বিশ্বাস নয়, কৌশলের ভোট
Matuas

মতুয়াদের চোখে শুধু বিজেপি নয়, সব দলই কম-বেশি ব্রাহ্মণ্যবাদী

ধর্ম-সামাজিক আন্দোলন হিসেবে সৃষ্ট মতুয়া সম্প্রদায় আজও সামাজিক-ন্যায়ের প্রশ্নে সমান ভাবে ব্রাহ্মণ্য ও বৈদিক-পন্থার বিরোধী।

Advertisement

রজত রায়

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২১ ০৪:৪৯
Share:

২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে, একদল বিশ্লেষক দাবি করেন যে, বাংলার রাজনীতিতে বিজেপি এক ধরনের ‘সোশ্যাল এঞ্জিনিয়রিং’ করেছে, যার দরুন সমাজের পিছিয়ে পড়া জাতির মানুষেরা জোট বেঁধে বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন। ওই সব বিশ্লেষণে বিজেপিমুখী এই জনগোষ্ঠীর ভাবাদর্শকে বলা হল ‘সাব-অল্টার্ন হিন্দুত্ব’। উদাহরণ দেওয়া হল, নমশূদ্র-মতুয়া সম্প্রদায়, রাজবংশী, তিলি, গোয়ালা, বা বিভিন্ন উপজাতির মানুষদের। ২০২১-এর ভোটের আগে, এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় জুড়ে দেওয়া হল— প্রতিষ্ঠান-বিরোধী রাজনীতি। বলা হল, বিধানসভায় বিজেপির জয় নিশ্চিত— কারণ, এক দিকে আমজনতার ক্ষমতাশীল দলের প্রতি অসন্তুষ্টি; অন্য দিকে পিছিয়ে পড়া জাতির মানুষদের হিন্দুত্ববাদে আস্থা।

Advertisement

এই বিশ্লেষণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ভুল হতেই পারে। কিন্তু, ২ মে-র পর থেকে আবার একটা নতুন বিশ্লেষণ দেখতে পাচ্ছি— বাংলার সংস্কৃতি ধর্মনিরপেক্ষতার ধারক ও বাহক, আর তাই বাংলার মানুষ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে বর্জন করেছে। এবং, মানুষ ক্ষমতাশীল দলের জনকল্যাণনীতির প্রতি সন্তুষ্ট বলে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে।

তা হলে, সাব-অল্টার্ন হিন্দুরা কি তবে আবার সেকুলার হয়ে উঠল? প্রতিষ্ঠান-বিরোধী রাজনীতিটা হঠাৎ জনকল্যাণমুখীই বা হল কী করে? এখানে সমস্যা মূলত বিশ্লেষণের পদ্ধতির। অনেকেই সাময়িক প্রতিক্রিয়াকে ধ্রুবসত্য বলে মনে করেছেন, আর তাতে ‘রাজনীতির সক্রিয়তা’ বস্তুটি আলোচনা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

Advertisement

বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যাক মতুয়া সম্প্রদায়কে ‘সাব-অল্টার্ন হিন্দু’ করে দেখার মধ্যে দিয়ে। উনিশ শতকের শেষ দিকে মতুয়া আন্দোলনের সৃষ্টি অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলায়। প্রচারক ছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর। জাতপাতে বিভক্ত হিন্দু-বাঙালি সমাজে মতুয়া ধর্মদর্শন অনেকটা ধর্মান্দোলনের মতোই ছিল, যার মনন কর্তাভজা বা সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মেও কিছুটা পাওয়া যায়। উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ও সমাজ-সংস্কার প্রকল্প থেকে মতুয়া সমাজ আন্দোলনের মূল বিভেদ হল এই দুই ক্ষেত্রের প্রবক্তাদের সামাজিক অবস্থানের বিষয়টি। অস্পৃশ্য-সমাজ থেকে মতুয়া ভাবাদর্শ তৈরি হওয়ার কারণেই হয়তো, এর মধ্যে ছিল জাতপাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে এক নতুন সমাজ জীবন তৈরি করার অদম্য ইচ্ছা, যার ভিত্তি হল সাম্য এবং সর্বজনীন মানবতাবাদ। এই ধর্ম-দর্শনের অভিপ্রায় ছিল ভেদাভেদহীন সমাজব্যবস্থা, ও কর্মমুখী জীবনযাপন। অর্থাৎ, ত্যাগসর্বস্ব ধর্ম-ভক্তি নয়, পরিবার এবং সমাজ-কেন্দ্রিক কার্মিক জীবন— যে হরি-নাম এবং কাজ এক সঙ্গে করে। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন, এই ভাবাদর্শের কারণেই হরিচাঁদ-পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের সময়কালে অন্যান্য বহু জাতি যেমন তিলি, তাঁতি, মুচি, হাড়ি, এমনকি ব্রাহ্মণেরাও মতুয়া সম্প্রদায়ে যোগদান করেন, যদিও অধিকাংশ ভক্তই ছিলেন নমশূদ্র জাতের।

মতুয়া দর্শনকে অবলম্বন করে নমশূদ্র ও অন্যান্যদের জাতপাত-বিরোধী এই আন্দোলনের নিদর্শন স্বাধীনতার প্রাক্কাল পর্যন্ত দেখা যায়। যদিও বাংলা-ভাগের পর সমাজজীবন থেকে এই আন্দোলন যেন বিলীন হয়ে যায়। তার কারণ অবশ্য এটা নয় যে, বাঙালি জাতপাত পিছনে ছেড়ে এসেছে। এর প্রধান কারণগুলি হল, দেশভাগের ফলে অধিকাংশ মতুয়া ও নমশূদ্র মানুষ তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে থেকে যান। পশ্চিমবঙ্গে যাঁরা আসেন, তাঁরা আসেন উদ্বাস্তু হিসেবে। ফলত, সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নটি ঢাকা পড়ে যায় সর্বস্ব খুইয়ে শুরু করা উদ্বাস্তু-জীবনে। এ ছাড়া, রাজ্যের রাজনীতির পরিভাষা, রাজনৈতিক দলগুলির ভাবাদর্শ, এবং শাসকবর্গের কাছে জাতপাতের বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। আর তাই বাংলায় আলোচনার পরিসরে জাতপাতের বিষয়টি থেকেও নেই— জনসমক্ষে আমরা নিজ-নিজ জাত-প্রথা অনুসারে জীবনযাপন, রীতি-রেওয়াজ, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, বিয়ে, ধর্মানুষ্ঠান সব কিছুই সম্পন্ন করি, অথচ বলি জাতিভেদ নেই।

অবশ্য, এটা বলা ভুল হবে যে, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলায় জাতপাত-বিরোধী রাজনীতি নেই। তথাকথিত উচ্চবর্গ দ্বারা চালিত রাজনৈতিক দলগুলি যখন রাজনৈতিক তত্ত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষ ভাবাদর্শের নামে ধর্ম-জাত-বঞ্চনার বিষয়গুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তখন এই নিম্নবর্গের কিছু মানুষ কলম হাতে তুলেছেন— তৈরি করেছে এক স্বতন্ত্র সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিসর। এটাই বাংলা দলিত সাহিত্য ক্ষেত্র। ১৯৮০-র দশকে তৈরি হওয়া এই সাহিত্য আন্দোলন আজ কিছুটা হলেও স্বীকৃত।

প্রায় একই সময়ে শুরু হয় মতুয়া আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার এক প্রচেষ্টা। প্রমথরঞ্জন ঠাকুর গঠন করেন সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘ, যা আজকের দিনে বেশ জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তার পিছনে কয়েকটি কারণও রয়েছে— মতুয়া মহাসঙ্ঘের দৈনন্দিন কার্যক্রমে শুরু থেকেই রাজনৈতিক দলগুলি থেকে দূরত্ব বজায় রাখা হয়েছে; দ্বিতীয়ত, সময়ের সঙ্গে মহাসঙ্ঘের সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানো হয়েছে প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে মতুয়া দলকে জুড়ে দিয়ে। এর ফলে সংগঠনের বর্তমান সদস্যসংখ্যা বিপুল। তৃতীয়ত, সংগঠনের সর্বনিম্ন স্তরে থাকা এই সব দলের মাধ্যমে হরিচাঁদ এবং গুরুচাঁদ-এর সামাজিক-ধর্মীয় আদর্শ প্রচার করা ও ব্রাহ্মণ্য প্রথা বর্জন করে নিজেদের নতুন সামাজিক রীতি-রেওয়াজ পালন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মূল লক্ষ্য— নিপীড়িত-পতিত সমাজের মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করা ও সামাজিক মর্যাদা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। যদিও ২০০৯-এর পর থেকে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই সঙ্ঘবদ্ধ মতুয়াদের প্রতি ঝুঁকছে ভোটব্যাঙ্কের জন্য। ফলত, খোদ ঠাকুরবাড়িই এখন দু’ভাগে বিভক্ত, সঙ্গে মতুয়া সম্প্রদায়ও।

প্রশ্ন হল, বিশ্লেষকদের তৈরি সাব-অল্টার্ন হিন্দুত্ব কথাটা কি তবে ঠিক! মতুয়া কি তবে হিন্দি-হিন্দু-ধর্মের ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে? যাঁরা এত দিন ব্রাহ্মণ্যবাদের এবং মনুবাদের বিরুদ্ধাচারণ করে এসেছেন, তাঁরা কি হঠাৎ বদলে গেলেন?

বাস্তবে বিষয়টা অনেক জটিল। রাজ্যের বিভিন্ন জেলার বিজেপি-পন্থী মতুয়া নেতা এবং সমর্থকদের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে তিনটি মোটামুটি সমধর্মী উত্তর পাওয়া যায়। প্রথমত, সকলেই ভীষণ ভাবে ব্রাহ্মণ্য-পন্থা ও বৈদিক রীতিনীতির বিরোধী। এঁদের অনেকেই সম্পূর্ণ ভাবে মতুয়া-পন্থী, অর্থাৎ ধর্মীয়-সামাজিক ক্রিয়া-কর্মের দিক থেকে প্রচলিত হিন্দু প্রথা ত্যাগ করেছেন, এবং জাতপাতহীন মানব সমাজের কথা বলেন। এমনকি সংখ্যালঘু-প্রশ্নে জানতে চাইলে, অধিকাংশই জানান যে, বহু সংখ্যালঘু আজও মতুয়া আদর্শ মেনে চলেন। এবং মতুয়াদের প্রধান লড়াই ব্রাহ্মণ্যবাদী সামাজিক বিভেদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া, অনেকেই বিজেপিকে মনুবাদী বলেও মনে করেন, অনেকে আবার বিজেপিকে সংরক্ষণ-বিরোধী দলও বলেন। এ সব সত্ত্বেও তাঁরা বিজেপি-পন্থী, কারণ জাতপাতের প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দলই তাঁদের চোখে এক— সকলেই ব্রাহ্মণ্যবাদী। উদাহরণস্বরূপ তাঁরা বলেন, রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং দল নির্বিশেষে, এ রাজ্যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক সর্বদা উচ্চবর্গের হাতেই থেকেছে, আর ভাগ্যের শিকে ছিঁড়লে বা প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবে এক-আধ বার সামাজিক-ন্যায়ের মতো দফতর গিয়েছে নিম্নবর্গের বা জাতের হাতে। ফলত, সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলির নিষ্ক্রিয়তা মতুয়াদের গণতন্ত্র নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি উদাসীন করে তুলেছে। যে হেতু সামাজিক ন্যায় এঁদের কাছে মূল লক্ষ্য, তাই রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক মূলত ‘ট্যাকটিক্যাল’— কৌশলগত— যেমন জমি-বণ্টনের প্রশ্নে বামপন্থীদের সমর্থন, পরে পরিচিতিভিত্তিক রাজনীতির কারণে তৃণমূলকে, এবং এখন নাগরিকত্ব-প্রসঙ্গে বিজেপিকে সমর্থন।

দ্বিতীয়ত, এঁদের সকলের কাছেই, সামাজিক ন্যায়ের বর্তমান নাম হল নাগরিকত্ব আদায় করা। আগেই বলেছি, অধিকাংশ মতুয়াই উদ্বাস্তু, এবং সম্পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা এঁদের কাছে সমাজে স্বীকৃত হওয়ারই তুল্য। কারণ, উদ্বাস্তু হওয়ার দরুন এঁরা প্রত্যহ সমাজ, সরকারি সংস্থা, আমলা-প্রশাসন, পঞ্চায়েত, পুলিশ— বিভিন্ন ক্ষেত্রে হেনস্থার শিকার হন, তা সে কাস্ট সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট, সরকারি অনুদান, বা সামজিক স্বীকৃতি, যে প্রশ্নেই হোক। অতএব, নিঃশর্ত নাগরিকত্ব তাঁদের কাছে একটা কৌশলগত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং এর সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের সম্পর্ক নেই।

তৃতীয়ত, উপরের দু’ধরনের উত্তরই আমি মূলত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের থেকে পেয়েছি। তবে বহু মতুয়া-সমর্থকই তাঁদের রাজনৈতিক দল নির্ধারণ করেন ঠাকুরবাড়ির দলপতি (সঙ্ঘাধিপতি) কে, তার আধারে— অনেকটা ভক্তি-আনুগত্যের বশবর্তী হয়ে। যে হেতু ঠাকুরবাড়ি বর্তমানে দু’ভাগে বিভক্ত, এবং একই নামের দু’টি সংগঠন সমান্তরাল ভাবে চলছে, তাই ভোটেও ভাগাভাগি হয়েছে। তবে, সমাজে আরও একদল মতুয়া রয়েছেন, যাঁরা ধর্ম, শিক্ষা এবং সমাজ আন্দোলনের প্রশ্নেই নিয়োজিত, এবং রাজনীতির প্রসঙ্গে তাঁরা মন্তব্য করতে চান না।

আমার ক্ষেত্রসমীক্ষা বলছে, ধর্ম-সামাজিক আন্দোলন হিসেবে সৃষ্ট মতুয়া সম্প্রদায় আজও সামাজিক-ন্যায়ের প্রশ্নে সমান ভাবে ব্রাহ্মণ্য ও বৈদিক-পন্থার বিরোধী; যে হেতু জাতপাতের প্রশ্নে তাঁদের চোখে ভারতীয় রাজনীতিতে সকলেই কম-বেশি ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’, তাই তাঁরা সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি সমান ভাবে উদাসীন; এবং সর্বোপরি কোন রাজনৈতিক দল নাগরিকত্ব প্রদান করতে পারে, এই প্রশ্নে কৌশলগত ভাবে তৃণমূল এবং বিজেপিতে বিভক্ত। এমন একটি সম্প্রদায়কে হিন্দুত্ববাদী বলে চিহ্নিত করলে গোড়ায় একটি মোক্ষম গলদ থেকে যাবে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement