LGBT

বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য

গত ৬ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ৩৭৭ ধারা বিলুপ্তির ছ’বছর পূর্তি ছিল। দেশের সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের অকারণ হেনস্থা করতে ব্রিটিশ আমলের এই আইন সব সরকার এবং পুলিশ যথেচ্ছ অপব্যবহার করেছে, তা জানতে কারও বাকি নেই।

Advertisement

ভাস্কর মজুমদার

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:১৮
Share:

অনিতা ব্রায়ান্ট আমেরিকার বিখ্যাত গায়িকা ছিলেন। সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার বিজয়িনী, বিজ্ঞাপনের মডেল, এ সবও ছিলেন। কিন্তু তিনি সব চাইতে বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তাঁর বিদ্বেষ-ভাষণের জন্য— সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি ঘৃণা উগরে দিতেন ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সময়কালে। অনিতার এই ঘৃণার রাজনীতির বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন হার্ভে মিল্ক। হার্ভে মিল্ক প্রথম ঘোষিত সমকামী, যিনি আমেরিকার রাজনীতির মধ্যে দিয়ে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের (সান ফ্রান্সিসকো বোর্ড অব অ্যাডভাইজ়র্স) সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনে জেতার পরে মিল্ক বলেছিলেন, “অনিতা ব্রায়ান্টের কথা টেলিভিশনে আপনারা যতই শুনুন না কেন, শেষ পর্যন্ত সমস্ত ঘৃণার বিরুদ্ধে আপনাদের ধারণ করতে হবে আশা। একটি শ্রেয়তর, সুন্দরতর, ঘৃণা-রহিত পৃথিবীর আশা!”

Advertisement

গত ৬ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ৩৭৭ ধারা বিলুপ্তির ছ’বছর পূর্তি ছিল। দেশের সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের অকারণ হেনস্থা করতে ব্রিটিশ আমলের এই আইন সব সরকার এবং পুলিশ যথেচ্ছ অপব্যবহার করেছে, তা জানতে কারও বাকি নেই। এই ধারা অবসানের কোনও সদিচ্ছা কোনও সরকার দেখায়নি। দু’তিন বারের চেষ্টায় শেষে সুপ্রিম কোর্টে ২০১৮ সালে তার অবলুপ্তি ঘটে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় ৩৭৭ ধারার মতো কিছু নেই।

নিঃসন্দেহে ভারতীয় যৌন-সংখ্যালঘু মানুষদের জীবনে স্বস্তি বয়ে এনেছিল। অন্তত হাতেকলমে তাঁরা ‘অপরাধী’ রইলেন না আর। কিন্তু সামাজিক ঘৃণা থেকে মুক্তি সহজ নয়। এখনও এ-দেশে ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি সমাজমাধ্যমেও সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী মানুষরা ঘৃণা ও হেনস্থা-হিংসার শিকার হন। এবং এ সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভারতে এখনও অবধি কোনও আইন নেই। শুধু তা-ই নয়, এ-দেশে যৌন-সংখ্যালঘু মানুষদের বিবাহের, সন্তানপালনের কোনও অধিকার নেই।

Advertisement

এই অন্যায় বৈষম্য নিয়ে গত বছর সুপ্রিম কোর্টে মামলা হলে শীর্ষ আদালত সাফ জানিয়ে দেয় এ বিষয়ে যা করার সংসদ করবে। আদালত আইন তৈরি করবে না। এর মধ্যে লোকসভা ভোটের আয়োজন শুরু হয়। ভোটে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের ফল আশানুরূপ হয় না। হয়তো সরকারের কোনও আত্মোপলব্ধি হয়ে থাকবে, তাই জুলাই মাসে অল্প কয়েকটি যৌন-সংখ্যালঘু সংগঠনকে নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক ন্যায় মন্ত্রণালয় প্রায় গোপনে একটি আলোচনায় বসে। সেই আলোচনার কোনও নির্ঘণ্টও প্রকাশিত হয় না, যা অগণতান্ত্রিক। তবে হয়তো আলোচনায় কিছু কাজ হয়ে থাকবে। দেখা যাচ্ছে যে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রক নানা সদর্থক ‘অ্যাডভাইজ়রি’ (নির্দেশাবলি) চালু করেছে, যেগুলি দেশের যৌন-সংখ্যালঘু মানুষদের সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।

যেমন, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া জানিয়ে দিয়েছে যে কোনও লিঙ্গ-যৌনতার মানুষই তাঁর সঙ্গীকে ব্যাঙ্কে ‘নমিনি’ করতে পারবেন। খাদ্য মন্ত্রক সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে নির্দেশ দিয়েছে, যৌন-সংখ্যালঘু যে-কোনও মানুষ যেন তাঁর সঙ্গীকে একই গৃহের মানুষ হিসাবে রেশন কার্ডে নাম নথিভুক্ত করাতে পারেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রক ‘কনভার্শন থেরাপি’ নিষিদ্ধ করার এবং লিঙ্গ পরিবর্তনের যে-কোনও শল্যচিকিৎসা সুলভ করতে পরামর্শ দিয়েছে। এমনকি সঙ্গীর মৃত্যুতে তাঁর মরদেহ দাবি করার অধিকার দেশের সব সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষের যেন থাকে, সে-ব্যাপারে হাসপাতালগুলিকে যত্ন নিতে বলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রক। ভারতে সন্তান দত্তক নেওয়ার আগে অনেক সময় শিশুর তত্ত্বাবধান ও পরিচর্যার জন্য (ফস্টার কেয়ার) সময় ধার্য থাকে দু’তিন বছর। কেন্দ্রীয় সরকার সে-ক্ষেত্রে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের কথা উল্লেখ না করলেও, নতুন একটি নির্দেশ মারফত জানিয়েছে যে এখন থেকে অবিবাহিত নারী-পুরুষও সন্তান প্রতিপালন করতে পারবেন।

এত সব পর্যালোচনা করে মনে হতে পারে দেশের যৌন-সংখ্যালঘু মানুষদের নিয়ে অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা দলটি কিছু ভাবনা শুরু করেছে। কিন্তু ‘অ্যাডভাইজ়রি’ তো আইন নয়। দেশের সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের সমাজে ও রাষ্ট্রে সমান অধিকার দিতে হলে আইন তৈরি করা আশু প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দিয়ে, সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো দুটো নির্দেশ-উপদেশ দিয়ে কাজ সারলে হবে না।

মনে রাখতে হবে, যৌন-সংখ্যালঘু মানুষদের অধিকারপ্রাপ্তির আন্দোলন আসলে মানবাধিকার এবং সমানতা অর্জনের আন্দোলন। গণতান্ত্রিক দেশে ধর্ম-জাতি-লিঙ্গের কারণে যেমন কোনও মৌলিক অধিকার খর্ব হওয়া কাম্য নয়, তেমনই যৌনপরিচয়ের জন্য কেউ সে সব অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবেন, তা-ও হতে পারে না।

হার্ভে মিল্ক অনিতা ব্রায়ান্টের ঘৃণার রাজনীতিকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মিল্ককে গুলি করে হত্যা করেছিল ওই ‘সান ফ্রান্সিসকো বোর্ড অব অ্যাডভাইজ়র্স’-এর আর এক সদস্য ড্যান হোয়াইট। ড্যান সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি তার ঘৃণাকে হারাতে পারেনি। ভারতে আজ হয়তো যৌন-সংখ্যালঘু মানুষদের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় স্তরে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। কিন্তু সবার আগে আমাদের যে শপথ গ্রহণ করতে হবে, তা হল— ভারতীয় সমাজে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষ-সহ ভিন্ন লিঙ্গযৌনতার মানুষদের প্রতি ক্রমবর্ধমান ঘৃণা থেকে তাঁদের সুরক্ষিত রাখতে হবে। তার জন্য দরকার উপযুক্ত আইন প্রণয়ন। আসল লড়াই তো ঘৃণার বিরুদ্ধে লড়াই। সেই কাজ কেন্দ্র, রাজ্য, সব সরকারকেই করতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement