উনিশশো সাতচল্লিশের পর ভারতে অনগ্রসর সম্প্রদায় বা আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস বা কাস্ট সম্পর্কে সামাজিক মনোভাব কেমন ছিল?
এ নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করে প্রথম ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস কমিশন যেটা কাকা কালেলকার কমিশন নামে পরিচিত। ১৯৫৫ সালে এই কমিশন ভারত সরকারকে তার রিপোর্ট পেশ করে। এর মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ভারতের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে কী ভাবে শনাক্ত করা হবে তার মানদণ্ড নির্ণয় করা এবং পাশাপাশি অনগ্রসর শ্রেণির সামগ্রিক উন্নয়নের দিক নির্দেশ করা। প্রায় ২৩২৭টি জাতি গোষ্ঠী (কাস্ট)-কে চিহ্নিত করা হয় এবং বিস্তারে তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সর্ব ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করার জন্য সংরক্ষণ-সহ একাধিক সুপারিশ দেয়। এমনকি ১৯৬১ সালের সেনসাসে জাতিভিত্তিক জনগণনার কথাও প্রস্তাব দিয়েছিল এই কমিশন। যদিও ভারত সরকার এই কমিশনের করা সুপারিশ বাস্তবায়িত করা হয়নি। ১৯৮০-র দশকের ভারতের রাজনীতি উত্তাল হয়ে উঠেছিল মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টকে কেন্দ্র করে। ১৯৭৮ সালে ভারত সরকার বি পি মণ্ডলের নেতৃত্বে ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস কমিশন গঠিত করে, যা মণ্ডল কমিশন নামে বহুলপরিচিত। সারা দেশ জুড়ে সমীক্ষা করে তফসিল জাতি ও জনজাতির বাইরে প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক জাতি বা ‘কাস্ট’কে অনগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত করে এই কমিশন।
এই শনাক্তকরণের মানদণ্ড ছিল জাতির সামাজিক, শিক্ষাগত ও আর্থিক পশ্চাৎপদতা। মণ্ডল কমিশন অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসিদের জন্য শিক্ষায় ও কর্মসংস্থানে ২৭% সংরক্ষণের কথা সুপারিশ করে। বহু রাজনৈতিক আন্দোলনের পর ১৯৯০ সালে ভি পি সিংহের সরকার এই প্রস্তাবকে সমর্থন ও বলবৎ করে। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ মেনে ভারতের বহু রাজ্যে ওবিসি সংরক্ষণ চালু হয়, কিন্তু তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে যে কমিটি গঠন করে, তা রাজ্য সরকারকে প্রস্তাব দেয় যে “জাতি বা কাস্ট বাদ দিয়ে দারিদ্র ও নিম্নমানের জীবন যাপনকেই একমাত্র ব্যাকওয়ার্ডনেসের মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা হোক।” এ ছাড়া এই কমিটি সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভাবে বিরোধিতা করে। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারও এই কমিটির প্রস্তাবকে পরিপূর্ণ ভাবে সমর্থন দেয়। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের সিংহভাগ মানুষ অনগ্রসর হলেও এই রাজ্যে ওবিসি সংরক্ষণ ছিল না। ফলে পশ্চিমবঙ্গের বহুজন মুসলমান বা অনগ্ৰসর মুসলমান ও হিন্দু উভয়েই শিক্ষা, কর্মসংস্থান থেকে কাঠামোগত ভাবে বঞ্চিত ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যার হার ২৭% যার মধ্যে আনুমানিক ৮০%-এর বেশি অনগ্ৰসর বা নিম্নবর্ণের মানুষ।
২০০৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আদেশে বিচারপতি রাজিন্দার সাচারের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয় যা সাচার কমিটি নামে বহুলপরিচিত। ২০০৬ সালে সাচার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্টে ভারতের মুসলমানদের আর্থসামাজিক, শিক্ষা, কর্মসংস্থানের হাল-হকিকত সরকারি তথ্য দিয়ে বর্ণনা করা হয়। সাচার রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের আর্থসামাজিক শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অবস্থা দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দলের সরকার থাকার পরও মুসলমানদের অবস্থা শোচনীয়।
বামেদের ২০০৮ সালে পঞ্চায়েতের খারাপ ফল, ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর, যখন দেখা যাচ্ছে যে গ্রামীণ মুসলমান ভোটে ধস নামছে সেই সময় ২০১০ সালে ৩৪ বছরের বাম শাসনের পতনের কিছু মাস আগে রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ওবিসি-এ ক্যাটেগরির জন্য ১০% ও ওবিসি-বি ক্যাটেগরির জন্য ৭% সংরক্ষণ চালু করে। ওবিসি-এ’কে প্রধানত অধিক অনগ্ৰসর ও ওবিসি-বি’কে অনগ্ৰসর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওবিসি-এ ক্যাটেগরির মধ্যে সিংহভাগই মুসলমান ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট (বর্তমানে ৮১টির মধ্যে ৫৬টি মুসলমান কাস্ট অন্তর্ভুক্ত) আর ওবিসি-বি ক্যাটেগরির মধ্যে মুসলমান কাস্টের সংখ্যা কম, এখানে সিংহভাগ কাস্ট হিন্দু অনগ্ৰসর শ্রেণির (বর্তমানে ৯৯টির মধ্যে ৪১টি মুসলমান অনগ্ৰসর শ্রেণির)। অতএব, ওবিসি-এ ও ওবিসি-বি মিলিয়ে মাত্র ১৭% যা ভারতে অন্যান্য রাজ্যে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ মেনে ২৭%, বেশ কিছু রাজ্যে ২৭%-এরও অধিক, তামিলনাড়ু তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার গঠনের পর বেশ কিছু জাতিকে অনগ্ৰসর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল, কিন্তু সংরক্ষণের পরিধিতে এক শতাংশও বৃদ্ধি করেনি। অর্থাৎ, গল্পটা এ রকম দাঁড়াল যে, কেকের পরিমাণ না বাড়িয়ে ভাগীদারদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, সেটাও আবার সঠিক ভাবে ১৯৯৩ সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল কমিশন ফর ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস অ্যাক্ট না মেনে। পশ্চিমবঙ্গের কোনও সরকার একটিও স্বাধীন (ও বৈজ্ঞানিক) ভাবে সমীক্ষা করায়নি। ওবিসি নিয়ে কোনও কমিটি বা কমিশনও গঠিত হয়নি।
সম্প্রতি আমরা শুনলাম কলকাতা হাই কোর্টের রায়। অতি-দক্ষিণপন্থী একটি সংগঠন বেশ কিছু বছর আগে ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে একটি মামলা দায়ের করেছিল। সেই মামলার ভিত্তিতে হাই কোর্ট রাজ্যে প্রায় লক্ষাধিক শংসাপত্র বাতিল বলে ঘোষণা করেছে। এই মামলা বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন, তারিখের পর তারিখ পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের রাজনৈতিক জাঁতাকলে নিম্নবর্ণের অনগ্ৰসর মুসলমানদের ওবিসি সংরক্ষণ এখন কঠিন প্রশ্নের মুখে। বিগত এক দশকে এই ওবিসি সংরক্ষণের ফলে পিছড়ে বর্গের মুসলমান ও হিন্দুদের কিছুটা হলেও শিক্ষায়, কর্মসংস্থানে সুযোগ পেয়ে একটি ছোট মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। ওবিসি সংরক্ষণের ফলে বহু প্রান্তিক অনগ্রসর শ্রেণির মুসলমান ছাত্র-ছাত্রী সুযোগ পাচ্ছে রাজ্যের ও রাজ্যের বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা ও গবেষণা করার জন্য। অথচ সেই ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়— যা বাংলার লক্ষ-লক্ষ অনগ্ৰসর শ্রেণির জনগোষ্ঠীর রুজি-রুটি, প্রতিনিধিত্ব ও সামাজিক ন্যায়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িত— তা নিয়ে আমরা কোনও আন্দোলন দেখতে পাচ্ছি না।
সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকার বেশ কিছু আইনজীবীকে দাঁড় করালেও আসল কাজ অর্থাৎ নিয়মমাফিক কোনও সার্ভে বা স্টাডি করানোর ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের আনা ওয়াকফ সংশোধনী বিল (২০২৪)-কে কেন্দ্র করে যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠিত হয়েছে এবং সারা দেশ জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে ধর্মীয় সংগঠন ও গোষ্ঠীগুলি এই রাজ্যে বহু বড় বড় সভা-সমাবেশ করছে বিলের বিরুদ্ধে। তারা জনমত গঠন করছে। অথচ ওবিসির মতো বিষয় নিয়ে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলির ভূমিকা হতাশাজনক। ওয়াকফ নিয়ে যে ভাবে মুসলমান ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির তৎপরতা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ওবিসি বিষয়ে কিন্তু তাদের কোনও হেলদোল নেই। আসলে, ওয়াকফ নিয়ে ধর্মীয় সংগঠনগুলি যে ভাবে আবেগকে কাজে লাগিয়ে জনরোষ গড়ে তুলেছে, সে ভাবে ওবিসি বা অনগ্ৰসর মুসলমানদের রুটি-রুজির ও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন নিয়ে ধর্মীয় নেতাদের সদিচ্ছা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
রাজনৈতিক দল-সহ ধর্মীয় সংগঠনগুলি মুসলমান সমাজকে নিছক একটিমাত্র একপরিচিতি-ভিত্তিক সমাজ হিসেবে দেখতে চায়, যার ভিত্তিতে নিজেদের স্বার্থ ও কৃতিত্ব ধরে রাখা সম্ভব। সাচার কমিটি সঠিক ভাবে উল্লেখ করেছিল যে মুসলমান সমাজের মধ্যে অনেকগুলি আর্থসামাজিক স্তর আছে, যার মধ্যে জাতি বা কাস্টের ধারণা নৃতাত্ত্বিক ভাবে জড়িত। তাই আশরাফ, আজলাফ ও আরজালের মতো সোশিয়োলজিক্যাল ক্যাটেগরি মুসলমান সমাজের মধ্যে বিরাজমান। এই বিষয়গুলি ধর্মীয় সংগঠন বা রাজনৈতিক দলগুলি কেউই আলোচনায় আনতে চায় না। এরা চায় ওবিসি সম্প্রদায় নিছক একটি গোষ্ঠী হয়ে থাকুক, যারা সরকারকে প্রশ্ন করবে না, সম্পূর্ণ আনুগত্যের মধ্যে দিয়ে কেবল ভোট দিয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলির লেঠেল বাহিনী হয়ে থাকবে আর সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন করলেই বলা হবে, এই চুপ, ফ্যাসিবাদ এসে যাবে। প্রকৃত অর্থে, ওবিসি বিষয় নিয়ে যদি সমাধানের সূত্র বার করতে হয়, তা হলে সকলের উচিত হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে সামাজিক ন্যায়ের কাঠামোর ভিতর থেকে সমাধানের রাস্তা খুঁজে দেখা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়