গত শতকের সত্তরের দশকের শেষ ভাগে, বিশেষত ১৯৭৮ সালে চিন যখন মুক্ত ও বাজার অর্থনীতির পথে পা ফেলল, তখন থেকেই উন্নয়নশীল দেশগুলির উপরে অর্থনীতির দরজা উন্মুক্ত করে বাজার-অর্থনীতি গ্রহণ করার জন্য চাপ বাড়তে লাগল। ভারতের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। আশির দশকেই আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন দেখা গেল। বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়তে লাগল— তার সহজ প্রমাণ, আশির দশকের শুরু থেকে শেষ পর্যায়ের মধ্যে ভারতের মোট আমদানিতে অন্তর্বর্তী পণ্য ও মূলধনি পণ্যের আপেক্ষিক গুরুত্ব অনেকখানি বাড়ে। এই মূলধনি পণ্যের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ ছিল পরিবহণ সরঞ্জাম। ১৯৮৩ সালে ভোগ্যপণ্য ক্ষেত্র ও শিল্পক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক্স সেক্টরের জন্য সরকারি লাইসেন্স প্রথা বাতিল করেন। এই সময় বেশ কয়েকটি বড় জাপানি মোটরসাইকেল নির্মাতা সংস্থা একাধিক ভারতীয় সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাধে। ভারতে দ্বিচক্রযানের উৎপাদনও বাড়ে তাৎপর্যপূর্ণ হারে। একই রকম পরিবর্তন ঘটে টিভি উৎপাদনের ক্ষেত্রে। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে ভারতে টিভির উৎপাদন আট গুণ বেড়েছিল। এই বৃদ্ধিও ছিল আমদানি-নির্ভর। ১৯৯১ সালে ভারতে যে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, তার সূত্রপাত আশির দশকের অতি আমদানি-নির্ভরতায়। অন্য দিকে, এই সময়কালে কৃষিক্ষেত্রে মোট মূলধন গঠনের বার্ষিক পরিমাণ টাকার অঙ্কেই হ্রাস পায়। এই সময়ে কৃষি লভ্যাংশের একটা বড় অংশই কৃষির উন্নতিতে বিনিয়োগ না করে কৃষকেরা টিভি ও দু’চাকা যানের জন্য খরচ করেন।
এশিয়ার মুক্ত অর্থনীতির প্রবক্তাদের কাছে তখন চিন উন্নয়নের এক দারুণ উদাহরণ— সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলিও, বিশেষত দক্ষিণ কোরিয়া, তাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর। ভাবখানা এমন, যেন জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারকে বাড়িয়ে ফেলতে পারলেই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের সব রোগ নিরাময় হবে। বাজার অর্থনীতির ফলে দেশের জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি ঘটলে তার চুইয়ে-পড়া প্রভাবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটবে। যাঁরা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেননি, তাঁরাই ইউএনডিপির পক্ষ থেকে ১৯৯০ সালে প্রথম মানব উন্নয়ন রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এতে প্রধান ভূমিকা ছিল বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং পাকিস্তানের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী মহবুব উল-হকের; পরামর্শদাতা হিসাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অমর্ত্য সেন, পল স্ট্রিটেন, মেঘনাদ দেশাই প্রমুখ।
এই প্রতিবেদনের মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের জীবনযাত্রার মানের সার্বিক উন্নতি ঘটানো— যেমন, সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন, শিক্ষার সুযোগ, ও যথাযোগ্য জীবনযাত্রা ইত্যাদি নিশ্চিত করা। শ্রীলঙ্কার মানব উন্নয়ন এঁদের অনেককেই অনুপ্রাণিত করেছিল, বিশেষ করে অমর্ত্য সেনকে। ১৯৯০ সালে মাথাপিছু জাতীয় আয় মাত্র ৪৬৭ ডলার হওয়া সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা পৃথিবীর ১৩টি দেশের মধ্যে মানব উন্নয়নের সূচকের ক্ষেত্রে ৪৮তম স্থানে ছিল। অন্য দিকে, মাথাপিছু জাতীয় আয় (২৬৬৮৩ ডলার) শ্রীলঙ্কার বহু গুণ হওয়া সত্ত্বেও সংযুক্ত আরব আমিরশাহি মানব উন্নয়নের সূচকের ক্ষেত্রে ছিল ৫৪তম স্থানে, দক্ষিণ আফ্রিকা (মাথাপিছু আয় ৩১৬১ ডলার) মানব উন্নয়নে ৬৩তম স্থানে। এই প্রতিবেদন ও পরবর্তী কালে প্রতি বছর প্রকাশিত মানব উন্নয়ন সূচক উন্নয়নশীল দুনিয়ার রাষ্ট্রনায়কদের শুধুমাত্র জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি থেকে নজর সরিয়ে অন্য সূচকগুলির দিকেও নজর দিতে বলছে।
মানব উন্নয়ন সূচক বিভিন্ন দিকে সমানেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে— যেমন, সামাজিক ব্যয় পুনর্বণ্টন; উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রক কাঠামো গড়ে তোলা, যা অবশ্যই সুবিবেচনা মূলক সামাজিক নীতিকর্মের দ্বারা পরিচালিত; উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ; বৈষম্য দূর করে নারী উন্নয়ন; দারিদ্র দূরীকরণ ইত্যাদি। সংশয় জাগিয়ে সতর্ক করেছে শুধু জাতীয় আয় বৃদ্ধি নির্ভর সামগ্রিক উন্নয়নে; বলেছে, গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করলে মুক্ত অর্থনীতির সুফল সামগ্রিক উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে। সকলকে মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে যে, ধারাবাহিক ভাবে জাতীয় আয় বৃদ্ধি না হওয়া সত্ত্বেও দেশের মানুষের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব এবং তা ঘটেছে। দুনিয়া জুড়ে দারিদ্র অনেকটা কমেছে
ঠিকই, কিন্তু বৈষম্য অনেক ক্ষেত্রেই বেড়েছে। ইউএনডিপি-র সর্বশেষ (২০২৩-২৪) প্রতিবেদনটিতে মানব উন্নয়নের সূচকের নিরিখে এগিয়ে থাকা দেশগুলির সঙ্গে পিছিয়ে পড়া দেশগুলির বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে ভারতের সার্বিক উন্নয়নের কথা প্রচার করার সময় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলা হচ্ছে যে, জাতীয় আয়ের নিরিখে ভারত গোটা দুনিয়ায় পঞ্চম স্থানে পৌঁছে গেছে। আশা করা হচ্ছে যে, আমাদের দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার পৃথিবীর সকল দেশকে অচিরে ছাড়িয়ে যাবে। আমাদের দেশের মোট জাতীয় আয় এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার নিশ্চয়ই খুবই আশাব্যঞ্জক, কিন্তু আমরা যদি মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান পর্যালোচনা করি, তা হলে দেখা যাবে যে, আমাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় বর্তমানে (২০২৩) মাত্র ২৪৮৪ ডলার। এই নিরিখে পৃথিবীর প্রায় ২০০টি দেশের মধ্যে ভারত ১৫৬তম স্থানে, যা শ্রীলঙ্কা (৩৮২৮ ডলার), ভুটান (৩৭০৪ ডলার) এমনকি বাংলাদেশের (২৫২৯ ডলার) চেয়েও কম। মানব উন্নয়নের সূচকের ক্ষেত্রেও আমরা নিঃশব্দে পিছিয়ে যাচ্ছি। সর্বশেষ প্রকাশিত হিউম্যান ডেভলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২৩-২৪ অনুযায়ী, ১৯৩টি দেশের মধ্যে ভারত ১৩৪তম স্থানে, ভারতের চেয়ে ভাল অবস্থায় ১২৯তম স্থানে ভুটান, ১২৫তম স্থানে বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা ৭৮তম স্থানে।
ইউএনডিপি-অক্সফোর্ড প্রকাশিত মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতে ২০১৯-২১ সালে ১৬.১৯% মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে ছিলেন। নীতি আয়োগ এই নির্ণয় পদ্ধতিতে আংশিক পরিবর্তন করেছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী এই দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষের হার ১৪.৯৬%, অর্থাৎ প্রতি সাত জনের মধ্যে এক জন ভারতীয় দারিদ্রসীমার নীচে। পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা-র (২০১৯-২১) প্রতিবেদনে সম্পদ-সূচকের কথা বলা আছে। মূলত পরিবারের সম্পদের কয়েকটি তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি এই সম্পদ-সূচক— যেমন, পানীয় জলের উৎস কী; কোন ধরনের শৌচাগার ব্যবহৃত হয়; বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে কি না; প্রেশার কুকার, চেয়ার, খাট, টেবিল, ইলেকট্রিক ফ্যান, রেডিয়ো-টেলিভিশন, সেলাই মেশিন, ফোন, কম্পিউটার, ঘড়ি, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, জলের পাম্প, ট্র্যাক্টর ইত্যাদি আছে কি না; রান্নায় ব্যবহৃত জ্বালানি কী; ঘরের ছাদ,
মেঝে ও দেওয়াল তৈরি করতে কী সামগ্রী ব্যবহৃত হয়েছে ইত্যাদি।
অর্থশাস্ত্রে ‘জিনি কোএফিশিয়েন্ট’ বৈষম্য পরিমাপের একটি বহুলব্যবহৃত পন্থা। এই সূচকের মান ০ থেকে ১-এর মধ্যে থাকে। যদি এর মান শূন্য বা তার কাছাকাছি হয়, তবে ধরে নেওয়া যায় যে, বৈষম্য প্রায় নেই বললেই চলে। অন্য দিকে, সূচকটির মান যদি এক বা তার কাছাকাছি থাকে, তা হলে বুঝতে হবে যে, বিপুল বৈষম্য আছে। উপরে যে সম্পদ-সূচকের কথা বললাম, তার ভিত্তিতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের জন্য জিনি কোএফিশিয়েন্ট হিসাব করা হয়েছে। সামগ্রিক ভাবে গোটা দেশের জন্য এই কোএফিশিয়েন্ট ০.২০। রাজ্যগুলির মধ্যে সম্পদের এই বৈষম্য সবচেয়ে কম কেরলে (জিনি কোএফিশিয়েন্ট ০.০৯৫), এর পর পঞ্জাব (০.১০৩), তেলঙ্গানা (০.১০৪) এবং তামিলনাড়ু (০.১০৫)। অন্য দিকে, সবচেয়ে বেশি বৈষম্য হল ঝাড়খণ্ড (জিনি কোএফিশিয়েন্ট ০.২৭২), মেঘালয় (০.২৫৩), অসম (০.২৪৮) এবং পশ্চিমবঙ্গ (০.২৪৫)। পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলির মধ্যে এই বৈষম্যের হার সবচেয়ে বেশি পুরুলিয়ায় (জিনি কোএফিশিয়েন্ট ০.৩৫৭), আর সবচেয়ে কম দার্জিলিংয়ে (০.১৬২)।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা যদি জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারে উল্লসিত হয়ে সমস্ত মানুষের জীবনযাত্রার মানের সার্বিক ও দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে ভুলে যাই, তা হলে নিঃসন্দেহে আমরা সঠিক উন্নয়নের পথ
হারিয়ে ফেলব।