Ball Python

যা ভাল লাগে তা-ই খাঁচায় পুরতে নেই, তাতে সঙ্কটই বেড়ে চলে, পশুকল্যাণ নয়, আরও বিপন্ন হয় বন্যপ্রাণ!

পশ্চিম আফ্রিকার পাশাপাশি অন্যান্য দেশে যাঁরা বল পাইথন পালন করেন, তাঁরা ওই সাপের প্রজনন প্রক্রিয়া কৃত্রিম ভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। বেশি ডিম এবং বাচ্চার লক্ষ্যেই কৃত্রিম ভাবে তাঁরা প্রজনন বৃদ্ধির কাজটি করেন।

Advertisement

শুভব্রত ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৪ ০৮:০০
Share:

সৃজিত মুখোপাধ্যায় তাঁর বাড়িতে বল পাইথন প্রজাতির একটি সাপ পুষছেন। নাম রেখেছেন ‘উলুপী’। ছবি ‘ওয়ার্ল্ড অ্যানিমাল প্রোটেকশন’-এর সৌজন্যে।

বল পাইথন। কয়েক দিন আগেই আনন্দবাজার অনলাইনে পড়লাম, চিত্রপরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় তাঁর বাড়িতে এই প্রজাতির একটি সাপ পুষছেন। নাম রেখেছেন ‘উলুপী’। আরও একটি সাপ আনার পরিকল্পনাও রয়েছে তাঁর। নিয়মকানুন মেনেই তিনি এনেছেন বল পাইথন। পশুপাখি ও বন্যপ্রাণ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছি। খবরটি পড়ার পর থেকে একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করছে, বাড়িতে যদি কেউ সাপ পোষেন, তা হলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বা পশুকল্যাণের কোনও উপকার হয় কি?

Advertisement

একা সৃজিত নন, বর্তমানে এ দেশে অনেকেই বিদেশি প্রাণী, যাকে আমরা পরিভাষায় ‘নন নেটিভ’ বা ‘এগ্‌জ়োটিক’ বলি, পুষছেন অথবা পোষার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এই বিষয়ের অনেকগুলি পরত আছে। প্রথমত, এটা আইনের আওতায় পড়ে। কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক বিদেশি এই প্রাণীদের এ দেশে পোষার জন্য অনেক নিয়মকানুন বানিয়েছেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক গাইডলাইনও রয়েছে এ বিষয়ে। যার নাম ‘কনভেনশন অফ ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেনজার্ড স্পেসিস’ (সাইটিস)। এর পরিশ্লিষ্ট ২-এ বল পাইথন আছে। সেখানে বলা হয়েছে, যথাযথ অনুমতি (পারমিট) নিয়ে এই সাপ পোষা যায়।

কিন্তু এই ‘পারমিট’ নিয়েও কয়েকটি বিষয় আছে। বিদেশি প্রাণীর আইনি মালিকানা নিয়ে যে সমস্ত অনুসন্ধান এবং গবেষণা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট, সমস্ত ক্ষেত্রে এই অনুমতি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ভাবে দেওয়া বা গ্রহণ করা হয়নি। হয় না। এখানে বন দফতরের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। দায়িত্বশীল তো তারাই। কিন্তু তার প্রমাণ যে সব ক্ষেত্রে পাওয়া যায়, এমন নয়। আমাদের দেশে সরকারি বিভাগে দুর্নীতি যে হেতু খুবই প্রকট, তাই বিদেশি বন্যপ্রাণ পোষার বিষয়েও যে আইনি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ভাবে মানা হয়, তেমনটা মোটেই নয়।

Advertisement

খামারে পালন করা সাপ। ছবি ‘ওয়ার্ল্ড অ্যানিমাল প্রোটেকশন’-এর সৌজন্যে।

আন্তর্জাতিক পশুকল্যাণ সংস্থা হিসাবে ‘ওয়ার্ল্ড অ্যানিমাল প্রোটেকশন’ বহু গবেষণা করেছে বল পাইথনের উপরে। সেখান থেকেই জানা যায়, এই সাপ পশ্চিম আফ্রিকাতে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। বিশেষ করে ঘানা, সুদান, টোগো, নাইজ়েরিয়া এবং ক্যামেরুনের মতো দেশে। ‘সাইটিস’-এর রেকর্ড অনুযায়ী, আফ্রিকা থেকে সব থেকে বেশি যে বন্যপ্রাণী রফতানি করা হয়, তার নাম বল পাইথন। ওই সংস্থার করা ‘স্নেক্‌স অ্যান্ড ল্যাডার্স’ নামে একটি রিপোর্ট আছে। সেখানে দাবি করা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই এই বল পাইথন বেআইনি ভাবে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে অন্যান্য দেশে রফতানি করা হয়। পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নানা বনজঙ্গল থেকে ধরা বল পাইথনকে বন্দিদশায় পালিত হিসাবে দেখিয়ে তাদের নিয়ে করা হয় বেআইনি বাণিজ্য। ওই রিপোর্টেই বলা হয়েছে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই বেআইনি বল পাইথনকে অন্য দেশে পালন করে তাদের বাচ্চাগুলি পোষার জন্য আবার অন্য দেশে বিক্রি করা হয়।

বন্যপ্রাণের বাণিজ্য নিয়ে ওই সংস্থারই ‘কার্গো অফ ক্রুয়েলটি’ নামে একটি রিপোর্ট রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পশ্চিম আফ্রিকার যে দেশগুলিতে বল পাইথনের বাণিজ্য খুব বেশি, সেখানকার খামারগুলিতে ওই সাপ অত্যন্ত খারাপ ভাবে পালন করা হয়। খামারে তাদের রাখা হয় খুবই অস্বাস্থ্যকর ভাবে। মাঝেমাঝে তা নিষ্ঠুরতার পর্যায়েও পৌঁছে যায়। এমনকি, ঘানা, টোগো এবং বেনিনের মধ্যে বাণিজ্য সংক্রান্ত সব আইনকানুন ভেঙেই বল পাইথনের ব্যবসা চলে। এ সব কিন্তু ওই সাপের অস্তিত্বের পক্ষে অত্যন্ত সঙ্কটজনক। এখানেই শেষ নয়। সঙ্কটের আরও কারণ রয়েছে। গবেষণা বলছে, পশ্চিম আফ্রিকার পাশাপাশি অন্যান্য দেশে যাঁরা বল পাইথন পালন করেন, তাঁরা ওই সাপের প্রজনন প্রক্রিয়া কৃত্রিম ভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। বেশি ডিম এবং বাচ্চার লক্ষ্যেই কৃত্রিম ভাবে তাঁরা প্রজনন বৃদ্ধির কাজটি করে থাকেন। শুধু তাই নয়, বল পাইথনের বিভিন্ন রং পেতে অর্থাৎ ‘কালার মর্ফ’ করার জন্য সাপগুলিকে এমন ভাবে পালন করা হয় যে, তাদের শারীরিক ক্ষতি ব্যাপক ভাবে হয়।

টোগো এবং বেনিনের বল পাইথন শিকারিরা গবেষকদের সম্প্রতি জানিয়েছেন, পাঁচ বছর আগে যে সংখ্যায় বনজঙ্গলে ওই সাপ পাওয়া যেত, এখন আর তেমনটা যায় না। বল পাইথন গবেষক এবং সর্পবিদ নিল ডিক্রুজ়ের মতে, এই কারণেই এই সাপটিকে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজ়ারভেশন অফ নেচার (আইউইসিএন) ‘অরক্ষিত’ (ভালনারেব্‌ল) বলে ঘোষণা করেছে। অন্য দিকে, ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন’ পশ্চিম আফ্রিকা থেকে রফতানি করা বল পাইথন পোষা নিষিদ্ধ করেছে তাদের দেশগুলিতে। বল পাইথন বাণিজ্য এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এই সাপ নিয়ে ব্যবসার বিভিন্ন দিক ফের খতিয়ে দেখছে ‘সাইটিস’।

গাদাগাদি করে অস্বাস্থ্যকর ভাবে রাখা হয়েছে বল পাইথনকে। ছবি ‘ওয়ার্ল্ড অ্যানিমাল প্রোটেকশন’-এর সৌজন্যে।

এ তো গেল দেশ-বিদেশে বল পাইথন নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং তার আইনের কথা। আমি বল পাইথন বিদেশি চিড়িয়াখানায় ছাড়া এ দেশে খুব বেশি দেখিনি। গত বছরই অসমের গুয়াহাটি চিড়িয়াখানায় একটা বল পাইথন দেখেছিলাম। যত দূর জানি, ওই সাপটি বন্যপ্রাণের কারবার করিয়েদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া। আসলে, আইন মেনে এবং আইন ভেঙে যাঁরা এই সাপ পোষেন, তাঁদের দু’দলকে বেশির ভাগ সময়েই আলাদা করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে যাঁরা আইনের রক্ষক, যেমন বন দফতরের আধিকারিকেরা, তাঁদের কাজটা বেশ শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, সত্যিই বোঝা খুবই কঠিন যে, কে বল পাইথন আইনি ভাবে পুষছেন, আর কে নন! কারণ, এই সাপদের আসল উৎস বুঝতে অসুবিধে হওয়াটাই স্বাভাবিক।

ধরা যাক, কেউ আইনি ভাবে সব নিয়মকানুন মেনেই বল পাইথন বা অন্য কোনও বিদেশি প্রাণী পুষছেন। জনমানসে তার প্রভাব কী? ধরে নিলাম, কোনও ব্যক্তি পশুপাখিকে ভালবেসে বাড়িতে সাপ পুষছেন। এটা দেখে অন্য কারও মনে হতেই পারে, উনি যখন পুষছেন, আমিও একটা সাপ পুষি! ক্ষতি কী! আইনের তোয়াক্কা না করেই হয়তো তিনি সাপ পোষার পরিকল্পনা নিলেন। এ বার তিনি কোনও সাপুড়ের কাছ থেকে একটি দেশি সাপ কিনলেন। এই বিষয়টা কিন্তু একেবারেই বেআইনি। তিনি কেনার আগে অন্য যে ব্যক্তি (এ ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যাক ওই সাপুড়ে) জঙ্গল থেকে সাপটিকে ধরেছিলেন, তিনি বেআইনি কাজ করেছেন। ফলে কেউ বাড়িতে আইন মেনে বিদেশি সাপ পুষছেন দেখে অন্য যে কেউ প্রভাবিত হয়ে এই ধরনের বেআইনি কাজ করে ফেলতে পারেন। অন্তত তেমন একটা সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে বইকি!

আজকাল পাশ্চাত্য দুনিয়ায় তো বটেই, আমাদের দেশেও বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণ পোষার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমি যখন ছোট ছিলাম, আমিও রঙিন মাছ পুষতাম খুব যত্ন সহকারে। কাচের চৌবাচ্চায় সে সব মাছের বাচ্চাও হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে পড়াশোনা করে জেনেছিলাম যে, এই রঙিন মাছের ব্যবসার জন্য প্রচুর মাছ নদী, সমুদ্র থেকে বেআইনি ও অনৈতিক ভাবে ধরে আনা হয়। যাতে আমার মতো লোকজন বাড়িতে তাদের পুষতে পারে। তখন থেকেই মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, আমার শখের জন্য নদী বা সমুদ্রের মাছ কাচের খাঁচায় থাকবে কেন? কিছু সিনেমা এবং বই আমার এই চিন্তাভাবনায় প্রভাব ফেলেছিল। ‘ফাইন্ডিং নিমো’র কথা বলতে পারি। যেখানে বন্দি মাছেরা সমুদ্রে মুক্ত হতে চাইছে। ‘মেমোরিজ় ইন মার্চ’ সিনেমায় একটা সংলাপ ছিল— আমাদের যা কিছুই ভাল লাগে, তাকে আমরা খাঁচায় পুরতে চাই। অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছের মতন। ‘ফ্রি উইলি’তে যেমন ‘কিলার হোয়েল’ মহাসমুদ্রে মুক্ত হচ্ছে। অস্কারপ্রাপ্ত সিনেমা ও বেস্টসেলার ‘বর্ন ফ্রি’তে যেমন পরম আদরে পালন করা সিংহী ‘এলজ়া’ তাকে পালন করা মা-কে ছেড়ে নিজের স্বজাতির রাজকীয় সিংহদের কাছে ফিরে যাচ্ছে। পরবর্তী কালে জয় অ্যাডামসনের ভূমিকায় অভিনয় করা অভিনেত্রী ভার্জিনিয়া ম্যাককেনার সঙ্গে যখন দেখা হয়েছে, তখন এ বিষয়ে কথা হয়েছে। ‘জীবনস্মৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, খাঁচাবন্দি কোকিলের কলতান সবচেয়ে বেদনাদায়ক।

এ সব সিনেমা আর বই পড়ার পর এক বৃষ্টির দিনে নিজের পোষা দুটো নয়নাভিরাম ‘পিকক ইল’ মাছকে দেখতে দেখতে মনে হল, এই শেষ আর নয়। অনেক হয়েছে এই প্রাণী বন্দি করার শখ। আর কোনও দিন রঙিন মাছ এনে অ্যাকোয়ারিয়ামে আটকে রাখব না। একটা সময়ের পর আর রাখিওনি।

তাই, বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক যদি কোনও দিন এমন সিনেমা তৈরি করেন, যেখানে উলুপীর মতো বিদেশি বন্যপ্রাণীরা পুনর্বাসিত হচ্ছে বা মুক্তি পাচ্ছে দেখানো হয়, আমিই প্রথম টিকিট কেটে সেই সিনেমা দেখতে হলে ঢুকব।

(লেখক ‘ওয়ার্ল্ড অ্যানিমাল প্রোটেকশন’-এর ওয়াইল্ড লাইফ ক্যাম্পেন ম্যানেজার। মতামত নিজস্ব)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement