flood

বাড়বে খরা, সঙ্গে অতিবৃষ্টিও

উষ্ণতার সঙ্গে বাড়ছে আর্দ্রতাও। তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়বে এক থেকে তিন শতাংশ।

Advertisement

অদিতি মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৭:১৮
Share:

অতিরিক্ত বর্ষণ, অত্যন্ত গরম, তীব্র ঠান্ডা— প্রাকৃতিক দুর্যোগ আজকাল যেন চরম রূপ নিচ্ছে। এ বছর গ্রীষ্মে আমরা ভয়ানক বন্যার ছবি দেখেছি জার্মানি, চিন, ভারত-সহ নানা দেশে। গত বছর আরও ভয়ঙ্কর বন্যা হয়েছিল পূর্ব আফ্রিকায়। বিপুল সংখ্যক মানুষ জলের সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে নিজের জীবনে পরিবেশের চরম দুর্যোগের প্রভাব টের পাচ্ছেন, কারণ পরিবর্তনের প্রকাশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হচ্ছে জলকে জড়িয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব খতিয়ে দেখা, এবং উপযুক্ত সংশোধনী ব্যবস্থার সুপারিশের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ তৈরি হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। গত ৯ অগস্ট আইপিসিসি তার ষষ্ঠ মূল্যায়ন রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ওই নথিটির থেকে কিছু জরুরি সূত্র মেলে।

Advertisement

এক, এই রিপোর্ট ফের প্রতিষ্ঠা করল যে, মানুষের কার্যকলাপের জন্যই উষ্ণায়ন হচ্ছে। কার্বন এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হচ্ছে এত বেশি পরিমাণে যে, তা তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে, ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। বর্তমানে ভূপৃষ্ঠের যা উষ্ণতা, তা শিল্পবিপ্লবের পূর্বের বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতার চেয়ে ১.০৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেশি। এর মধ্যে মানুষের অবদান ১.০৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, বাকিটা প্রাকৃতিক কারণে। মহাসাগরের চেয়ে মহাদেশগুলির স্থলভাগে তাপমাত্রা বেশি বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের উপর তার প্রভাব এখনই বেশ স্পষ্ট, উত্তাপ যত বাড়বে তা আরও প্রকট হবে।

দুই, উষ্ণতার সঙ্গে বাড়ছে আর্দ্রতাও। তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়বে এক থেকে তিন শতাংশ। এর ফলে বৃষ্টির পরিমাণও বাড়বে, আরও ঘনঘন বৃষ্টি হবে।

Advertisement

তিন, জার্মানি বা চিনে আমরা সম্প্রতি যেমন প্রবল, তীব্র বর্ষণ দেখলাম, সারা বিশ্বেই তা বেড়েছে। আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার যে সব দেশে বহু দিনের পর্যবেক্ষণের তথ্য নথিবদ্ধ রয়েছে, সেখানে এই পরিবর্তন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। যে সব জায়গায় তা নেই, যেমন আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে, সেখানেও অতিবৃষ্টি বাড়ছে। প্রতি ডিগ্রি উষ্ণতাবৃদ্ধির ফলে বর্ষণের পরিমাণ ও তীব্রতা আরও বাড়বে।

চার, বার বার অতিমাত্রায় বৃষ্টি হওয়ার জন্য বন্যাও হবে বেশি। বন্যা তখনই হয় যখন নদী, নয়ানজুলি, বা মানুষের তৈরি খাল, নালা প্রভৃতি নিকাশিব্যবস্থার জল বইবার ক্ষমতাকে ছাপিয়ে যায় বৃষ্টির জল। ফলে প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি জমি বন্যার কবলে পড়বে।

পাঁচ, আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খরার প্রকোপও বাড়বে। উষ্ণতার জন্য জল আরও বেশি করে বাষ্প হবে, তাই মাটিতে জলের অংশ কমবে। বিশ্ব উষ্ণায়ন চার ডিগ্রিতে পৌঁছলে পৃথিবীর স্থলভাগের প্রায় অর্ধেক বারংবার তীব্র খরায় আক্রান্ত হবে। এমনকি উষ্ণতা যদি দেড় থেকে দুই ডিগ্রিতে স্থিতিশীল হয়ে যায়, তা হলেও দক্ষিণ এশিয়া, এবং আফ্রিকার একটা বড় অংশ— প্রধানত পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকা— খরাকবলিত হবে। এই সব অঞ্চলেই বিশ্বের দরিদ্র মানুষেরা সর্বাধিক সংখ্যায় থাকেন, এবং চাষের জন্য তাঁরা নির্ভর করেন বৃষ্টির উপর। তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং খরা পরিস্থিতির সঙ্গে দাবানলের আশঙ্কাও বাড়বে।

ছয়, বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে কোন চরম দুর্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঘটেছে, তা নির্দিষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে। ইদানীং আমরা যত চরম দুর্যোগ দেখেছি, প্রায় সব ক’টিই ঘটবার সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়েছিল জলবায়ু পরিবর্তন।

সাত, ভারতের বড় নদীগুলি প্রায় সবেরই উৎপত্তি হিমবাহ থেকে। তার মধ্যে রয়েছে হিন্দুকুশে উৎপন্ন দশটি প্রধান নদীও। সর্বত্রই হিমবাহ গলছে। এই রিপোর্ট বলছে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে হিমবাহগুলি যত বরফ হারিয়েছে, তার নজির অতীতে খুঁজে পাওয়া যায় না। উষ্ণতার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরও দ্রুত বরফ গলবে, যার ফলে নদীর প্রবাহে পরিবর্তন আসবে, জীবিকা নষ্ট হবে, শক্তির উৎপাদন ব্যাহত হবে। শেষে বলতে হয়, আমাদের কৃষিজমি ব্যবহার, খাদ্য উৎপাদনও ব্যাহত হবে। এখনই ভূগর্ভের জল তুলে ফেলায় দক্ষিণ এশিয়ার মতো জায়গায় জলের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। একই সঙ্গে অরণ্য ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে মাটির জল ধরে রাখার ক্ষমতা কমবে, জল গড়িয়ে গিয়ে নষ্ট হবে। নগরায়ণ এই সঙ্কটকে আরও মারাত্মক করবে।

এক কথায়, মানুষের কার্যকলাপের জন্য জলচক্রের প্রতিটি ধাপ আক্রান্ত হয়েছে। আর যে ভাবে আমরা জমি আর জল ব্যবহার করি, তা সেই প্রভাবকে আরও তীব্র করছে। ধনী দেশেও মানুষ বন্যা আর খরার মতো চরম দুর্যোগ ভোগ করছেন। এখন যে হারে গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে, তা বজায় থাকলে আমরা খুব সম্ভবত ২০৩০-এর দশকে দেড় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড-বিশ্বের দিকে এগিয়ে চলেছি। তখন তৃতীয় বিশ্বের ছোট চাষিদের উপর অনেক তীব্র হবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। অথচ, দরিদ্র দেশগুলি কার্বন নিঃসরণে সবচেয়ে কম ভূমিকা নিয়েছে, আর তাদের নয়া প্রযুক্তি গ্রহণ করা, বা চরম দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতাও কম। এই রিপোর্ট দরিদ্র দেশগুলির প্রতি সেই অন্যায়কে মনে করিয়ে দিচ্ছে। আর আহ্বান করছে উন্নয়নের এমন পথ গ্রহণ করতে, যা কার্বনের নিঃসরণ কমিয়ে বিশ্বকে সুরক্ষিত করবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement