এই দ্যাখ, হাজার চুরাশির মা!” হাসতে হাসতে রংচটা পাসবইটা পাশের সহকর্মীর হাতে তুলে দিলেন বড়বাবু। ব্যাঙ্কের জমাখরচের বইয়ের ভিতরে মোট সঞ্চয় লেখা রয়েছে— ১০৮৪ টাকা। যার চুরাশি টাকাই সুদ। হাসপাতালে সন্তানের জন্ম দেওয়ার সরকারি পুরস্কারের অর্থ (১৪০০ টাকা) থেকে আগলে রাখা টাকা। লাইনে দাঁড়ানো মহিলা বলে উঠলেন, “মেয়েটা নেই, এটাই আছে।” হাওয়ায় পৃষ্ঠা উল্টে যায়। টেবিলে পড়ে থাকে এক অলৌকিক পাসবই। দীর্ঘ দশ বছরেও যেখানে জমা পড়েনি কানাকড়ি। শুধু ছোট ছোট অঙ্কের টাকা তোলার বর্ণনা ছাপা হয়েছে পাতায় পাতায়। এক-একটা সংখ্যা যেন এক-একটা বিপন্নতার খতিয়ান।
“লক্ষ্মীর কৃপায় সকলের দুঃখ চলি যায়, কমলার কৃপা সকলের ওপর বর্ষায়।” চৌকাঠের মাথায় লেখা লাইনগুলো। তার তলাতেই বসেছে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের নাম লেখানোর শিবির। প্রকল্পের সৌজন্যে দশ বছর পরে ফের কিছু জমা হতে চলেছে পারুলের পাসবইয়ে। আগে টিপছাপ দিতেন। সরকারি ঘোষণার পর লজ্জায় রাত জেগে নিজের নাম লিখতে শিখেছেন। “ইজ্জত সবার আছে বাবু।” পারুলের নাম তুলে বাবু হাঁক দিলেন— নেক্সট।
এ বার যিনি উল্টো দিক থেকে ফর্ম এগিয়ে দিলেন, তাঁর ‘ব্যাঙ্ক ডিটেলস’-এর ঘরটাই ফাঁকা। পাসবই কই? প্রশ্ন শুনে মহিলা এগিয়ে দিলেন মাধ্যমিক পাশের মার্কশিট। মেয়ে পাশ করেছে, তাই ওটাই ওঁর কাছে ‘পাসবই’। ফর্ম জমা হবে না শুনে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন জাগরী বাস্কে। এই প্রথম কোনও সরকারি সাহায্যের দরজায় নিজে এসেছেন। এত দিন যা জুটেছিল সবটাই বর লুটেপুটে খেয়েছে। আর না। নিজেই এসেছেন লক্ষ্মীর ভান্ডারে লাইন দিতে। জাগরীরা জাগছেন, কিন্তু বড্ড ফাঁক থেকে যাচ্ছে তাঁদের চেনাজানায়।
এগিয়ে এলেন খুশি বর্মন। সিলিং ফ্যানের দিকে দৃষ্টি। অনেক অনুরোধে মাথা নামিয়ে ফর্মে টিপছাপ দিলেন। ঠিকানা লিখতে গিয়ে প্রকাশ পেল, গাছতলাই তাঁর বেডরুম। প্রধান সাহেবকে বলে-কয়ে গত বার ওই গাছতলার ঠিকানাতেই ভোটার তালিকায় নাম তুলে দিয়েছেন। ব্যাঙ্কের পাসবই করে নিয়েছেন। টাকাটা পেলে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা রোজ রান্না করা খাবার পৌঁছে দেবেন বলেছেন। ফর্ম জমা করেই ‘খুশি পাগলি’ ভিড়ে মিশে যান। আর দেখা যায় না তাঁকে।
লাইনের পরের জন চেনামুখ। লাইনে দাঁড়িয়ে মুখ আড়াল করছেন বার বার। পাড়াপড়শি চার পাশে। বর রেশন ডিলার। সন্তান প্রসব করতে পারেননি বলে শরীর জুড়ে তাবিজের অলঙ্কার। আন্দাজ হয়, রঙিন কাপড় জড়ানো দেহে কালশিটেও আছে। অপর্ণা রবিদাস নিচু স্বরে বললেন, টাকাটা পেলে বাপের বাড়ি পাঠাবেন। বিয়েতে জমিজমা, সোনাগয়না সবটুকু দিয়ে ফেলেছেন বাবা। মেয়েরও তো কিছু কর্তব্য থাকে। তাই লাইন দিয়েছেন। এ ভাবেই লক্ষ্মী মেয়েদের ভিড় বাড়ে সরকারি শিবিরে।
লক্ষ্মী আসেন নিঝুম কোজাগরী রাতে। সরকারি শিবিরে চাঁদ ভেঙে যায় বার বার। বাইরে থেকে আসে শোরগোল, তুমুল চিৎকার। “স্যর, সব অলক্ষ্মী। এক একটা জাত ক্রিমিনাল। পুলিশ ডাকুন।” গেটের গার্ড সাবধান করে দিয়ে যায়। এসে দাঁড়ায় এক দল, যাঁরা সমাজের মতে লক্ষ্মীছাড়া। মেয়ের মতোই, তবু মেয়ে নয়। ভরদুপুরেও ঘরটাকে আদালতের এজলাস মনে হয়। নির্বাক চলচ্চিত্রের চরিত্র হয়ে যান বড়বাবু। কোন গহ্বরে মিলিয়ে যেতে থাকে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল সার্ভিস রুল’। তিনটি চেয়ারের সামনে জেগে থাকে সাতজোড়া ফাঁকা ফর্ম। “আমরা মেয়ের মতো বড়বাবু। ভাল করে দেখুন, প্লিজ়।” কথাগুলো ঘরের ধুলোর মতো করুণার আকুতি হয়ে উড়তে থাকে।
এন্ট্রি হয় না। খালি হাতে বাড়ি ফেরেন ক’জন, যাঁরা মেয়ে হতে চেয়েছিলেন। সরকারি কর্মীদের জন্য টিফিন আসে। খুশি পাগলি হঠাৎ উদয় হন। আমাদের টিফিন নেই বড়বাবু? গার্ড হাত ধরে বাইরে টেনে নিয়ে যান। তাড়ানো সহজ, ভোলা কঠিন। খুশিরা ভিড়ে হারিয়ে গিয়েও মনের মধ্যে উঁকি দেন।
ফের কাজ শুরু হতে এগিয়ে আসেন তীব্রতা। তীব্রতা মুর্মু। বাবা কমিউনিস্ট মুর্মু। মাসে হাজার টাকা পাওয়ার কথা, কিন্তু জনজাতি সংরক্ষণের কাগজ দেখাতে হবে। বড়বাবুকে তীব্রতা কোনও কাগজ দেখাতে পারেননি। মুখ দেখাতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন? “সব ছিল স্যর। এইচএস-এর পর চাকরি দেবে বলেছিল। হাওড়া থেকে ট্রেন। তার পর সব অন্ধকার। পালানোর সময় ফাইলের কথা আর মনে ছিল না। শুধু ভোটের কার্ডটা বুকের ভিতর এনেছিলাম। হবে স্যর?” সরকারি অফিসের প্রতিটি চেয়ার আদালতের মতো। সেখানে আবেগ, যুক্তি, ন্যায্যতা, সবই আইন আর বিধিনিয়মের ‘রুলবুক’-এর কাছে চিরকাল হেরে যায়। মুখ ঘুরিয়ে ফিরে যায় তীব্রতা। পিছনে পড়ে থাকে একটা দরজা, একটা ঘর আর কিছু মানুষ। না কি, আস্ত ভারতটাকেই খারিজ করে গেলেন ওই জনজাতিকন্যা? চেয়ার ছেড়ে বাইরে আসেন বড়বাবু। নেট অন করতেই ইনবক্সে মেসেজ ঢোকে— “আমার ফর্মটা পাশ করে দিয়েন স্যর। যা লাগে দেব।”