এ ঘোর ‘ক্যাপিটালোসিন’-এ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের ব-দ্বীপগুলির অবস্থা ক্রমে খারাপ হচ্ছে। সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ। সেখানে শুধু বাঘ, কুমির থাকে না; বৈচিত্রময় বাদাবন-সহ হাজার হাজার পশুপাখি কীটপতঙ্গ আর অনেক মানুষও থাকে। অনেক মানে, শেষ জনগণনায় সংখ্যাটা পঁয়তাল্লিশ লক্ষ। এঁদের মধ্যে অনেকেই জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য সুন্দরবনের জল জঙ্গল জমির উপর নির্ভরশীল। অনেকেই সুন্দরবন ভালবাসেন, তার সঙ্গে মিলেমিশে থাকেন। প্রায় তিন শতক প্রচুর লড়াই ও পরিশ্রম করে থাকতে থাকতে এই মানুষদের মধ্যে যে কমিউনিটি ইকোলজি, ইকোলজিক্যাল এথিক্স-এর ধারণা গড়ে উঠেছে, তার প্রমাণ আমরা পাই সুন্দরবনের সাহিত্যে— সোহারাব হোসেনের গাঙ বাঘিনি, মিতা সিংহের মরিচঝাঁপির বাঘ-সহ আরও নানা লেখালিখি উল্লেখ্য।
সুন্দরবনকে সংরক্ষণের নানা প্রয়াস দেখা যায়, কিন্তু তার একাংশ ব্যর্থ হয় এ কাজে সুন্দরবনের মানুষের অংশ্রগ্রহণ এখনও নিশ্চিত করা যায়নি বলে। সুন্দরবন ও তার মানুষের কিসে ভাল, তার অনেক সিদ্ধান্তই নেওয়া হয় সুন্দরবনের বাইরে থেকে। তা হলে সুন্দরবনের মানুষ তাঁদের কথা বলবেন কোথায়? বলবেন তাঁদের ‘দোখনো’ ও ‘সুন্দরী’ ভাষায় লেখা সাহিত্যে। কনককান্তি রায় ও অপরেশ মণ্ডল সম্পাদিত আবাদ সাহিত্যপত্রিকায় এই দুই ভাষায় গল্প কবিতা উপন্যাস প্রকাশিত হয়, ওঁদের সম্পাদিত আবাদি সুন্দরবনের গল্প সঙ্কলনটিও সুন্দরবনের লেখকদের ক্রমবিকাশের দলিল।
‘দোখনো’ ও ‘সুন্দরী’ একেবারে ভিন্ন দু’টি ভাষা যা সুন্দরবনে বিকাশ লাভ করেছে। মেদিনীপুর, ছোটনাগপুর মালভূমি, উত্তরবঙ্গের কিছু জায়গা, পূর্বে নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, যশোর থেকে আসা মানুষ মিলেমিশে এখানে এই ভাষা ও সমৃদ্ধ সংহত সংস্কৃতি তৈরি করেছেন। এই ভাষা ও সংস্কৃতি বুকে করে সুন্দরবনের সাহিত্য বিগত কয়েক দশকে বহু দূর বিস্তৃত হয়েছে। সুন্দরবনেই জন্মেছেন ও বড় হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের লেখার কথা বলতেই হয়। ১৯৯৬-এ ‘দোখনো’ ভাষায় মায়া গোয়ালিনীর ঘাট নভেলেট লিখেছেন সাগরদ্বীপের বিভু নাগেশ্বর। ‘সুন্দরী’ ভাষা-অঞ্চল থেকে আশির দশক থেকে লিখে চলেছেন উৎপলেন্দু মণ্ডল। লিখেছেন বিকাশকান্তি মিদ্যা, সন্তোষকুমার বর্মণ, হিমাংশু মিস্ত্রি, আদম সফি-সহ আরও অনেকে। এই প্রজন্মের মেয়েদের মধ্যে ‘সুন্দরী’ ভাষায় কবিতা লিখছেন সুলতা গায়েন। সুন্দরবনের নবীন প্রজন্মের লেখকেরা ক্রমশ সব লেখাই লিখছেন সুন্দরী ভাষায়, যা পড়তে গেলে সে ভাষার অভিধান নিয়ে বসা দরকার। ধীরে ধীরে এই অভিধান তৈরি হচ্ছে। এটা লেখকদের স্পষ্ট, জেদি এক অবস্থান— নিজ অঞ্চলের কথা মাতৃভাষা ছাড়া এই অভিঘাত-সহ বলা যেত না। উৎপলেন্দু, অপরেশদের লেখা ইংরেজিতে অনূদিত হচ্ছে, আনন্দের কথা।
সুন্দরবনের সাহিত্য খুঁটিয়ে দেখছে তার শেষ তিনশো বছরের ইতিহাস। হয়ে উঠছে সব আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাক্ষী। লেখার বিষয়গুলিকে সময়ের নিরিখে সাজালে, তাদের চলন ও বিবর্তন লক্ষ করলেই বোঝা যায় সুন্দরবনের ভূমিরূপ ও তার ব্যবহার, ইকোলজি, সুন্দরবনের জল-জঙ্গল-জমি, কাঠ-মধু-মাছ-কাঁকড়ার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ও আচার-আচরণ কী ভাবে বদলে যাচ্ছে, লিপিবদ্ধ হচ্ছে তার বর্ণনা। সারা দিন চাষের কাজ সেরে এসে রোজ কবিতা লিখেছেন বিদ্যা নদীর পাড়ে বসত করা প্রয়াত কবি বিনোদ বেরা, লিখেছেন মুকুন্দ গায়েন। মুকুন্দর ৬২টি কবিতা সঙ্কলিত হয়েছে উপকূলের কবিতা নামে।
সুন্দরবনের সমস্যা নিয়ে আলোচনায় প্রকৃতি ও মানুষকে দোষ দেওয়া হয়, আজকের পরিণতির জন্য প্রকৃতির খামখেয়াল ও মানুষের লোভই নাকি দায়ী! কোন মানুষ? যে সারা দিন কয়েকটা কাঁকড়া, দোন ফেলে দু’এক কেজি মাছ ধরে, দশ-বিশ কাঠা জমি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে, সেই মানুষ? এ ভাবে সমস্যার মূল কারণগুলি থেকে নজর ঘোরানো সহজ। উৎপলেন্দুর উপন্যাসে দেখা যায়, হাত-নৌকার মাঝিরা মেশিন-নৌকার বাড়বাড়ন্তে কাজ হারিয়ে নাছোড় প্রতিবাদে লেগে আছেন। তাঁদের কেউ কেউ পেটের টানে কাজ করতে চলে যান অন্য রাজ্যে, কয়েকজন গ্রামে থেকে প্রতিবাদ জারি রাখেন। এক দিন দেখা যায় নদীর ও-পাড়ে বড় রাজনৈতিক সভা। মেশিন ও হাত-নৌকার মাঝিদের বলা হয়, এ বার তাঁদের সব সমস্যার সমাধান হবে, মাঝিরা যেন সবাইকে বিনা পয়সায় সে দিন পারাপার করেন। খরচ পার্টি দেবে।
সভা শেষে জানা যায় নদী সংস্কার হবে না, উন্নয়নের জন্য নদীর উপরে ব্রিজ হবে! আমরা বাস্তবে দেখেছি, সেতু হওয়ার ফলে সুন্দরবনের নদীগুলোর কী অবস্থা। উৎপলেন্দুর এই লেখার সুরই আছড়ে পড়ে বিশ্বনাথ পুরকাইতের লেখায়: ঘটনাচক্রে কাব্যগ্রন্থের এই লাইনগুলি প্রশ্ন ছোড়ে: “যেসব নদীর বুকে ব্রিজ হলো,/ তারা সুখী?/ নতুন অটোয় বসে আমিও পেরোই মাতলা সেতু, চালককে চিনি, আগে মাঝি ছিল!” সুন্দরবনের উৎপলেন্দু বার বার লেখেন, “গোটা পৃথিবীটাই কলকাতা হয়ে গেল!” এ কথার তাৎপর্য গবেষকরা খুঁজে বার করবেন নিশ্চয়ই। সুন্দরবনের জল-জঙ্গল-জমির সাহিত্য, তার রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক বয়ান নির্মাণ এই দুর্দিনে আত্মরক্ষায় বড় ভূমিকা নেবে।