নারীদিবসের একটি আলোচনায় এক মিড-ডে মিল রন্ধন-কর্মী জানালেন, ন্যূনতম মজুরির থেকে অনেক কম টাকা তাঁদের দিচ্ছে সরকার। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর হাত ঘুরে কর্মীদের দৈনিক বেতন ১০-১২ টাকা দাঁড়ায়, তা-ও নিয়মিত পান না। বিষয়টি চিন্তা করার মতো। ২০১৯-২০ সালে কৃষক আন্দোলনের পরে ফসলের ন্যূনতম দাম কী ভাবে স্থির হবে, তা নিয়ে নাগরিক সমাজে নানা আলোচনা, বিতর্ক হয়েছে। তুলনায় ন্যূনতম মজুরির হিসাব নিয়ে নাগরিক পরিসরে যথেষ্ট আলোচনা হয়নি।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ন্যূনতম মজুরির সুপারিশ করে ১৯২৮ সালে। অসংগঠিত শ্রমিক, যাঁদের দর কষাকষির ক্ষমতা নেই, তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি সুনিশ্চিত করাই ছিল এই সুপারিশের লক্ষ্য। ভারতে ১৯৪৮ সালে ন্যূনতম মজুরি আইন চালু হয়। আইএলও তিন ধরনের মজুরির কথা বলেছে ১) কেবল খেয়ে-পরে বাঁচার মতো মজুরি (ন্যূনতম মজুরি) ২) স্বাস্থ্য রক্ষা, সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রাখার মতো মজুরি (ফেয়ার ওয়েজ বা ন্যায্য মজুরি), ৩) উন্নত জীবনযাত্রা, সসম্মানে বাঁচার প্রয়োজনমতো মজুরি (লিভিং ওয়েজ)।
ভারতে পঞ্চদশ শ্রম সম্মেলনে (১৯৫৭) সরকার, শ্রমিক সংগঠন ও শিল্প সংগঠনগুলি একমত হয়, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ভিত্তি কী হবে। ১৯৯১ সুপ্রিম কোর্ট ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শিশুশিক্ষা, চিকিৎসাব্যবস্থা, আমোদ-প্রমোদ, বিবাহ-সহ উৎসব-অনুষ্ঠান এবং বৃদ্ধ বয়সের নিরাপত্তার জন্য আরও অন্তত ২৫ শতাংশ অর্থ যোগ করার কথা বলেন। সংবিধানের ২৩তম ধারা অনুযায়ী, কোনও শ্রমিককে ন্যূনতম মজুরি না দেওয়ার অর্থ হল, তাঁকে দাস শ্রমিক (বন্ডেড লেবার) করে রাখা।
ন্যূনতম মজুরি পাওয়াটা শ্রমিকের অধিকার, আইনি অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার। সরকারের আইনত দায়িত্ব বর্তায় শ্রমিকরা যাতে ন্যূনতম মজুরি পান, সেটা সুনিশ্চিত করা। প্রায় কোনও রাজ্যে, কোনও দলের সরকার তা করে না। ই-শ্রম পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে বাইশ লাখ গৃহপরিচারিকার কাজে যুক্ত। দেশের অনেক রাজ্যেই এঁদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হয়েছে। কেরল (২০০৫), অন্ধ্রপ্রদেশ (২০০৭), রাজস্থান (২০০৭), কর্নাটক (২০০৪), তামিলনাড়ু (২০০৭) আইন করেছে। এ ছাড়া মেঘালয়, অসম, বিহার, ঝাড়খণ্ড-সহ আরও অনেক রাজ্যে গৃহপরিচারিকাদের ওয়েলফেয়ার বোর্ড তৈরি করা হয়েছে। দিল্লিতে গৃহপরিচারিকাদের মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটি ছ’মাস পর্যন্ত দেওয়া হয়। মহারাষ্ট্রে ‘ঘরেলু কামগার কল্যাণ বোর্ড’ মাতৃত্বকালীন আর্থিক সহায়তা দেয়। তামিলনাড়ু গৃহপরিচারিকাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প চালাচ্ছে ২০০৭ সাল থেকে।
পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক রোজগেরে মহিলা গৃহপরিচারিকার কাজ করছেন। তাঁদের মজুরি সুরক্ষার আইনি ব্যবস্থা হল না কেন? কেন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা গেল না চা বাগানের মেয়েদের? শাসক দল দাবি করে, গত দেড় দশকে ৬৫ টাকা থেকে মজুরি বাড়িয়ে বর্তমানে ২৫০ টাকা করা সরকারেরই কৃতিত্ব। কিন্তু প্রচারের পিছনে ভিড় করে থাকে না-বলা কথা। যেমন, অতীতে মজুরি কম দেওয়া হত, কারণ রেশন, জ্বালানি, প্রাথমিক শিক্ষা, পানীয় জল, চিকিৎসা, আবাস থেকে ছাতা, চপ্পল, চা, সবই দিতেন মালিকরা। ‘প্লান্টেশন লেবার অ্যাক্ট’-এ সেই নির্দেশ ছিল। গত তিন দশকে অধিকাংশ দায় মালিকরা ঝেড়ে ফেলেছেন, সরকার কাঁধ বাড়িয়ে তার খানিকটা (রেশন, ক্রেশ) নিয়েছে। কিন্তু স্কুলের বাস, স্বাস্থ্য ক্লিনিক, ঘর সারানোর টাকা দেওয়া বন্ধ করে থাকলে সেই অনুপাতে মজুরি বাড়ানো হবে না কেন, সে প্রশ্নটা সরকার কখনও তোলেনি। তার উপর বাড়ছে অস্থায়ী মজুরদের অনুপাত, যাঁরা মজুরি ছাড়া কোনও সুবিধেই পান না। চা বাগানে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করার সরকারি কমিটি দশ বছরে একটিও সুপারিশ করেনি। যদি করত, তা হলে নগদ আর সুবিধা মিলিয়ে মজুরি নির্ধারণের পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রমের বাজারে এখন অস্থায়ী শ্রমিক, গিগ শ্রমিক, ফুরনের কাজ (পিস-প্রতি মজুরি) করা শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে দিক থেকেই হিসাব করে দেখা যাক, এই শ্রেণির প্রকৃত আয় কমছে। এঁদের একটা বড় অংশ মহিলা। সরকারি সমীক্ষার দাবি, কাজের বাজারে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ই-শ্রম পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ১ কোটি ৪০ লাখ নারী-শ্রমিক, মোট শ্রমিকের ৫৪ শতাংশ। এঁদের প্রায় সবাই ন্যূনতম মজুরির চাইতে কম তো বটেই, পুরুষের চাইতে কম মজুরিতেও কাজ করেন। ২০১৯-এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে নারী-শ্রমিক ১৯ শতাংশ কম মজুরি পান পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে। এই মজুরি-চুরি ‘নিয়ম’ হয়ে ওঠায় কেউ তাকে অপরাধ বলেও দেখতে পাচ্ছে না।
চুরির অভিযোগ উঠেছে সরকারের বিরুদ্ধেও। মেয়েদের ‘স্বেচ্ছাসেবী’ করে রাখার সরকারি নীতি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, আশা কর্মী, মিড-ডে মিল রন্ধন-কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত করছে। কোনটা ‘স্বেচ্ছাশ্রম’, সেই সংজ্ঞা ঠিক করা চাই।
ন্যূনতম মজুরি যেমন শ্রমিক অধিকারের প্রশ্ন, তেমনই নারী অধিকারেরও প্রশ্ন। কারণ কমবেশি সর্বত্র কাজের বাজারে সস্তার শ্রমের প্রধান জোগানদার নারী। সংবিধানে, আইনে, সরকারের প্রচারে, ইস্তাহার প্রতিশ্রুতিতে, যতই সম-অধিকারের কথা বলা হোক, নারীক্ষমতায়নের প্রথম ধাপ হল কাজের বিনিময়ে ন্যায্য, আইনসম্মত মজুরি নিশ্চিত করা। গৃহস্থালি থেকে কলকারখানা, সর্বত্র কোন পদ্ধতিতে সেই মজুরির অঙ্ক নির্ধারিত হবে, আর কী করে তা দেওয়া নিশ্চিত করা হবে, সেই প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হবে দেশকে।