এ দেশে এখন অনেকেই হিন্দি ভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। হিন্দি ভাষাকে অন্য ভারতীয় ভাষার জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার প্রয়াস ইতিউতি চোখে পড়ে। ভারতীয় রেলের স্টেশনে ঝোলানো রিজ়ার্ভেশন চার্ট যদিও এখন খুব কম লোকই দেখেন, তবু সেখানে আগে হিন্দির সঙ্গে ইংরেজি থাকত, এখন বহু জায়গায় ইংরেজি বিদায় নিয়েছে, শুধু হিন্দি মাথা তুলেছে। কেবল হিন্দিকে অন্য ভাষার জায়গা দেওয়া হচ্ছে তা-ই নয়, হিন্দির ভিতরে যে নানা রকম ভেদাভেদ তা-ও মুছে ফেলে হিন্দির একটা বিশেষ রূপকেই সর্বমান্য করে তোলার চেষ্টা চোখে পড়ছে। যাঁরা এই হিন্দিপন্থী তাঁরা বলবেন এতে দেশের উপকারই হবে, এ ভাবেই একতা ও সমৃদ্ধি সম্ভব। একতাই বল।
কথাটা পুরনো। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঊনবিংশ শতকে এ ভাবেই ভেবেছিলেন। তবে রবীন্দ্রনাথ তো আগমার্কা মতলববাজ সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। নিজের ভাবনায় আটকে থাকার দায় তাঁর নেই। দেশের হিত কী ভাবে হবে সেটাই রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য। নিজের ভাবনাকে বদলাতে তিনি দ্বিধা করেননি। রবীন্দ্র-ভাবনার ক্রম পরিবর্তন খেয়াল করলে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথ নিজের যুক্তির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন— একের আধিপত্যবাদের ‘মডেল’ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল। একের ছাতার তলায় অপরের আত্মবলিদানের এই ‘মডেল’ তিনি পাশ্চাত্যের কাছ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন।
তাঁর মনে হয়েছিল, অসমিয়া ও ওড়িয়ারা যদি তাঁদের ভাষা ব্যবহার বন্ধ করে বাংলা ভাষার ছাতার তলায় নিজেদের সমর্পণ করেন, তা হলে সুবৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাষা ‘বাংলা’ হবে। একই ভাষার ঐক্যে জনগোষ্ঠীটি শক্তি ও সমৃদ্ধির শীর্ষে উপনীত হতে পারবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ (ভারতী, শ্রাবণ ১৩০৫) প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “উড়িষ্যা এবং আসামে বাংলাশিক্ষা যেরূপ সবেগে ব্যাপ্ত হইতেছিল, বাধা না পাইলে বাংলায় এই দুই উপবিভাগ ভাষার সামান্য অন্তরালটুকু ভাঙিয়া দিয়া একদিন একগৃহবর্তী হইতে পারিত।” লক্ষ করার বিষয়, অহমিয়া ও ওড়িয়াকে তিনি বাংলার ‘উপবিভাগ’ অর্থাৎ উপভাষা বলে সে দিন মনে করেছিলেন। বাংলা ভাষার বড় ঘরে অসমিয়া ও ওড়িয়াকে টেনে এনে তাদের অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার এই ‘রাবীন্দ্রিক’ ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন দুই সংস্কৃতির মানুষ সে-কালে মেনে নিতে পারেননি। মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না— কারণ অসমিয়া ও ওড়িয়া তো আদপেই বাংলার উপভাষা নয়। স্বতন্ত্র, স্বাধীন ভাষা হিসাবে এই দুই ভাষার মানুষের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল ও আছে। ইংরেজির মান্য রূপের তলায় কী ভাবে পার্শ্ববর্তী দ্বীপের মানুষেরা তাঁদের ভাষাভেদকে সমর্পণ করে শক্তিশালী ইংরেজ জাতি নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছিল, সেই উদাহরণ ভারতীয় পরিস্থিতিতে সে দিন প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। “ব্রিটিশ দ্বীপে স্কট্ল্যান্ড, আয়র্ল্যান্ড ও ওয়েল্সের স্থানীয় ভাষা ইংরেজি সাধুভাষা হইতে একেবারেই স্বতন্ত্র। তাহাদিগকে ইংরেজির উপভাষাও বলা যায় না। উক্ত ভাষাসকলের প্রাচীন সাহিত্যও স্বল্পবিস্তৃত নহে। কিন্তু ইংরেজের বল জয়ী হওয়ায় প্রবল ইংরেজিভাষাই ব্রিটিশ দ্বীপের সাধুভাষারূপে গণ্য হইয়াছে। এই ভাষার ঐক্যে ব্রিটিশজাতি যে-উন্নতি ও বললাভ করিয়াছে, ভাষা পৃথক থাকিলে তাহা কদাচ সম্ভবপর হইত না।” এই উদাহরণ যে ভারতবর্ষের পক্ষে উপযুক্ত নয় সে-কথা অবশ্য রবীন্দ্রনাথ পরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। নিজের এক সময়ের মতকে নিজের অস্তিত্ব বলে ভাবার মতো আত্মরতিময় তিনি ছিলেন না।
রবীন্দ্রনাথ যেমন অসমিয়া ও ওড়িয়াকে বাংলা ভাষার আওতায় নিয়ে এসে তাদের অস্তিত্বকে মুছে দিয়ে সংযোগ সাধন করতে চাইছিলেন, তেমনই বাংলা ভাষার মধ্যের যে নানা ভেদ সেগুলিকেও কি মুছে দিয়ে সংযোগ সাধন করতে হবে? সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতার মানুষের ব্যবহৃত মান্য ভাষারূপ সবাই ব্যবহার করেন না। অঞ্চলভেদে কলকাতার বাইরে বাংলা ভাষার নানা রূপ। সেই রূপগুলির অবস্থা কী হবে? এর একটা উত্তর হতে পারে— রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে ভাষা-বিচ্ছেদ দূর করার জন্য অসমিয়া আর ওড়িয়াকে ‘আত্মপরিচয়’ ত্যাগ করতে বলেছিলেন সে ভাবেই অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষার অন্য রূপগুলি নিজেদের পরিচয় মুছে ফেলুক। মান্য বাংলা ভাষাকেই গুরুত্ব দেওয়া হোক। এমন কথাই ভাবছিলেন বিবেকানন্দ। তাঁর একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “বাঙ্গালা দেশের স্থানে স্থানে রকমারি ভাষা, কোন্টি গ্রহণ করবো? প্রাকৃতিক নিয়মে যেটি বলবান্ হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে, সেইটিই নিতে হবে। অর্থাৎ কলকেতার ভাষা।” (উদ্বোধন, চৈত্র ১৩০৬) বিবেকানন্দের যুক্তির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যুক্তির মিল আছে, দুই যুক্তিই মুছে ফেলার যুক্তি। এটাও লক্ষ করার, দু’জনের এই অভিমত সময়ের বিচারে প্রায় সমকালীন।
বাংলা ভাষার এই ভেদগুলি মুছে না ফেলে যদি পরস্পরের সঙ্গে বিনিময়ের ও বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি করা যায়! রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ দু’জনেই ভদ্রলোক, ভাষা ও জ্ঞানের মান্য একটি রূপের কল্পনা করতেন তাঁরা, অনেক সময় মনে করতেন তাতেই সুবিধে হবে। ঐক্য বিধান রূপের একত্বেই সম্ভব। যাঁরা খেটে খান, নিজেদের শ্রমের বিশ্বে যাঁরা ‘আঞ্চলিক’ তাঁরাও কি তা-ই ভাবতেন? খেটে খাওয়া মানুষেরা শ্রম ও শ্রমের সঙ্গে যুক্ত ভাষার ভেদগুলিকে অঙ্গাঙ্গি ভাবে দেখেন। তাঁদের আঞ্চলিক শব্দ বাদ পড়লে, তাঁদের নিজস্ব শব্দের বদলে কেবল মান্য একটি রূপ গ্রহণ করলে শ্রমের পরিতৃপ্তি ও সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে পারে। কৃষক পত্রিকায় ১৩১৪ বঙ্গাব্দে কয়েক কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল ‘কৃষিবিষয়ক গ্রাম্যভাষা’ নামের একটি শব্দ সঙ্কলন। শব্দ মুছে ফেলার জন্য নয়, শব্দ বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এই প্রয়াস। কৃষি সম্বন্ধীয় শব্দের পারস্পরিক তুলনাই উদ্দেশ্য। যেমন জাঁতি (২৪ পরগনা), জাতি (ফরিদপুর), শর্তা (পাবনা)— একই শব্দের অঞ্চলভেদে রূপ আলাদা। জাঁতি আর জাতি উচ্চারণভেদ, শর্তা ভিন্ন শব্দ। পাবনার চাষিকে শর্তা ভুলে গিয়ে জাঁতি বলতেই হবে, এ দাবি করা হচ্ছে না।
স্বাধীনতার পরে যখন দেশ ভাগ হল, তখন পূর্ববঙ্গ থেকে যাঁরা কলকাতায় চলে এসেছিলেন তাঁরা ক্রমে কলকাতার প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতে শুরু করলেন। সে সময় শোভা ঘোষ যেন ভুলে না যাই বলে একটি পুস্তিকা সঙ্কলন করেছিলেন। ফেলে আসা গ্রাম ও অঞ্চলের বাংলা ‘যেন ভুলে না যান তাঁরা’, এই বাসনা থেকেই সেই পুস্তিকায় সঙ্কলিত হয়েছিল বাংলা ভাষার নানা ভেদের নমুনা।
কৃষক পত্রিকায় ‘কৃষিবিষয়ক গ্রাম্যভাষা’ নামের প্রবন্ধ প্রকাশের আগেই রবীন্দ্রনাথ নিজের ভাবনার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ (নবপর্যায় বঙ্গদর্শন, ভাদ্র ১৩০৯) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “সকলেই এক হইল বলিয়া আইন করিলেই এক হয় না। যাহারা এক হইবার নহে, তাহাদের মধ্যে সম্বন্ধস্থাপনের উপায় তাহাদিগকে পৃথক্ অধিকারের মধ্যে বিভক্ত করিয়া দেওয়া। পৃথককে বলপূর্ব্বক এক করিলে তাহারা একদিন বলপূর্ব্বক বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, সেই বিচ্ছেদের সময় প্রলয় ঘটে।” রবীন্দ্রনাথ এখানে যেন নিজেকেই সংশোধন করছেন। ১৩০৫-এ যা লিখেছিলেন, ১৩০৯-এ তা শুধরে নিয়েছেন। ইংল্যান্ডের ইতিহাসের উদাহরণ টেনে ‘ভাষা-বিচ্ছেদ’ প্রবন্ধে তিনি ভাষার পার্থক্যকে যথাযোগ্য স্থানে বিন্যস্ত না করে বলপূর্বক এক করতে চেয়েছিলেন। তাতে বিচ্ছেদের প্রলয় ঘটেছিল। ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ পরবর্তী কালের রচনা, সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঐক্যের যে মডেলের কথা বললেন সেই মডেলে পার্থক্যকে স্বীকার করা হচ্ছে, কিন্তু সেই পার্থক্যকে অসংযত ও উচ্চকিত করে তোলা হচ্ছে না। অর্থাৎ, ভাষার ক্ষেত্রে ‘জাঁতি’ ও ‘শর্তা’ দুই-ই থাকতে পারে।
তা পারে, কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। কোনটা কখন ব্যবহার করব? ভাষার ভেদকে মুছে ফেলতে বলা যেমন উচিত নয়, তেমনই ভাষা প্রয়োগের সময় ইচ্ছেমতো শব্দের ব্যবহার করে পার্থক্যকে অসংযত উচ্চকিত করে তোলাও অনুচিত। রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’-এ পার্থক্যকে যথাযোগ্য স্থানে বিন্যস্ত করতে চেয়েছিলেন। ভাষার ক্ষেত্রে পার্থক্যকে যথাযোগ্য স্থানে বিন্যস্ত করার উপায় ‘বিষয়ানুসারী ভাষা’ ব্যবহার। বিষয়ানুসারী ভাষা প্রয়োগের কথা ভেবেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। বিবেকানন্দ তা মান্য করেছিলেন। বিবেকানন্দ মোটেই ‘কলকেতার ভাষা’য় সব কিছু লেখেননি। তাঁর ইতিহাসকেন্দ্রিক রচনা ‘বর্ত্তমান ভারত’-এর বাংলা তৎসম প্রধান। আবার বিলাতযাত্রীর পত্র ও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নামক ভ্রমণবৃত্তান্তে কৌতুক করে দেদার কলকেতার ভাষা ফলিয়েছেন। মান্য বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লেখার সময় জাঁতি লেখাই উচিত, সৃজনশীল লেখায় শর্তা আসতে পারে, এমনকি বিশেষ অঞ্চলের কৃষকদের কোনও বৈজ্ঞানিক নির্দেশ দেওয়ার জন্য আঞ্চলিক ভাষাভেদ প্রয়োগে ক্ষতি নেই। বিষয়ানুসারী ভাষাতেই মুক্তি— রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ ভাষার ক্ষেত্রে একের আধিপত্য থেকে এ ভাবেই বেরিয়ে এসেছিলেন।
সমন্বয়ের এই যে উপায় রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তা ক্রমে উপলব্ধি করেছিলেন— পরের রবীন্দ্রনাথ আগের রবীন্দ্রনাথকে সংশোধন করছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে সংশোধন করতে পেরেছিলেন, কারণ তিনি ‘মতলববাজ’ ছিলেন না।