রাজপথে: সিএএ-এনআরসি-এনপিআর’এর বিরুদ্ধে দেশজোড়া প্রতিবাদ, ২০২০।
সংশয়ের জায়গা নেই, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর দেশের যে মানুষেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন, তাঁদের বড় একটি অংশ মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁদের এই প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক নয়। মুসলিমদের প্রতি বিজেপি ও আরএসএস-এর মনোভাব চিরকালই বিদ্বেষপূর্ণ। হিন্দু জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবক্তা এম এস গোলওয়ালকর ১৯৬০-এর দশকে প্রকাশিত বাঞ্চ অব থটস গ্রন্থে যে মুসলিম-বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন, সেই পথ থেকে কখনও সরে আসেনি আরএসএস-বিজেপি। আশির দশকের পর থেকে ভারতের রাজনীতিতে তাদের উত্থানের এক পিঠে রয়েছে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, অন্যটিতে মুসলিম-বিদ্বেষ। এই দুই অস্ত্রকে নিপুণ ভাবে ব্যবহার করে বহু নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
২০২৪-এর নির্বাচনেও, এর আগের দু’বারের লোকসভা ভোটের মতোই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে অস্ত্র করে ক্ষমতায় ফেরার পরিকল্পনা ছিল শাসক দলের। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী জনসভায় অভিযোগ করেছেন, দেশের বিরোধী দল ব্যক্তিগত সম্পত্তি, সোনা এমনকি মঙ্গলসূত্র পর্যন্ত মুসলমানদের দিয়ে দেবে। ‘সব কা সাথ সব কা বিকাস’-এর ঢক্কানিনাদ থেকে সরে এসে মুসলিমদের সম্পর্কে বলেছেন, তাঁরা বেশি বেশি সন্তান উৎপাদন করেন, এবং তাঁরা অনুপ্রবেশকারী। ভোটের ফল বেরোনোর পর দেখা গেল সংসদে বিরোধীদের উপস্থিতি বেশ খানিকটা বেড়েছে, আর তাতেই স্বস্তি বোধ করছেন ভারতীয় সংখ্যালঘু সমাজ।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রে সরকার গড়তে এ বার শরিকদের মুখাপেক্ষী। বিহারের নীতীশ কুমার এবং অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবু নায়ডু দু’জনই পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ, কিন্তু দু’জনের কেউই সরাসরি মুসলিম-বিদ্বেষের রাজনীতি করেন না। ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরাও আশা করছেন যে, এর ফলে নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপির পক্ষে মুসলিমবিরোধী কোনও সিদ্ধান্ত দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়া সহজ হবে না। আর তা ছাড়া কংগ্রেসের নেতৃত্বে উজ্জীবিত বিরোধী শক্তিও মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশ্চয়ই ভরসা জোগাবে।
কিন্তু সংশয়ের কাঁটাও খানিক রয়ে গেছে। মুসলিম-বিরোধিতার পথ থেকে বিজেপি সরে আসবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, সংখ্যাগুরু হিন্দুরা বিপদগ্রস্ত এবং মুসলিমরা দেশের প্রধান শত্রু— এই দুই ধারণার উপরেই তো দাঁড়িয়ে তাদের রাজনৈতিক পুঁজি। তাই ছলে বলে কৌশলে তারা যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবে সে সম্ভাবনা রয়েছে। সেই কাজে তাদের সহায়তা করার জন্য রয়েছে আরএসএস-এর অসংখ্য শাখা সংগঠন যারা শিরা-উপশিরার মতো দেশের সব প্রান্তে সক্রিয়।
দ্বিতীয়ত, লক্ষণীয়, দেশের অনেক বিরোধী দল ২০২৪-এর নির্বাচনে মুসলিম প্রার্থী কম দিয়েছে, প্রচারেও মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কিত বিষয়গুলি জোরালো ভাবে উত্থাপন করেনি। মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে চিহ্নিত হলে হিন্দু ভোট সবটুকু বিজেপির ঝুলিতে যাবে— এই আশঙ্কা থেকেই তাদের এই ‘কৌশলী’ নৈঃশব্দ্য। এই নৈঃশব্দ্য যে মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষে স্বস্তিদায়ক নয়, তা বলা বাহুল্য।
ফলে, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রাপ্তি ঠিক কতখানি এবং আগামী কয়েক বছর দেশের রাজনীতিতে তাঁদের অবস্থান ঠিক কী হতে চলেছে— পরস্পরসম্পর্কিত এই দুই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। এটা ঠিক যে দেশের মুসলিম সম্প্রদায় কোনও সমসত্ত্ব গোষ্ঠী নয় এবং ভোটবাক্সে তাঁরা সারা দেশ জুড়ে একই ভাবে মত দেন, এই ধারণাটিও ভুল। তবুও উত্তরের একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় গত দশ বছরে অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে বিপন্নতার মুহূর্তগুলিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের আচরণ ও প্রতিক্রিয়াতে। রামমন্দির নিয়ে উচ্চতম আদালতের রায়ের পর সমাজমাধ্যমে দেশের মুসলমান মানুষজনের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল হ্যাশট্যাগ ‘সবর’। সবর-এর অর্থ ধৈর্য, সংযম। ধৈর্য আর আত্মসংযমের মধ্যেই ভারতীয় মুসলমানরা আজ দিশা পাচ্ছেন।
সন্দেহ নেই, বিগত দুই দশকে নরেন্দ্র মোদীর ভারতে বহু বার দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের আতঙ্কিত এবং ধৈর্যহারা হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ঘোষিত ‘অমৃতকাল’-এ প্রশাসনের মদতে পুষ্ট গোরক্ষকদের হাতে মুসলমানদের ‘মব লিঞ্চিং’-এর ঘটনা ভিডিয়ো রেকর্ড বা সমাজমাধ্যমে লাইভস্ট্রিম করা হয়েছে। বুলডোজ়ার চালিয়ে মুসলমানের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ‘বুলডোজ়ার বাবা’ নামে জনপ্রিয় হয়েছেন। ‘লাভ জেহাদ’-এর অভিযোগে আক্রান্ত হয়ে ভিটেমাটি ছেড়েছে নিরীহ মুসলমান পরিবার। নিয়মিত ঘটেছে মুসলমানকে হিন্দুধর্মে ‘ফিরিয়ে’ নিয়ে আসার অর্থাৎ ‘ঘর ওয়াপসি’র মতো ঘটনা। দিল্লির বসতি অঞ্চলে জ্বলেছে আগুন। এই সবের মুখোমুখি হয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা অসহায় আশঙ্কায় দিন কাটিয়েছেন।
কিন্তু গোটা দেশেই লক্ষণীয়, ধৈর্যহারার মতো আচরণ করেননি তাঁরা। বিশ্বাস রেখেছেন দেশের সংবিধানে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর নির্মিত হয়েছে রামমন্দির। ভারতীয় মুসলমান মানুষেরা বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা রেখে মেনে নিয়েছেন সেই মন্দির নির্মাণ। উত্তর ভারতের ধর্ম সংসদ থেকে সম্প্রদায়ভিত্তিক অত্যাচারের ডাক দেওয়া হলে তাঁরা রাজ্যের প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন। নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করার সময়েও আইনের মধ্যে থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিলকিস বানোর ধর্ষকেরা মুক্তি পাওয়ার পরও তাঁদের প্রতিবাদ মাত্রাছাড়া হয়নি। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়ন, হিজাব প্রথা বাতিল করা— এই সবের বিরুদ্ধে মুসলিমরা প্রতিবাদ করলেও তা অসংযত হয়নি। নানা রকম বিপন্নতার মুখোমুখি হয়ে তাঁরা সংযম ও সহনশক্তিরই পরিচয় দিয়েছেন।
আশা করা যায়, আগামী দিনেও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধানতম অবলম্বন হবে সংযম। রাজনৈতিক প্রেক্ষিতভূমির কিছু উন্নতি হলেও এখনও বহু পথ অতিক্রম করা বাকি। বিজেপির রাজনৈতিক বিরোধিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিবর্তন। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের যে বাস্তুতন্ত্র এই দেশে গড়ে উঠেছে, তার সমাপ্তি ঘটাতে গেলে সংযত ও ধৈর্যশীল হয়ে আরও বেশি করে সু-কর্মে নিযুক্ত হওয়া প্রয়োজন, যাতে ব্যক্তি, সম্প্রদায় ও দেশের মঙ্গল সাধন হয়।
ধর্মশাস্ত্রানুসারে ধর্মের দশটি লক্ষণের অন্যতম প্রধান হল ‘ধৃতি’। ধৃতি অর্থাৎ ধৈর্য। মৎস্যপুরাণ থেকে জানা যায়, ধৃতি থেকে তপস্যার উৎকর্ষ সিদ্ধ হয়। বিগত দুই দশক যাবৎ ভারতে মুসলমানদের দিনযাপন যেন এক ক্লেশকর তপস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই তপস্যা এখনও জারি থাকুক, জারি থাকুক সুস্থ, নিরাপদ সময়ের আশা।