সহাবস্থান: একই চত্বরের এক দিকে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির, অন্য দিকে জ্ঞানবাপী মসজিদ।
দুর্ভাগ্য আমাদেরই। নরেন্দ্র মোদীর জমানায় সাতটা বছর কাটিয়ে ফেলার পরেও, স্বাধীনতার চুয়াত্তর বছরে চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ভাবতে বসে সেই নেহরুর কথাই মনে পড়ছে।
স্বাধীনতার পর পরই গুজরাতের সোমনাথ মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন কংগ্রেস নেতা কানহাইয়ালাল মানেকলাল মুনশি, সঙ্গে বল্লভভাই পটেল। মহাত্মা গাঁধীর সম্মতিও মেলে, কেবল এ কাজে রাষ্ট্রীয় তহবিল ব্যবহারে নিষেধ করেন তিনি। কিন্তু মন্ত্রিসভার বৈঠকে মুনশিকে নেহরু বলেন, “আপনার সোমনাথ পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ আমার ভাল লাগেনি। এটা হিন্দু পুনরুত্থানবাদ।” প্রধানমন্ত্রীর মত অগ্রাহ্য করেই এগিয়েছিলেন মুনশি। মন্দির-মসজিদের চেনা বিতর্কের মতো না হলেও সোমনাথ চত্বর নিয়ে চাপা দ্বৈরথ ছিলই। সেখানে মাহমুদ গজনভি-র হাতে প্রাচীন মন্দিরটি ধ্বংস হওয়ার কাহিনি শোনা যেত। ১৯৫০-এ সেখানে যে অহিল্যাবাই মন্দির দাঁড়িয়ে ছিল, তা ভেঙে নতুন মন্দির তৈরির সময় চত্বরের মসজিদটিকে কয়েক কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ পর্যন্তও নেহরু কিছু বলেননি। কিন্তু ১৯৫৯-এ যখন তার উদ্বোধনে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদকে আমন্ত্রণ জানানো হল, তখন চিঠি লিখে তাঁকে না-যাওয়ার অনুরোধ জানালেন নেহরু। রামচন্দ্র গুহ লিখছেন, “প্রধানমন্ত্রী মনে করেছিলেন, সরকারি আধিকারিকদের কখনওই জনসমক্ষে ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা উচিত নয়।”
ইদানীং অযোধ্যার রামমন্দিরে ‘রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ’ বিতর্কে সোমনাথ-প্রসঙ্গ টেনেছে বিজেপি-আরএসএস— যদিও দুইয়ের তুলনাই হয় না। সোমনাথ নিয়ে সংসদে আইন পাশ হয়নি, নেতারা নিজেদের ‘হিন্দু’ প্রতিনিধি বলে দাবিও করেননি। সেখানে কখনও হিন্দু-মুসলমান সংঘাতও বাধেনি। তবে সবচেয়ে বড় কথা প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা। নরেন্দ্র মোদী শুধু রামমন্দিরের ভূমি পূজন অনুষ্ঠানে উপস্থিতই হননি, গিয়েছিলেন প্রায় এক রাজবেশে। মুকুট পরিহিত প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে ছিলেন একাধিক পুরোহিত এবং নাথ সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহন্ত যোগী আদিত্যনাথ। পবিত্র ধর্মাগ্নিকে সাক্ষী রেখে মন্ত্রোচ্চারণ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ ঘটনা সম্ভবত ধর্ম আর রাষ্ট্রকে জড়িয়ে ফেলার চেয়েও বেশি কিছু। প্রতীকগুলো দেখলেই বুঝব, রাষ্ট্রের এক ভিত্তি হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছে ধর্ম, প্রায় রাজতন্ত্রের ঢঙে। সুতরাং সোমনাথ আর অযোধ্যাকে মিলিয়ে দেওয়া কেবল সরলীকরণ নয়, রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক। নেহরু আমলের সুউচ্চ ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে একটা উদাহরণ কাজে লাগিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র, দুইয়ের নিরিখেই।
হিন্দুত্ববাদী একটা স্লোগানের কথা মনে পড়ছে: ‘অযোধ্যা-বাবরি সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা অব বাকি হ্যায়’! ১৬৬৯ নাগাদ বারাণসীতে বিশ্বেশ্বর মন্দির ভেঙে একটা জামা মসজিদ তৈরি করান মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। মন্দিরের প্রধান উপাসনার স্থলটি যদিও অক্ষত থাকে, তা মসজিদের অঙ্গন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বেঁচে যায় দক্ষিণ দেওয়ালের খিলান, তোরণ ও খোদাই, যা পরে কিবলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সংলগ্ন ইঁদারার নামে মসজিদের নাম হয় জ্ঞানবাপী। বিশ্বাসীরা বলেন, জ্যোতির্লিঙ্গটি সুশীতল রাখতে সেই কুয়ো নিজেই খনন করেছিলেন মহাদেব। পরে, অষ্টাদশ শতকে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির তৈরি করান মরাঠা রানি অহিল্যাবাই হোলকর। যদিও বিশ শতকে জ্যোতির্লিঙ্গ স্থাপনের আগে পর্যন্ত মসজিদের ভিতরে থাকা উপাসনা স্থলকেই বেশি পবিত্র বলে মনে করতেন বিশ্বাসীরা। শোনা যায়, উপাস্য দেবতাকে মোগলদের হাত থেকে বাঁচাতে জ্যোতির্লিঙ্গটি নিয়েই কুয়োয় ঝাঁপ দিয়েছিলেন পুরোহিত। এখনও মন্দিরের উত্তর দিকে আছে সেই কুয়ো। ওটাই দুই ধর্মস্থানের সীমানা। মথুরার গল্পও খুব আলাদা নয়। ১৬৭০ সালে ঔরঙ্গজেবের আমলেই ভাঙা পড়ে মথুরার কৃষ্ণমন্দির, সে জায়গায় তৈরি হয় ইদগা। বিশ শতকে বেশ কিছু ব্যবসায়ীর অর্থসহায়তায় কৃষ্ণ জন্মস্থান মন্দির চত্বর নির্মিত হয়। ইদগার পাঁচিলের গায়েই তৈরি হয় কেশবদেব মন্দির, কৃষ্ণের জন্মস্থান অনুমানে গর্ভগৃহ মন্দির এবং ভগবত ভবন। ১৯৮০-র দশক থেকেই এই ধরনের ধর্মীয় সৌধগুলি, যেখানে এক কালে মন্দির ছিল, পরে মসজিদ হয়েছে বলে কথিত, এবং এখন দুই-ই এক সঙ্গে বিরাজমান, সেগুলি ‘পুনর্দখল’-এর আহ্বান জানায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।
এই সব গল্প ভাল লাগে না। বড় সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থের কিস্সা। কিন্তু রাজনীতি সরিয়ে রেখে এই কাহিনিগুলোই যদি আধুনিক সমাজের নিরিখে আর এক বার পড়া যায়, তা হলে বোধ হয় ভেদাভেদ পেরিয়ে ভালবাসার খোঁজ পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কাশী ও মথুরার মন্দির-মসজিদ চত্বরে একাধিক বার যাওয়ার সূত্রে জানি, হিন্দু বা মুসলিম কারও ভিতরেই ভাগ করে নেওয়া ধর্মক্ষেত্র নিয়ে তেমন অসূয়া নেই। সংখ্যাগুরুর গুমর নিশ্চয়ই আছে। কৃষ্ণমন্দিরের প্রাণবন্ত পরিবেশের পাশে ঝিমোয় শাহি ইদগা। এক দিকে ভক্তের ভিড়, বিপুল উদ্যোগ, পুলিশি তৎপরতা, পৌঁছনোর সহজ ব্যবস্থা, অন্য দিকে ইদগার প্রবেশ পথটুকুও বাতলাতে পারেন না স্থানীয়রা। অনেক খুঁজে রেল লাইন পেরিয়ে, আঁস্তাকুড় ডিঙিয়ে পৌঁছনো যায় সেখানে। কয়েক জনের দেখা মেলে। তাঁরাও স্থাপত্যের মতোই ভাঙাচোরা, ম্রিয়মাণ, বিষণ্ণ। তবু কেউ অন্যের সৌধের দিকে আঙুল তোলেন না, অভিযোগ করেন না। সংখ্যাগুরুরাও না। হিংসাত্মক মনোভাবের তো প্রশ্নই নেই। জ্ঞানবাপী মসজিদে অবশ্য অনেক আগেই জনতার প্রবেশাধিকার বন্ধ হয়েছে। শুনেছি, মন্দিরে পুজো দিতে গেলে নাকি মসজিদটা ভাল করে দেখা যায়। সত্যি বলতে কী, হনুমানদের দেখে হিংসেই হচ্ছিল। কেমন জ্ঞানবাপী থেকে বিশ্বনাথ মন্দিরে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে, ইচ্ছে হলেই ফিরে আসছে! সেখানেই জেনেছিলাম, ১৯৯৬ সালের মহাশিবরাত্রিতে এক জমায়েতের ডাক দিয়েছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, স্থানীয়রা প্রায় সাড়াই দেননি।
বিভেদকামী রাজনীতির উচ্চগ্রামের কণ্ঠস্বরের মতোই সামাজিক সম্প্রীতির সুরটিও ভারতের ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে বহমান। ঋগ্বেদে শ্লোক পাই: ‘একম্ সৎ বিপ্রা বহুধা বদন্তি’; অর্থাৎ, সত্য একটিই, মহাজনে তা বহু নামে প্রকাশ করেন। দ্বাদশ অনুশাসনে সম্রাট অশোক বলেন: “অতিভক্তির বশে যিনি নিজধর্মের প্রশংসা করেন, এবং ‘আমার ধর্ম মহান’ বলে পরধর্মের নিন্দা করেন, তিনি নিজের ধর্মেরই ক্ষতি করেন। ধর্মে ধর্মে যোগ জরুরি।” মধ্যযুগ থেকেই সুফি দরগা অজমের শরিফে প্রার্থনা জানান সব ধর্মের মানুষ। শির্ডীর সাঁই বাবা হিন্দুদের রাম নবমী আর মুসলিমদের উরস এক সঙ্গে উদ্যাপনের আয়োজন করতেন। লোকমান্য টিলক আয়োজিত গণেশ চতুর্থীর বিসর্জনে ঢোল বাজাতেন মুসলিমরা। এই ভারতকে চিনেছিলেন নেহরু। আমাদের দেশকে প্রাচীন পুঁথির সঙ্গে তুলনা করেন দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া-তে। তাঁর ভাবনায়, এই ভূমিতে চিন্তা আর স্বপ্ন লেখা হয় স্তরে স্তরে, আগের স্তরটিও মুছে যায় না। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের কাঠামোকেও জন্মলগ্নে সেই সুরে বাঁধতে চেয়েছিলেন। সংখ্যাগুরুর অস্তিত্ব যাতে সংখ্যাগুরুবাদকে আঁকড়ে না ধরে, সে ব্যাপারে অতি সতর্ক ছিলেন। তিনি মনে করতেন, এ দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপদ বোধ করানোর দায়িত্ব কংগ্রেসের ও সরকারের। ভারত ভাগ্যবান, যে আধুনিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কালে দেশের রাশ তাঁর হাতে এসে পড়েছিল। সুবিচার এবং গণপরিসরে যুক্তির রাজনৈতিক মূল্যবোধকে নাগরিক আগ্রহের ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন দার্শনিক জন রলস। নাগরিকের আগ্রহ মানে তো দেশের আগ্রহ, সকলের হিতাকাঙ্ক্ষা। তাই না?
আক্ষেপের কথা, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তির প্রাক্কালে শাসক হিসেবে আমরা যাঁদের পেয়েছি, তাঁদের চিন্তাপথ এই আধুনিক ভাবনার পরিপন্থী। তাঁদের হাত ধরে ক্রমশ চওড়া হচ্ছে প্রতিবেশীকে পৃথক পরিচিতিতে দাগিয়ে দেওয়ার অভ্যেস। তাই আধুনিক সমাজ তৈরির আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছে, এমন কথা জোর গলায় বলতে পারছি না। আশাটুকু রাখছি, কাশী-মথুরার ঐতিহ্যে ভর করে।