গত ১০ ফেব্রুয়ারি এক আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বললেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় গরিব মানুষ। বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর জানালেন যে, এখনও অবধি ভারত দক্ষতার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলেছে; আর পরিবেশমন্ত্রী জাভড়েকর দাবি করলেন, মোদীর নেতৃত্বে জলবায়ু পরিবর্তন সামলানোর ক্ষেত্রে ভারত নাকি সকল দেশের সেরা।
খবরটা পড়ে প্রায় দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিতে গিয়েই মনে পড়ে গেল প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার তিন দিন আগে উত্তরাখণ্ডে ঘটা বিপুল বিপর্যয়ের কথা। গত ৭ ফেব্রুয়ারি নন্দাদেবী হিমবাহ ভেঙে আসা জল, কাদা আর পাথরের স্রোতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত জোশীমঠ-সহ উত্তরাখণ্ডের একটি অংশ; মৃত পঞ্চাশের বেশি, নিরুদ্দেশ ১৭৫ জনেরও বেশি। অধিকাংশই গরিব মানুষ। লাগামছাড়া পরিবেশ আইনভঙ্গের পাশে জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ সামলাতে না পারাও (না কি না চাওয়াও) এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ।
এই বিপর্যয়ের বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার অন্যদের এমন মন্তব্যে যে দ্বিচারিতা, তার গোড়া লুকিয়ে আছে এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেটে। বাজেট পেশ করার প্রায় মাসখানেক আগে থেকেই প্রকাশিত একের পর এক আন্তর্জাতিক রিপোের্ট স্পষ্ট, গোটা পৃথিবী মাত্রাছাড়া উষ্ণায়নের পথে ও ভারত পৃথিবীর মধ্যে জলবায়ু বিপন্নতার তালিকায় একেবারে সামনের সারিতে। সামনের সারিতে বায়ুদূষণের তীব্রতাতেও। তবু বায়ুদূষণ কমানোর বাজেট এ বার প্রায় অর্ধেক। ২০২০ সালের বাজেট ভাষণে বার-পাঁচেক ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করলেও, এ বারের দুই ঘণ্টার ভাষণে এক বারও তা উচ্চারণ করেননি অর্থমন্ত্রী!
এ বারের বাজেটে পরিবেশ দফতরকে দেওয়া হয়েছে ২৮৭০ কোটি টাকা, আগের বারের তুলনায় প্রায় ৭.৫ শতাংশ কম! পাশাপাশি প্রায় ৩৫ লক্ষ কোটি টাকার বাজেটে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রয়োগের জন্য বরাদ্দ স্রেফ ৩০ কোটি! মনে পড়ছে শুধু পশ্চিমবঙ্গে ওই অ্যাকশন প্ল্যান প্রয়োগ করতে ৩৬০০০ কোটি টাকা লাগবে। পরিবেশ রক্ষার সঙ্গে পরোক্ষে যুক্ত যে বাজেট অনুদান, সেগুলিকে জুড়লেও হিসেব খুব একটা পাল্টাবে না।
কেউ বলতে পারেন, কোভিড-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির মোড় ঘোরানোটাই যেখানে আশু লক্ষ্য, সেখানে এমনটা স্বাভাবিক। সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করব, গত বছর বাজেটের সময় তো কোনও অতিমারি পৃথিবীতে ধাক্কা মারেনি, তবে কেন ২০২০-২১’এর বাজেটে জলবায়ু খাতে মাত্র ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল! আসলে এটা ‘মানি’ নয়, মানসিকতার প্রশ্ন। এই কোভিড-কালেই বাংলাদেশ সরকার কিন্তু ভারতীয় মুদ্রায় ২০০০০ কোটির উপর বরাদ্দ করেছে শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে লড়ার জন্য; মলদ্বীপের মতো ছোট দেশে প্রতিরক্ষার তুলনায় পরিবেশের বাজেট বেশি!
পাশাপাশি এ বারের বাজেটে ‘ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার’ খাতে অর্থবরাদ্দ প্রায় ৩৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, যার অধিকাংশই খরচ হবে রাস্তা, হাইওয়ে ও অন্যান্য বড় নির্মাণকার্যের জন্য। বিষয়টি উদ্বেগ তৈরি করে, কেননা পরিবেশ রক্ষার আইনি পরিকাঠামো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে এ দেশে।
প্রকৃতির প্রতিশোধের সংখ্যা ও তীব্রতা যেমন দ্রুত বাড়ছে, বাড়ছে তার জন্য খরচের ভারও। ২০১৩ সালের বন্যার পর উত্তরাখণ্ড কেন্দ্রের কাছে ১৩৮০০ কোটি টাকা চেয়েছিল; এ বারের প্রাথমিক হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ ১৫০০ কোটি। ২০২০ সালের আমপান সাইক্লোনে ক্ষতি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হিসেব অনুযায়ী এক লক্ষ কোটি টাকা, তার আগে ২০১৮ সালে কেরলে বিপর্যয়ের ক্ষতি ৪০,০০০ কোটি টাকা। তালিকা অন্তহীন। বাজেটে পরিবেশের ক্ষেত্রে ঠিকমতো অনুদান থাকলে, পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়মকানুনকে রাবার স্ট্যাম্প না বানালে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও কমত; কমত বিপর্যয় সামলানোর খরচও। ফলে পরিবেশ ভাবনা সরিয়েও এমন বাজেট যে অর্থনৈতিক দিক থেকে কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কোভিড অতিমারির পর বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বিপুল অর্থবরাদ্দ দেখে মনে হচ্ছে, একটা বিরাট প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে তবে কি মোদী সরকার পরিবেশকে সুয়োরানি করবে; পরিবেশকে মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে যে, সে এত দিন বাঁচিয়া ছিল? তবে কি উত্তরাখণ্ড বিপর্যয় কিছু দিন আগে হলে পরিবেশ ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ত?
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী মোদী ২০১১ সালে কনভেনিয়েন্ট অ্যাকশন বইতে লিখেছিলেন, “আল গোর যথার্থই বলেছিলেন যে, বিশ্ব উষ্ণায়নের কঠিন সত্যিটা অনেক নেতার পক্ষেই শোনা, সামনাসামনি করা ও মেনে নেওয়া অস্বস্তিকর... নেতৃত্বের আসল পরীক্ষা হল এই সত্যিকে স্বাগত জানিয়ে এমন এক স্ট্র্যাটেজির পরিকল্পনা ও প্রয়োগ করা, যার ফলে সুনির্দিষ্ট, সঠিক ও সময়মাফিক ‘কনভেনিয়েন্ট অ্যাকশন’ হতে পারে।” প্রধানমন্ত্রী মোদী ধুলো ঝেড়ে আর এক বার নিজের লেখা বইটি পড়ে দেখতে পারেন, সহকর্মীদেরও পড়তে বলতে পারেন; ভাল বই খারাপ হবে না।