অগ্রপথিক: আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর তত্ত্বকে স্বীকৃতি দিচ্ছে
জগদীশচন্দ্র বসুর অব্যক্ত বইটির বয়স হল একশো বছর— সংক্ষিপ্ত বইটির ভূমিকায় লেখক স্বাক্ষর করে তারিখ লিখেছিলেন পয়লা বৈশাখ, ১৩২৮। এটি যদি ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার কোনও বিজ্ঞানীর লেখা বই হত, তা হলে বিশ্ব জুড়ে শতবর্ষ উদ্যাপন হত, যেমন আমরা দেখলাম ২০১৫ সালে, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের (জেনারেল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি) শতবর্ষে। তবে এ-ও ঠিক যে, ‘অব্যক্ত’ শব্দটার মধ্যেই একটা নিস্তব্ধতা রয়েছে, যেন তা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, পাঠকমহলে বইটিকে ঘিরে থাকবে নীরবতা। এর পাশাপাশি ইউলিসিস বা ওয়েস্টল্যান্ড-এর মতো বইয়ের একশো বছরে যে উচ্ছ্বাস, যত হইচই দেখা গেল, তার দিকে তাকালে বিস্ময় জাগে, দুঃখও হয়। আজ ঔপনিবেশিকতার প্রভাব থেকে মুক্তির কথা কত জোর দিয়ে কত ভাবে বলা হচ্ছে। এমন সম্ভাবনাময় মুহূর্তেও অব্যক্ত উপেক্ষিত— ১৯২২ সালে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বইয়ের যে তালিকা তৈরি করেছে উইকিপিডিয়া, তাতে স্থান পায়নি অব্যক্ত। পাশ্চাত্য ও বাকি বিশ্বের মধ্যে সাহিত্য-শিল্পের গতি এমনই একমুখী যে, ইউরোপ-আমেরিকার বিজ্ঞান-সাহিত্যের আলোচনায় এমন একটা বই স্রেফ ‘নেই’ হয়ে রয়েছে।
জগদীশচন্দ্রের প্রশিক্ষণ ভৌতবিজ্ঞানে— সেই সূত্রেই তিনি উদ্ভিদ ও ধাতুর আচরণে বেশ কিছু মিল লক্ষ করেন। নিজের ধারণাকে যাচাই করে দেখার জন্য কিছু পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করেন, সে সবের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির পরিকল্পনাও ছিল তাঁরই। অব্যক্ত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার বই বটে, কিন্তু উচ্চমার্গের শিল্প ও সাহিত্যে সৃষ্টি যে অর্থে পরীক্ষামূলক, সেই অর্থেও এই বইটি পরীক্ষামূলক, নতুন চিন্তাধারার অগ্রদূত। এর ভূমিকাটি পড়লে দুটো জিনিস চোখে পড়ে— বাংলা ভাষার প্রতি লেখকের দায়বদ্ধতা, এবং নিজের বৈজ্ঞানিক লেখালিখিকে আপন ভাষায় প্রকাশ করার আগ্রহ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার দু’মাস আগে জগদীশচন্দ্র বসু ‘উদ্ভিদ-স্বাক্ষর ও তার প্রকাশ’ বিষয়ে ব্রিটেনের রয়্যাল ইনস্টিটিউশনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। উদ্ভিদের প্রতি করুণার্দ্র, স্বকীয়তায় বিশিষ্ট, একটু উদ্ভট, কিন্তু পুরোদস্তুর বৈজ্ঞানিক সেই বক্তৃতা আজ পড়লে আইনজীবীর সওয়ালের কথা মনে করিয়ে দেয়— তিনি যেন জীবিতদের দেশে উদ্ভিদের নাগরিকত্বের দাবি প্রমাণ করার জন্য মরিয়া। তাঁর মতে, সেই দাবির প্রমাণ হল ‘তরুলিপি,’ যার সাহায্যে নিজেদের কথা লিখছে গাছেরাই— “গাছের প্রকৃত ইতিহাস সমুদ্ধার করিতে হইলে গাছের নিকটই যাইতে হইবে। সেই ইতিহাস অতি জটিল এবং বহু রহস্যপূর্ণ। সেই ইতিহাস উদ্ধার করিতে হইলে বৃক্ষ ও যন্ত্রের সাহায্যে জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত মুহূর্তে মুহূর্তে তাহার ক্রিয়াকলাপ লিপিবদ্ধ করিতে হইবে। এই লিপি বৃক্ষের স্বলিখিত এবং স্বাক্ষরিত হওয়া চাই।”
গাছেদের স্বাক্ষরিত ইতিহাস, যা অব্যক্ত রয়েছে, তরুলিপির মাধ্যমে তাকে ব্যক্ত করতে চাইছেন জগদীশচন্দ্র। গাছের ‘স্বল্প আকুঞ্চন বৃহদাকারে লিপিবদ্ধ’ করতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। তিনি এ কথা লিখছেন যে সময়ে, তখন ‘মডার্নিজ়ম’ বা আধুনিকতাবাদের জোয়ার তুঙ্গে, সাহিত্যে এবং শিল্পে তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব চাইতে আগ্রহোদ্দীপক প্রণালী হল আত্মজীবনী। যাঁরা এত দিন সাহিত্য-সংস্কৃতির বলয়ে প্রবেশ করতে পারেননি কিছু দ্বাররক্ষকের বাধায়, তাঁদের প্রবেশপথ হয়ে উঠছে আত্মজীবনী। এই সময়ে গাছের স্বাক্ষর, গাছের আত্মজীবনী, দুইয়ের প্রতি আগ্রহই তো স্বাভাবিক। জগদীশচন্দ্র যেন এই পরিধিকে আরও বিস্তৃত করার কথা বলছেন— যারা মানুষের ভাষার শরিক নয়, তারাও মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারে ‘তরুলিপি’ যন্ত্র দিয়ে। কণ্ঠহীন জনগোষ্ঠীর মতো, গাছেরাও আর কেবল ‘অপর’ হয়ে থাকবে না। যাদের সম্পর্কে রিপোর্ট লেখা হয়, যাদের বয়ান লেখা হয় কেবল অন্যের ভাষায়, গাছেরা তাদের দলে থাকবে না আর।
জগদীশচন্দ্র যা তৈরি করতে চাইছেন, তা বিজ্ঞানের নিজস্ব ভাষা— যা প্রতিক্রিয়াকে স্পষ্ট ভাবে মাপতে পারে। তিনি এমন ভাষার ধারণা যতটা পেয়েছিলেন পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের রীতিনীতি থেকে, সম্ভবত ততটাই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন সাংখ্যদর্শনের সংস্কৃতি-উদ্ভূত বোধ থেকে। এর দ্বারা তিনি কার্যত চ্যালেঞ্জ করছেন অ্যারিস্টটলের সময় থেকে চলে আসা প্রাণিজগতের পাশ্চাত্য ধারণাকে, যেখানে গাছেদের জীবতালিকার একেবারে নীচে স্থান দেওয়া হয়। গাছকে প্রাণিজগতের সঙ্গে সমান মর্যাদা দেওয়ার এই আগ্রহের পিছনে জীবজগৎ সম্পর্কে বৌদ্ধ দর্শন এবং উপনিষদের ধারণাও কাজ করে থাকতে পারে। সেখানে উদ্ভিদ, মানুষ, জন্তু, পাথর ও মৌলিক পদার্থগুলির পার্থক্য গ্রহণ করার পরেও সর্বত্র চৈতন্যের উপস্থিতি, এবং প্রত্যেকের নিজস্ব অধিকারের স্বীকৃতির কথা বলা হয়েছে।
এখানেই জগদীশচন্দ্রকে বার বার সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। গার্টা ভনউবিশ বলেছিলেন, “সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানকে সুন্দর, বিচিত্র কল্পকথার সঙ্গে এক করে ফেলাটা বন্ধ করা আমাদের কর্তব্য। আমরা রূপকথার বই চাই, বিজ্ঞানের বইও চাই, কিন্তু সর্বজনীন সাহিত্যে এই দুটোর মিশ্রণ চাই না।”
গবেষণার শুরুতে জগদীশচন্দ্রের মনোভাবের যে বিবরণ মেলে, তা পড়লে আমরা বুঝি যে, গাছের স্নায়ুতন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণের উদ্যোগের প্রাক্কালে কত প্রশ্ন আন্দোলিত করেছিল তাঁর মনকে: “আমাদের স্নায়বিক ক্রিয়ার সহিত বৃক্ষের ক্রিয়ার কি সাদৃশ্য আছে? ...জীবে হৃৎপিণ্ডের ন্যায় যেরূপ স্পন্দনশীল পেশী আছে, উদ্ভিদে কি তাহা আছে? স্বতঃস্পন্দনের অর্থ কী? পরিশেষে যখন প্রবল আঘাতে বৃক্ষের জীবনদীপ নির্বাপিত হয়, সেই নির্বাণ-মুহূর্ত কি ধরিতে পারা যায়? এবং সেই মুহূর্তে কি বৃক্ষ কোনও একটা প্রকাণ্ড সাড়া দিয়া চিরকালের জন্য নিদ্রিত হয়?”
তার পর আমরা প্রবেশের অনুমতি পাই সেই সৃষ্টিচিন্তায়, যা এত রকম যন্ত্র তৈরি করেছিল— ইলেক্ট্রো-অপটিক অ্যানালগ, শিল্ডেড লেন্স অ্যান্টেনা, রেসোনেন্ট রেকর্ডার, ফাইটোগ্রাফ, প্লান্ট ফোটোগ্রাফ, অটোম্যাটিক ফোটোগ্রাফ, বাবলার ইনস্ট্রুমেন্ট, প্লান্ট স্ফাইমোগ্রাফ, এবং সেই যন্ত্রটি যা সর্বাধিক পরিচিত— ক্রেস্কোগ্রাফ। এই সব যন্ত্রের পরিকল্পনা সম্ভব হয়েছিল তাঁর ভৌতবিজ্ঞান এবং উদ্ভিদবিজ্ঞানের জগতে অবাধ বিচরণের ফলে। এত যন্ত্র তৈরিতে তাঁর একমাত্র সহায়ক ছিলেন পুঁটিরাম দাস, যিনি ছিলেন টিনের মিস্ত্রি। যদিও জগদীশচন্দ্রকে বিচিত্র উপায়ে সম্মান করা হয়েছে— চাঁদের একটা গহ্বর তাঁর নামে নামাঙ্কিত— তাঁর কেরিয়ারের অধিকাংশ সময়টা নানা বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে। কর্মজীবনের শুরুতে প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁকে ব্রিটিশদের সমান বেতন দেওয়া হত না বলে বছর দুয়েক তিনি বেতন নিতে অস্বীকার করেন, যত দিন না সমান বেতন পান। তাঁর কাজকে খাপছাড়া, অবৈজ্ঞানিক বলা হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে পাশ্চাত্য জগতে তাঁকে উপহাস করা হয়— বলা হয় তিনি গাছের প্রতিক্রিয়া, বার্তাপ্রেরণকল্পনা করেছিলেন। আজ সে সব কথাই হাস্যাস্পদ হয়ে উঠেছে। এখন সুজ়ান সিমরাডের মতো বিজ্ঞানীদের গবেষণা গাছেদের পরস্পর সংযোগের কথাই প্রতিষ্ঠা করছে। যে দাবি জগদীশচন্দ্র করেছিলেন তাঁর নিজের মতো করে, একশো বছর আগে, এখন সেই সবের, এবং তার সম্পৃক্ত নানা দাবির প্রতিষ্ঠা হয়ে চলেছে।
ইংরেজি ও সৃজনশীল রচনা বিভাগ,অশোকা ইউনিভার্সিটি