বাংলা লিপির পরিবর্তে মণিপুরের প্রাচীন এই লিপির ব্যবহার শুরু করেছে।
এত দিনে মণিপুরের আঞ্চলিক সংবাদপত্রগুলো বাংলা লিপির বদলে ব্যবহার করতে পারছে মেতেয়ি লিপি। ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, সাতটা মণিপুরি সংবাদ দৈনিক, ন’টা সান্ধ্য দৈনিক ও চারটে মাসিক পত্রিকা বাংলা লিপির পরিবর্তে মণিপুরের প্রাচীন এই লিপির ব্যবহার শুরু করেছে। এই সিদ্ধান্ত মণিপুরি ভাষা আন্দোলনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। দেশ স্বাধীন হলেও ভাষা ও লিপির স্বীকৃতি পেতে লড়াই চলেছে দীর্ঘ দিন। ১৯৯২ সালে সংবিধানের ৩৪৪/১১ এবং ৩৫১ ধারার অষ্টম তফসিলে যে ২২টি ভাষাকে ভারতীয় ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, মেতেয়ি ছিল তার অন্যতম। তবুও কেন এত দীর্ঘ লড়াই? ঠিক কোন সময় থেকে মেতেয়ির পরিবর্তে বাংলা হয়ে উঠল এই জনগোষ্ঠীর প্রধান লিপি— তা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের কাছাকাছি এক সময়ে।
সময়টা ১৭১০। ঔরঙ্গজেব-পুত্র প্রথম বাহাদুর শাহ তখন দিল্লির মসনদে। বাংলা তখন মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম লাভজনক সুবা। মুর্শিদকুলি খাঁ তখনও বাংলার নবাব হননি, দেওয়ান হিসেবেই নিযুক্ত। বাংলা শাসন করছেন ঔরঙ্গজেবের নাতি প্রথম শাহ আলমের পুত্র আজিম উস শান। অন্য দিকে, বর্মায় আরাকানদের আধিপত্য। মোগলদের সঙ্গে পেরে না উঠলেও তাদের প্রতাপ কিছু কম নয়। এরই মধ্যে চোখে পড়ে ছোট্ট এক দেশ, স্থানীয় ভাষায় যার নাম কাংলইপাক বা মেতেয়ি। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনো এই ভাষার আদি উৎস চিনা তিব্বতি ভাষা। মেতেয়িরা ছিলেন সন্মাহি ধর্মাবলম্বী। পূর্বপুরুষের উপাসক এই ধর্মের সঙ্গে প্রাচীন চৈনিক ধর্মের মিল আছে। আঠারো শতকে প্রতিবেশী বর্মার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মেতেয়ি রাজা পেমহইবার কাছে তিনটে রাস্তা ছিল— এক, প্রতিবেশী ব্রহ্মদেশের মতো বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করা, যা প্রকারান্তরে বশ্যতা স্বীকারেরই নামান্তর হত। দুই, হিন্দুস্থানের মোগল বাদশাকে অনুসরণ করে ইসলামকে গ্রহণ করা— তাতে সমস্যা ছিল মূর্তি উপাসক সন্মাহিদের কাছে এই ধর্ম ততটাও গ্রহণযোগ্য হত না। তৃতীয়ত, হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করা। প্রতিবেশী অহম ও কাছাড়ে বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্মের জনপ্রিয়তার কারণে সন্মাহিদের কাছে এই ধর্ম একেবারে অজানা ছিল না। তাই মেতেয়ি জাতিকে এক ধর্ম, এক ভাষা, এক লিপিতে একত্রিত করতে পেমহইবা শ্রীহট্ট বা সিলেটের ব্রাহ্মণ শান্তিদাস অধিকারির কাছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নেন। মেতেয়ি জাতিকে বাধ্য করা হয় বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করতে। কথিত আছে, প্রাচীন সন্মাহি ধর্মের যাবতীয় স্মৃতি মুছে ফেলতে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় অসংখ্য প্রাচীন পুঁথি। ধর্মের অঙ্গ হিসেবে মেতেয়িদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় বাংলা লিপিও। লোকের মুখে মেতেয়ি ভাষা বেঁচে থাকলেও ব্যবহারের অভাবে এক সময় হারিয়ে যায় লিপিটি। এরই পাশাপাশি মেতেয়ি পুরাণ ও লোকগাথাকে মুছে ফেলে নতুন ভাবে হিন্দু ভাবধারায় লেখা হয় তাদের ইতিহাস। দেশের নাম কাংলইপাক বা মেতেয়ি থেকে হয়ে যায় মণিপুর। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে আমদানি হয় বাংলা ও সংস্কৃত শব্দের। পেমহইবার পৃষ্ঠপোষকতায় শান্তিদাস গোসাঁই রচনা করেন বিজয় পাঁচালি গ্রন্থ। এই বইয়ে তিনি দাবি করেন, ভারতের উত্তর-পূর্বের এই মণিপুরই মহাভারতে বর্ণিত, যেখানে বনবাসকালে অর্জুন আসেন ও মণিপুরের রাজা চন্দ্রভানুর কন্যা চিত্রাঙ্গদাকে বিয়ে করে জন্ম দেন বীর বভ্রুবাহনের। শান্তিদাস গোসাঁইয়ের মতে সেই বভ্রুবাহনই মেতেয়ি রাজাদের আদি পুরুষ। আঠারো শতকে তৈরি হওয়া এই ‘মিথ’-এর উপর নির্ভরশীল হয়েই উনিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ লেখেন নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা। ‘বিজয় চরিত’-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মণিপুরে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠা, আর্যাবর্তের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তাকে যুক্ত করা। এই ধর্মযুদ্ধের প্রধান হাতিয়ার বাংলা লিপি। সেই লিপির তরোয়ালের ধারে এক সময় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সুপ্রাচীন পার্বত্য যোদ্ধা মেতেয়ি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য। পরবর্তী কালে ইংরেজ আমলে বেশির ভাগ সরকারি কর্মচারী ছিলেন বাঙালি। কাজের সুবিধের জন্য তাঁরা বাংলা লিপিকেই বেছে নেন। বেশির ভাগ ছাপার কাজও হত কলকাতায়।
১৯৩০ সাল থেকে মণিপুরের মানুষ দাবি জানাতে থাকেন মেতেয়ি লিপি পুনরুদ্ধারের। কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানি বোমায় বিধ্বস্ত মণিপুরে বাঁচার লড়াই লড়তে গিয়ে হারিয়ে যায় ভাষার লড়াই। ভারত স্বাধীন হওয়ার প্রায় চল্লিশ বছর পর মেতেয়ি দেশের সংবিধানে ভারতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই আন্দোলনের হাত ধরেই ফিরে আসে এই লিপি। ২০০৬ থেকে তা প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে চালু হয়, ২০০৯ থেকে কম্পিউটার ইউনিকোডে তা চালু হয়। দীর্ঘ দিনের লড়াইয়ের পর এখন অবশেষে মূলস্রোতেও ফিরে এল এই লিপি।
আশ্চর্য, বাংলা ভাষার জন্য লড়াইকে শ্রদ্ধা জানাতে বিশ্ব জুড়ে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, অথচ এই বাংলা লিপিই অন্য এক সময় অন্য এক জাতিগোষ্ঠীর উপর হয়ে ওঠে ক্ষমতা প্রকাশের হাতিয়ার। আরও মজার ব্যাপার, মণিপুরি রাজা পেমহইবা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করলেও মোগল অনুগ্রহে থাকতে তিনি গ্রহণ করেছিলেন ফারসি উপাধি গরিব নিয়াজ। এই ঘটনা যেন আমাদের আরও বেশি করে বুঝিয়ে দেয়, ভারতীয় উপমহাদেশ কতটা বহুমাত্রিক ও বহুরৈখিক— প্রায় সব ধর্ম আর ভাষাই সেখানে কোনও না কোনও সময়ে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তাই যেন নিজের ভাষার কদরের পাশাপাশি দাবি রাখে অন্যের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতিও একই ভাবে শ্রদ্ধাশীল হওয়ার।