Pride Month

স্বপরিচয়ে বাঁচার গৌরব

ভারতে প্রতি দিন সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা যত রকমের হেনস্থা-হিংসার শিকার হয়, উপরোক্ত ঘটনা সেই প্রকাণ্ড হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

Advertisement

ভাস্কর মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২৪ ০৮:৫৮
Share:

সম্প্রতি কান ফিল্মোৎসবে ‘অঁ সর্তেঁ রেগার্দ’ বিভাগে অভিনয়ের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য পুরস্কৃত হলেন বাঙালি মেয়ে অনসূয়া সেনগুপ্ত। যে ছবির জন্য এই পুরস্কার পেয়ে অনসূয়া ইতিহাস গড়লেন (এই প্রথম ওই পুরস্কার পেলেন কোনও ভারতীয়), সেই দ্য শেমলেস ছবিটির বিষয় সমকামিতা ও দেহব্যবসা। অনসূয়া পুরস্কারপ্রাপ্তির পর বলেছেন, কুইয়র গোষ্ঠীর মানুষদের আর যেন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে না যেতে হয়। তারা যেন আর পাঁচটা মানবগোষ্ঠীর মতো নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকতে পারে।

Advertisement

অনসূয়া যখন এ-কথা বলছেন, তখন তাঁর কলকাতায় এক রূপান্তরকামী নারীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে, এবং মিডিয়ার একাংশ সেই নারীর যৌনপরিচয়কে বিন্দুমাত্র সম্মান না জানিয়ে ক্রমাগত তাঁকে ‘পুরুষ’ বলে গিয়েছে। সংবাদে প্রচার করা হচ্ছে, ওই নিহত ব্যক্তি কত অসামাজিক, কত বার মত্ত অবস্থায় তাঁকে দেখা গিয়েছ। এ-ও শোনা গিয়েছে যে তদন্তের সময় পুলিশও নাকি সেই মৃত রূপান্তরকামী-নারীর পোশাক খুলে তাঁর লিঙ্গনির্ধারণ করবার চেষ্টা করেছে!

ভারতে প্রতি দিন সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা যত রকমের হেনস্থা-হিংসার শিকার হয়, উপরোক্ত ঘটনা সেই প্রকাণ্ড হিমশৈলের চূড়ামাত্র। তথ্য বলছে, এ দেশে সমকামী মানুষেরা সামাজিক চাপে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে, এবং রূপান্তরকামী হলে তার সম্ভাবনা আরও বেশি। এক জন সমকামী-রূপান্তরকামী শিশু বা তরুণের প্রথম হেনস্থা শুরু হয় তার বিদ্যালয় থেকে। পাশে বসা বন্ধুটিই তার প্রতি ঘৃণায় হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। এ-দেশে অধিকাংশ রূপান্তরকামী নারী-পুরুষ পরিবারের অত্যাচারে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়। রাস্তায় এসে দাঁড়ানো ছাড়া তাদের আর উপায় থাকে না। তাদের পড়াশোনা অসমাপ্ত থাকে, কেউ কেউ স্কুলছুট হয়। কেউ বাধ্য হয়ে দেহব্যবসায় নেমে পড়ে। নিজেকে সুরক্ষিত রাখা কঠিন, তাই অনেকে এইচআইভি-সহ নানা যৌন রোগের শিকার হয়।

Advertisement

সমকামী মানুষেরা অন্তরালবর্তী হয়ে বেশির ভাগ জীবন কাটায়। নিজের প্রকৃত পরিচয় না জানাতে পারার গ্লানি তাদের গ্রাস করে। নানা কর্পোরেট কোম্পানি সমকামিতা-উভকামিতা-রূপান্তরকামিতার অন্তর্ভুক্তি ঘোষণা করে গালভরা বিজ্ঞাপন দিলেও, আসল ছবি অন্য রকম। প্রকৃত লিঙ্গ-পরিচয়, কিংবা যৌন-পরিচয় প্রকাশের পরে নিজের সম্মান বজায় রেখে কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে। সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য কর্মক্ষেত্রে হেনস্থা-হিংসা বিরোধী কোনও আইন এ দেশে আজ অবধি তৈরি হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশ ছিল রূপান্তরকামী মানুষদের চাকরি-ক্ষেত্রে সংরক্ষণের, তা-ও হয়নি।

এর পর আসে প্রেম-বিবাহ-যৌথতার প্রশ্ন। ভারতে সমকামী মানুষদের বিবাহের কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই। একটি তথাকথিত বিসমকামী সমাজে একই বয়সের, একই আর্থিক সঙ্গতির বন্ধুদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, অথচ অনেক বেশি সফল হওয়া সত্ত্বেও একটি মানুষ কেবলমাত্র সমকামী হওয়ার জন্য বিয়ে হচ্ছে না— এটা এক বাস্তবিক সামাজিক বৈষম্য। কৃত্রিম প্রজননের মধ্যে দিয়ে সন্তান পাওয়ার অধিকার সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের এ দেশে নেই। দত্তক নিয়ে তারা সন্তানপালনের সুখ পাবে, সেই উপায়ও নেই, কারণ সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের প্রকৃত যৌনপরিচয় জানতে পারলে কোনও সরকারি সংস্থা শিশু দত্তক দেয় না বললেই চলে। এমতাবস্থায় সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষরা বিসমকামী বিবাহে বাধ্য হয়। অনেকে নিজের মনোমত সম্পর্ক তৈরির জন্য বিভিন্ন অ্যাপ-নির্ভর আলাপ ও যৌনতায় জড়িয়ে যায়। তখন চলে তাদের ভয় দেখানোর পালা।

এই অত্যাচার-অনাচার থেকে মুক্তির উপায় কী? ইতিহাস বলে, যখন কোনও গোষ্ঠীর উপরে সামাজিক অত্যাচার চলেছে, তখন তাদেরকেই রুখে দাঁড়াতে হয়েছে। ক্ষমতাসীন মানুষেরা কখনওই ক্ষমতাহীন কোনও গোষ্ঠীকে স্বেচ্ছায় অধিকার দেয় না, অধিকার ছিনিয়েই নিতে হয়।

পঞ্চান্ন বছর আগে নিউ ইয়র্কের স্টোনওয়াল সংঘর্ষের মাধ্যমে অধিকারের জন্য সংগ্রামের উদাহরণ তৎকালীন সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা রেখে গিয়েছেন। আমাদের দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দলিত ও নারীরা দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের হাত থেকে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে এনেছেন। সে পথেই হয়তো দেশের সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী মানুষ-সহ সমস্ত লিঙ্গযৌনপরিচয়ের মানুষদের নিজেদের অধিকারের হিসেব নিতে হবে। ২৮ জুন, ১৯৬৯ ‘স্টোনওয়াল ইন’ নামে সমকামীদের একটি ক্লাবে পুলিশি হানার পর ছড়িয়ে পড়া প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কথা মনে রাখতেই বিশ্ব জুড়ে জুন মাসটি ‘প্রাইড-মান্থ’ (গর্বের মাস) হিসেবে পালিত হয়। এই ‘প্রাইড’ নিজের প্রকৃত লিঙ্গযৌনপরিচয় নিয়ে সসম্মানে বেঁচে থাকবার গৌরব। একই সমাজে বিসমকামী গোষ্ঠীর মানুষ যা অধিকার পায়, সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরাও সেই অধিকারে প্রতিষ্ঠিত হতে পারার ‘প্রাইড’। সমাজের যে সব শক্তি সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের উপর অত্যাচার চালায়, অকারণ ঘৃণা ছড়ায়, প্রাইড-মান্থের প্রতিটি মিছিল সেই সব অপশক্তির চোখে চোখ রেখে যেন কথা বলতে পারে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement