সাতটা সোনাসমেত মোট ২৯টা পদক জিতে ভারতীয় খেলোয়াড়রা শেষ করলেন এ বারের প্যারালিম্পিক্স অভিযান। পদক তালিকায় স্থান ১৮তম। এই সাফল্য কুর্নিশযোগ্য। অন্তত, এক মাস আগেই শেষ হওয়া অলিম্পিক্সের আসরে আশাভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই— ভারত শেষ করেছিল ৭১তম স্থানে।
স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ রাষ্ট্রের অংশ দেশ হিসাবে শুরু ভারতের অলিম্পিক্স অভিযান। স্বভাবতই ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা নিয়ে নয়, ব্রিটিশ ইউনিয়নের অধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্যারিসে ১৯০০ সালের প্রথম অলিম্পিক্সে যোগ দেয় ভারত। লাল রঙের পতাকার মধ্যে ইউনিয়ন জ্যাকের সঙ্গে সূর্যমুখীর ভিতরে ‘স্বর্গের আলো, আমাদের পথপ্রদর্শক’ লেখা— এই ছিল ভারতের পতাকা। প্রথম বার এক জন মাত্র প্রতিযোগী নরম্যান প্রিচার্ডের হাত ধরে অ্যাথলেটিক্সে দু’টি পদক আসে। সম্প্রতি ব্রিটেন আবার অলিম্পিক কমিটির কাছে এই পদক দু’টির দাবি জানিয়েছে। এখনও পর্যন্ত ১০টি সোনা, ১০টি রুপো ও ২১টি ব্রোঞ্জ নিয়ে ১৪৪ কোটি মানুষের দেশ ভারতের ঝুলিতে মোট ৪১টি পদক। অর্থাৎ সাড়ে তিন কোটি মানুষ পিছু একটি পদক আছে ভারতের ঝুলিতে। অন্য দিকে, প্যারালিম্পিক গেমসে মোট ১৩ বার অংশগ্রহণ করে ভারতের ঝুলিতে রয়েছে ১৬টি সোনা, ২১টি রুপো এবং ২৩টি ব্রোঞ্জ-সহ মোট ৬০টি পদক।
অলিম্পিক্স প্রতিযোগিতায় এক সেকেন্ডের এক শতাংশ সময়ে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হতে পারে। ইতিহাস বলছে, বারে বারেই বহু ভারতীয় প্রতিযোগী পদকের খুব কাছে এসে থেমে গিয়েছেন— চতুর্থ বা পঞ্চম স্থানে শেষ করেছেন লড়াই। এ বারের অলিম্পিক্স চলাকালীনও ‘চতুর্থ স্থানের গেরো’ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘন জনবসতির দেশ ভারত অলিম্পিক্সে খারাপ ফলাফল করে কেন, তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ২০১২ সালে বিবিসি-র সাংবাদিক জাস্টিন রাউলাট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তিনি যে কথা বলেছিলেন, এ বারের অলিম্পিক্সে ভারতের ব্যর্থতা নিয়ে সম্প্রতি সিএনএন-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন ফের সে দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। সেই বিশ্লেষণের মূল কথা হল, এই গোত্রের প্রতিযোগিতায় সফল হওয়ার জন্য যে ধরনের সুবিধা পাওয়া প্রয়োজন, ভারতে তা অমিল। ১৪৪ কোটি জনসংখ্যার অতি সামান্য অংশ— এক কোটিরও কম ভারতীয়— আধুনিক ক্রীড়া সরঞ্জাম ও নিয়মিত অনুশীলনের সুযোগ পান। পদক জয়ে পিছিয়ে থাকার অন্য একটি বড় কারণ হল অপুষ্টি, বিশেষ করে শিশুদের। এটি এখনও আমাদের দুশ্চিন্তার বিষয়। বিশ্ব ক্ষুধা তালিকায় ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১১তম।
অন্য কারণগুলোর মধ্যে আছে সামাজিক জাতপাত ও ভেদাভেদের বিষাক্ত ধারাবাহিকতা; মেয়েদের খেলাধুলায় অপর্যাপ্ত উৎসাহদান ও বিবিধ বাধা থেকে যাওয়া; এবং ক্রীড়া সংস্থাগুলোর ম্যানেজমেন্টে অযোগ্য ব্যক্তিদের স্বার্থকলুষিত উপস্থিতি। সর্বোপরি, আমাদের ক্রীড়া বাজেট এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সারা বিশ্বে গড়ে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ০.৫ শতাংশ ক্রীড়া খাতে খরচ হলেও ভারতে সেই হার মাত্র ০.১ শতাংশ। ২০২৪ সালে কেন্দ্রীয় বাজেটে ৩৪৪২.৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে ক্রীড়া দফতরের জন্য, যার সিংহভাগ (প্রায় ৯০০ কোটি টাকা) গিয়েছে ‘খেলো ইন্ডিয়া’ নামক প্রকল্পে। গত বছরের বাজেটে টপস-এ (টার্গেট অলিম্পিক্স পোডিয়াম স্কিম) সামান্য বরাদ্দ বাড়িয়ে আশাপূরণের এক ধরনের দৃষ্টিবিভ্রম সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু গুজরাত, উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপিশাসিত রাজ্যের কপালে বরাদ্দের সিংহভাগ জুটলেও বিরোধীশাসিত রাজ্যের জন্য বরাদ্দ বহুলাংশে কম। এটি খুবই আক্ষেপের বিষয় যে, আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্বার্থের ঘোলা জলে মূল উদ্দেশ্য দিন-দিন অর্থহীন হয়ে পড়ছে। ক্রীড়াক্ষেত্রে সফল দেশগুলোর অন্যতম আমেরিকা, চিন, রাশিয়া ও অন্যত্র খুব ছোট বয়স থেকে শিশুদের নির্বাচিত করে ট্রেনিং শুরু করা হয়। চিনে দুই হাজারের উপর ক্রীড়া বিদ্যালয় আছে, যেগুলি অলিম্পিক্সে পদকজয়ী তৈরির আঁতুড়ঘর। এর সঙ্গে আছে দু’শোরও বেশি ক্রীড়া অ্যাকাডেমি। প্রতি অলিম্পিক্সেই পদক তালিকায় চিনের সঙ্গে ভারতের ব্যবধান এমন অলঙ্ঘ্য কেন, সেই প্রশ্নটির উত্তর রয়েছে এখানেই— চিন পদক জেতে মূলত তাদের ব্যবস্থার কারণে, আর ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা যে ক’টা পদক পান, তা দেশের বিচিত্র ব্যবস্থা সত্ত্বেও।
‘ভারত মানেই ক্রিকেট আর ক্রিকেট মানেই ভারত’ এমন সরলীকরণের আবহে অনেকেই ক্রিকেটকে দোষারোপ করেন ভারতে অন্য খেলাধুলার মানোন্নয়নের প্রধান অন্তরায় রূপে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিশ্বের কয়েকটিমাত্র দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ক্রিকেট নিয়ে সীমাহীন মাতামাতি এখানে লক্ষ করা যায় এবং ক্রিকেটে আর্থিক ও সামাজিক ভাবে প্রাপ্তিযোগ অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তার সামান্য অংশ যদি বাকি ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দেখা যেত, তা হলে অলিম্পিক্স, এশিয়ান গেমস ও অন্যান্য ক্রীড়া আসরে দেশের স্থান অনেক উন্নত হতে পারত। কিন্তু ক্রিকেটেও আপাত-অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলে দেশকে চরম সম্মান এনে দেওয়ার নজির অনেক। বোলার ব্যাটারদের বাইরে ফিল্ডিংকেও নৈপুণ্যের শিল্পে রাঙিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়া যায়। আশার আলো একটাই— আবার আর এক স্বপ্নের শুরু হওয়া। ২০২৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিকে ক্রিকেট থাকছে, এবং আশা করা চলে যে, এই একটি বিভাগে ভারতের সোনা আসবেই।
ভারতীয় সমাজে লেখাপড়া সামনের সারিতে থাকলেও খেলাধুলা নয়। অভিভাবকদের তরফে খুব কম উৎসাহ দেওয়া হয়। লেখাপড়ার যে ধারা যুগ-যুগ ধরে আমাদের কৃষ্টির অঙ্গ হয়ে আছে, ক্রিকেট বাদে বাকি খেলাধুলা পারেনি সেই অর্থে আমাদের জাতীয়তাবোধের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠতে। খেলাধুলা সীমিত থেকে গিয়েছে শুধু খেলা হিসাবেই। ধুলোবালির মধ্যে লুকানো মণিমাণিক্যের সন্ধান ঠিক ভাবে ঠিক সময়ে করলে শুধু ডাক্তারি, এঞ্জিনিয়ারিং, বিজ্ঞান, কলা ও আইন নয়, ক্রিকেট ছাড়াও নানা খেলায় দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন হত। আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের পরতে-পরতে খেলাধুলার সংস্কৃতি না ঢুকতে পারলে কখনও সফল হবে না বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় নিয়মিত সাফল্য অর্জনের স্বপ্ন।