সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনের দুর্নীতি উপলব্ধি (করাপশন পারসেপশন) সূচক ২০২৩-এ জানা গেল, দুর্নীতি কম এমন প্রথম ছ’টি দেশের মধ্যে তিনটি দেশই স্ক্যান্ডিনেভিয়ার। ডেনমার্ক, নরওয়ে ও সুইডেন। ভারত ৯৩তম।
এই সব দেশ রাতারাতি স্বপ্নের দেশে রূপান্তরিত হয়নি। সেখানেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। যেমন ডেনমার্কে সপ্তদশ শতাব্দীতে দুর্নীতির সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান উদাহরণ ঘুষকে দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করা হয়। উনিশ শতকে সরকারি কর্মচারীদের কাজের নৈতিক মানদণ্ড চালু হয়। পরবর্তী কালে নিরন্তর তার পর্যবেক্ষণ চলছে। ১৮৮৩-তে মানুষের তীব্র প্রতিবাদে আমেরিকায় সরকারি প্রশাসক নিয়োগে আইন করে রাজনৈতিক পক্ষপাত বন্ধ হয়। চালু হয় যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ। দুর্নীতি বন্ধে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলির সাফল্যের নেপথ্যে আছে দীর্ঘ আন্দোলনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শাসকের উপর সমাজের নিয়ন্ত্রণ এবং সরকার দ্বারা শাসক ও সমাজের মধ্যে যুক্তিসম্মত পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ। তবে এও ঠিক, প্রায় দুর্নীতিমুক্ত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে সামাজিক সুরক্ষা অত্যন্ত সুদৃঢ়, যা সত্যিকে প্রকাশ্যে ও জোর দিয়ে বলতে সাহস দেয়। এই সুরক্ষা এখানে কোথায়?
ইউনাইটেড নেশনস ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি), বিশ্ব ব্যাঙ্ক, ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) ইত্যাদি উন্নয়ন সংস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলির দুর্নীতি নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত। দুর্নীতি একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। ইউএনডিপির একটি প্রতিবেদনে দুর্নীতির রকমফেরের তালিকায় ঘুষের উল্লেখ রয়েছে প্রথমেই। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য প্রতারণা, অবৈধ জুলুম, ব্যবসায়িক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি, আত্মসাৎ, সরকারি সম্পত্তির ও ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি।
দুর্নীতি সমাজের বিভিন্ন স্তরে হতে পারে। ছোটখাটো দুর্নীতি তৃণমূল স্তরে সাধারণ নাগরিক, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। বড় ধরনের দুর্নীতির মধ্যে পড়ে সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের প্রতিনিধিদের দ্বারা বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ। ব্যক্তিগত লাভ বা রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার হল রাজনৈতিক দুর্নীতি। যেমন ভোট কেনা, নির্বাচনে কারচুপি, দলীয় সম্পদবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক স্বার্থে সরকারি সম্পত্তির অপব্যবহার। নব্বইয়ের দশকের গোড়াতে বিশ্ব উন্নয়ন সংস্থাগুলির বিশ্বাস ছিল সব রকম দুর্নীতির মূল একচেটিয়া ব্যবসা ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ। সে সময় সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর অনেকেই দেশটির উদাহরণ দেখিয়ে বাজারি মুক্ত অর্থনীতির পক্ষে সওয়াল করছিলেন। বিশ্বাস ছিল, এ ভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে নিশ্চয়ই দুর্নীতি অনেকটাই কমবে। ভারতের ক্ষেত্রে এই পথ অনেকটাই ব্যর্থ বলে প্রমাণিত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ১৯৯৫-এ জানায় ভারতের দুর্নীতির উপলব্ধি সূচক ১০-এ ২.৭৮। ২০১১-য় সামান্য বেড়ে তা হয় ৩.১০। ২০১২-য় মূল্যায়নের পদ্ধতির কিছু পরিবর্তন করেছে সংস্থাটি। ২০১২-য় আমাদের স্কোর ছিল ১০০-য় ৩৬ আর সর্বশেষ প্রতিবেদনে ২০২৩-এ আমরা যৎকিঞ্চিৎ উন্নতি ঘটিয়ে এখন মাত্র ৩৯। ১৮০টি দেশের মধ্যে ৯৩তম স্থানে।
বিশ্বব্যাঙ্ক দুর্নীতির সমাধানে সুশাসনকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রনায়কদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শাসনপ্রক্রিয়ার ছ’টি বিষয় নিয়ে ‘বিশ্বব্যাপী শাসনপ্রক্রিয়া সূচক’ প্রবর্তন করেছে। তার অন্যতম দুর্নীতি দমন। বলা হয়েছে, উন্নয়নের জন্য সুশাসন অপরিহার্য। সুশাসন দেশগুলির অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, মানব পুঁজি তৈরি এবং সামাজিক সংহতি জোরদার করতে সহায়ক। ‘বিশ্বব্যাপী শাসনপ্রক্রিয়া সূচক’-এর অন্তর্ভুক্ত দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সূচকটির মান ছিল -২.৫ (খুবই খারাপ) থেকে ২.৫ (যথেষ্ট ভাল)। ১৯৯৬-এর প্রতিবেদনে ভারতের মান ছিল -০.৩৮। যৎসামান্য শুধরে ২০২২-এ -০.৩২ হয়েছে।
সর্বশেষ প্রকাশিত হিউম্যান ডেভলপমেন্ট রিপোর্ট ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন থেকে ১৭৬টি দেশের জীবনযাত্রার মানের সূচক এবং দুর্নীতি উপলব্ধি সূচকের পারস্পরিক সম্পর্ক বিচারের পর দেখা গিয়েছে, দুর্নীতির সঙ্গে জীবনযাত্রার মানের উন্নতির গভীর ধনাত্মক সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, দুর্নীতি উপলব্ধি সূচক বেশি মানে দুর্নীতির প্রকোপ কম। উন্নয়নশীল দেশগুলি কেমন করে দ্রুত দুর্নীতি দূর করবে, কেউই সহজ সমাধান দিতে পারেনি, বিক্ষিপ্ত টোটকা ছাড়া। যেমন, জনসেবামূলক পরিষেবায় থাকুক প্রযুক্তির ব্যবহার। আমাদের দেশে তো সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সিলেবাসে নৈতিকতা, সততা ২০১৩-য় যুক্ত হয়েছে। যেন এই বিষয়গুলি পড়ে প্রশাসনে এলে দুর্নীতি কমবে! তার কোনও প্রভাব প্রশাসনের দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে চোখেও পড়েনি। তবে সমাধান বার করাটা কঠিন হলেও তার খোঁজ করা অত্যন্ত জরুরি।
দুর্নীতির সমস্যা জটিল, ভয়ঙ্কর, সর্বগ্রাসী। একে সমূলে বিনষ্ট করা গিয়েছে মনে হলেও নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। শ্রীকৃষ্ণের সেই শ্লোক মনে পড়ে, ‘ধর্মংস্থাপানার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে’। দুর্নীতি দমন করি কিন্তু থেকে যাই না মর্ত্যভূমিতে। আর এই অমোঘ সত্যটি উপলব্ধি করেই তো স্বাধীন ভারতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যোদ্ধা জয়প্রকাশ নারায়ণ, অণ্ণা হজারে লড়াই শেষে চলে গিয়েছেন গভীর অন্তরালে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজন দীর্ঘকালীন সংগ্রাম, যে পথে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলি নিজেদের মুক্ত রাখতে পেরেছে, যা সম্ভব হয়েছিল শাসকদের উপর সমাজের নিয়ন্ত্রণ দ্বারা। আর জি কর কাণ্ডের পর প্রতিবাদী মেয়েদের রাত দখল অভিযান কি আমাদের তেমন কোনও পথের দিশা দেখাচ্ছে? এই অভিযান সেই কাঙ্ক্ষিত নিয়ন্ত্রণের পথে আমাদের নিয়ে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, যাদের বিচার করার কথা তারাও একই সুরে বলছে, ‘বিচার চাই’! এই অভিযান আরও সঙ্ঘবদ্ধ, সুদৃঢ় ও সর্বগামী হোক, তাতে নিশ্চয়ই কিছুটা এগোনো যাবে।