ঘটনা ছোটই হোক বা বড়, তার কি কোনও কমবেশি হয়েছে? পরিসংখ্যান কী বলছে? সরকারি বয়ান সদুত্তর দেয় না। একটি সমীক্ষা বলছে, ২০১৩-১৪ থেকে ২০২৩-২৪ এই সময়ে ট্রেন-দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে ৩৭%। দ্য সাউথ ফার্স্ট সংবাদমাধ্যমের সমীক্ষামতে, গত তিন বছরে ট্রেন-দুর্ঘটনা বেড়েছে চার গুণ। তা হলে কি রেলযাত্রা আর নিরাপদ নেই? সব ট্রেনের ক্ষেত্রেই কি বিপদ সমান, না কি বিশেষ বিশেষ ট্রেনে তত নয়? সেই ট্রেনের বৈশিষ্ট্য কী— তার মহার্ঘ ধরন? অন্য ট্রেনের তুলনায় দ্বিগুণ দামে যাত্রা-নিশ্চিন্তি কেনার ব্যবস্থা?

‘বন্দে ভারত’ এক্সপ্রেসে পুরী-কলকাতা টিকিটের দাম এসি চেয়ার কারে ১৪২৫ টাকা, এগজ়িকিউটিভ ক্লাসে ২৬০০ টাকা। সেখানে শালিমার-পুরী ধৌলি এক্সপ্রেসের ভাড়া এসি চেয়ার কারে ৭০০ টাকা। বন্দে ভারতে নন-এসি বা জেনারেল কামরা নেই, ধৌলি-তে নন-এসি টিকিট ১৯০ টাকা, দামের ব্যবধান প্রায় দ্বিগুণ বা তারও বেশি। মধ্যবিত্তের বেড়ানোর বাজেটে ইচ্ছে ও স্বপ্ন যতটা বেশি, অর্থ তত নয়। বন্দে ভারত-এ স্বপ্নের মূল্য নেই। যদি কেউ স্বল্পব্যয়ের ট্রেনে যাবেন ঠিক করেন, তা হলে ঘনাতেই পারে অঘটন-দুর্ঘটনার আশঙ্কা, ভাবাটা খুব বাড়াবাড়ি?

ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি দফতরের কী উত্তর? বেশ ক’টি আরটিআই ফাইলের সূত্রে বর্তমান রেলমন্ত্রী জানিয়েছেন, দুর্ঘটনা বা তা ঘটার সম্ভাবনা আগের থেকে ৪০% হ্রাস পেয়েছে। গত ১০ এপ্রিল ‘ভারত রাইজ়িং সামিট’-এ তাঁর বক্তব্য, দশ বছরে দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় ৮০% কমিয়ে আনা গেছে। তবে এই দাবির সপক্ষে কোনও তথ্যপ্রমাণ দেখাননি।

ভারতীয় রেলের এই অবস্থা কেন? ট্রেনচালকদের টানা ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়, দাবি জানিয়েও বিশ্রাম, ঘুম বা খাওয়ার সময় দেওয়া হয় না। কাপলিং, যন্ত্রপাতির অবস্থা বেহাল। ট্র্যাক বগি চাকা মেরামত করা যাচ্ছে না কেন? উত্তর একটাই, অর্থ নেই। চলতি বছরেও রেলখাতে বরাদ্দ কমিয়েছে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক। অর্থ কি সত্যিই নেই? ২০২২-এ সিএজি-পরিচালিত র‌্যানডম অডিট রিপোর্ট জানায়, যাত্রী-সুরক্ষার জন্য ২০১৭-য় প্রতিষ্ঠিত জাতীয় রেল সংরক্ষক কোষে বার্ষিক বরাদ্দ হয় ২০,০০০ কোটি। রেল-সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ অর্থ অন্যান্য খাতে ব্যবহৃত হয়েছে। তিন মাস সময়ের হিসাব দেখাচ্ছে, ৪৮.২১ কোটি টাকা ব্যবহৃত ফুট মাসাজার, শৌখিন বাসন, বিলাসবহুল বালিশ, উইন্টার জ্যাকেট ইত্যাদিতে। প্রতি বছর প্রায় ১০০৪ কোটি টাকা ব্যয় হয় অপ্রয়োজনীয় খাতে। বিলাসের ব্যবস্থা করতে আলাদা খরচ করে, ২৪% কমানো হয়েছে জেনারেল কামরা, বেড়েছে এসি কামরা।

এর পরেও বিলাসবহুল ট্রেনে না পোষালে বেসরকারি বিমান তো আছেই। ‘ট্রেনে আর যাওয়াই যায় না, যা অবস্থা’ বলে যে মাত্র ৪ লক্ষ মানুষ বিমান পরিষেবা ব্যবহার করতে পারেন (দৈনিক গড়)— বিমানে যাতায়াত তাঁদের বাস্তব। আর ১.৩ কোটি মানুষ রোজ ভারতীয় রেলে যাতায়াত করেন, সেটি তাঁদের বাস্তব। আর যে মধ্যবিত্ত পরের ছুটিতে কোথায় যাবে, কোন ট্রেনে টিকিট পাওয়া যাবে তার খোঁজ করছে, সাধ ও সাধ্য মেলানোর চেষ্টা করছে আপ্রাণ— সে অভিযোগ জানায় কাকে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement