২০২১-২২ অর্থবর্ষে ভারত এই প্রথম ৪০,০০০ কোটি ডলারের বেশি অঙ্কের রফতানি করে একটি মাইলফলক অর্জন করেছে। এর আগে সর্বোচ্চ রফতানি হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে— এ বার রফতানির পরিমাণ তার চেয়েও ২৫ শতাংশ বেশি। এ বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত অর্থবর্ষের ক্ষেত্রভিত্তিক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এই রেকর্ড রফতানির পিছনে কৃষি-সহ সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেরই অবদান রয়েছে। বেশ কিছু কৃষিপণ্য, বিশেষত চাল, গম এবং চিনি সাহায্য করেছে এই বৃদ্ধিতে। ২০২১-এর এপ্রিল থেকে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চালের রফতানি ২০১৮-১৯’এর একই সময়কালের তুলনায় বেড়েছে ৫৯ শতাংশ; চিনির রফতানি বেড়েছে পাঁচ গুণ; গমের রফতানি বেড়েছে ৩৩ গুণ।
২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬৬ লক্ষ টন গম, ১৯০ লক্ষ টন চাল এবং ৯৪ লক্ষ টন চিনি রফতানি করেছে ভারত। স্বভাবতই গত কয়েক বছরে বিশ্ববাজারে এই সব পণ্যের ক্ষেত্রে ভারতের স্থান আরও মজবুত হয়েছে। আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট চাল রফতানিতে ভারতের অংশ ২০১৮-১৯’এ ২২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১-২২’এ ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গমের ক্ষেত্রে তা ০.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালে বিশ্বের মোট চিনি রফতানির ৩.৪ শতাংশ ছিল ভারতের দখলে, ২০২১-২২ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশের বেশি। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ক্রমাগত সাত বছর ধরে রেকর্ড মাত্রার খাদ্যশস্য উৎপাদনের ফলে বর্তমান আর্থিক বর্ষে খাদ্যশস্যের রফতানির পরিমাণ আরও বাড়ার সম্ভাবনা। বাজারের প্রত্যাশা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এ বছর ভারতের গমের রফতানি ৬৬ লক্ষ টন থেকে বেড়ে হবে ১.২-১.৩ কোটি টন।
কিন্তু, আন্তর্জাতিক কৃষি বাজারে ভারতের এই দ্রুত উত্থান আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো এই বাজারের প্রভাবশালী দেশগুলি ভাল চোখে দেখেনি। ফলস্বরূপ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজ়েশন বা ডব্লিউটিও) ভারতের কৃষিপণ্য রফতানির বিরুদ্ধে নালিশ জানায় সংস্থার বেশ কিছু সদস্য দেশ। তাদের দাবি ছিল যে, ডব্লিউটিও-র কৃষিপণ্য এবং তার বাণিজ্য সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি (এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার বা এওএ)-র নিয়মগুলি ভেঙে রফতানি বাড়িয়েছে ভারত। প্রথম নালিশটি হয় ২০১৯ সালে, যখন অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল এবং গুয়াতেমালা ডব্লিউটিও-র বাণিজ্য সংক্রান্ত বিবাদের নিষ্পত্তি করার কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ জানায় যে, ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলি শুগার মিলগুলিকে চাষিদের থেকে আখ কেনার জন্য ফেয়ার অ্যান্ড রেমুনারেটিভ প্রাইস (এফআরপি) এবং স্টেট অ্যাডভাইসড প্রাইস (এসএপি)-র মাধ্যমে যে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়, তা এওএ-র ভর্তুকি সংক্রান্ত নীতিগুলি লঙ্ঘন করেছিল। নালিশে এ-ও বলা হয় যে, এওএ-র নিয়মানুযায়ী নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চিনির রফতানি বাড়ানোর জন্য কৃষকদের ভর্তুকি দিচ্ছিল। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চিন এবং রাশিয়া-সহ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অন্য তেরোটি সদস্য দেশ তৃতীয় পক্ষ হিসেবে এই বিতর্কে অংশ নেয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সংস্থার বিবাদ নিষ্পত্তিকারক বিচারকরা অভিযোগকারীদের পক্ষেই রায় দেন।
বর্তমানে ভারত আরও বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কমিটি অন এগ্রিকালচারে ভারতের খাদ্যশস্য রফতানির ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বর্তমান বিবাদের কেন্দ্রে রয়েছে ২০১৩ সালে বালিতে আয়োজিত মন্ত্রিস্তরের সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত— দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার যদি খাদ্যশস্য মজুত করে, তবে তা সেই সিদ্ধান্ত অনুসারেই হওয়ার কথা। সেই মন্ত্রিস্তরের সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য ছিল এওএ-র নীতিগুলি সেই সব দেশের উপরে পুনরায় বলবৎ করা, যেখানে দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার খাদ্যশস্য মজুত করে। ভারতের গণবণ্টন ব্যবস্থা তেমনই একটি প্রকল্প। এওএ অনুসারে, যে সব সরকার খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্প চালায়, তারা খাদ্যশস্যের ভান্ডার তৈরি করতে একটি নির্দিষ্ট দামে এই পণ্য সংগ্রহ করতে পারে। ভারতের ক্ষেত্রে সেটা হল ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস বা এমএসপি)। কিন্তু, এখানে একটি শর্ত আছে। পূর্বনির্ধারিত দামে পণ্য কেনা তখনই বৈধ, যখন সরকার সেই দামেই সেই খাদ্যশস্য বিক্রি করবে। অর্থাৎ, ভারতে কৃষকের থেকে এমএসপি-তে চাল কিনলে সরকারকে সেই দামেই সেই চাল বিক্রি করতে হবে— কম দামে, অর্থাৎ ভর্তুকি দিয়ে, বিক্রি করা যাবে না। তা সত্ত্বেও যদি সরকার ভর্তুকি দিয়েই খাদ্যশস্য বিক্রি করে— যেমন ভারত করে— তা হলে, ১৯৮৬-৮৮ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে সেই খাদ্যশস্যের যা দাম ছিল, তার সঙ্গে দেশের বর্তমান ভর্তুকিযুক্ত দামের ব্যবধানকে ভর্তুকির মাধ্যমে বণ্টিত চালের মোট পরিমাণকে গুণ করে, সেই টাকার অঙ্কটি যোগ করতে হবে দেশের মোট ভর্তুকির পরিমাণে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা যাবে না, কারণ এওএ-র শর্ত অনুযায়ী, দেশের কৃষিজাত পণ্যের ভর্তুকির অঙ্ক মোট উৎপাদনের মূল্যের ১০ শতাংশের বেশি হবে না। গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্যশস্যে ভর্তুকির সঙ্গে এমএসপি ও ইনপুট সাবসিডির মাধ্যমে কৃষকদের দেওয়ার মোট ভর্তুকির অঙ্ক যোগ করলে তা এই দশ শতাংশের সীমা অতিক্রম করে যাবে।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্যশস্য মজুত করা বিষয়ে এওএ-র যে নিয়মাবলি রয়েছে, সেগুলি নিয়ে নানা দিক থেকে প্রশ্ন তোলা যায়। প্রথমত, কোনও সার্বভৌম দেশ কী ভাবে তার নাগরিকদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সে বিষয়ে শর্ত আরোপের অধিকার কি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার থাকতে পারে? দ্বিতীয়ত, যদি আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যের সঙ্গে এমএসপি-র তুলনা করাই উদ্দেশ্য হয়, তবে ১৯৮৬-৮৮ সালের আন্তর্জাতিক মূল্যস্তরের সঙ্গে তুলনা করার যৌক্তিকতা কোথায়? ভারত এ ক্ষেত্রে যুক্তি দিয়েছে যে, হয় সাম্প্রতিক কালের কোনও আন্তর্জাতিক মূল্য বা এক্সটারনাল রেফারেন্স প্রাইসেস ধরে এই তুল্যমূল্য বিচার করা হোক, অথবা গত ৩৪ বছরের মূল্যস্ফীতির পরিমাণকে হিসাবের মধ্যে নিয়ে ভর্তুকির বিষয়টি বিবেচনা করা হোক। তৃতীয়ত, আর্থিক ভাবে পশ্চাৎপদ মানুষদের জন্য খাদ্যপণ্যের উপরে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তার সঙ্গে কোন যুক্তিগ্রাহ্য নীতিতে চাষিদের দেওয়া ভর্তুকির প্রকল্প মেলানো যায়? আসলে, খাদ্যশস্য মজুত বিষয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কী ভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির স্বার্থের পরিপন্থী অবস্থান নিয়েছিল, এই উদাহরণগুলি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।।
যে দিন থেকে তৎকালীন সরকার দেশের দুই-তৃতীয়াংশ জনসাধারণকে ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যপণ্য দেওয়ার জন্য জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন (এনএফএসএ) প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়, সে দিনই বোঝা গিয়েছিল যে, এই ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে এওএ-র নিয়মগুলি। যদিও ২০১৩ সালে বালিতে মন্ত্রিস্তরের সম্মেলনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলি সাময়িক ভাবে একমত হয় যে, জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে ভারত যদি ভর্তুকির ১০ শতাংশের মাত্রাটি লঙ্ঘনও করে, তা হলেও ভারতকে কোনও বিতর্কে জড়ানো হবে না। এই তথাকথিত ‘শান্তি চুক্তি’টি অনুমোদিত হয় ২০১৫ সালে। স্থির হয়েছিল যে, যত দিন অবধি ভারতের গণবণ্টন ব্যবস্থা ও এওএ-র মধ্যে বিরোধের কোনও ‘স্থায়ী সমাধানসূত্র’ না পাওয়া যায়, তত দিন অবধি ভারতকে তার খাদ্য নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করতে দেওয়া হবে।
এই ‘শান্তি চুক্তি’র মধ্যে কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে— কেন্দ্রীয় সরকারের খাদ্য ভান্ডার থেকে কোনও কিছু রফতানি করা যাবে না। ভারত থেকে সাম্প্রতিক কালে খাদ্যশস্য রফতানির পরিমাণ বাড়ায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যরা প্রশ্ন তুলেছে যে, ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া-র খোলা বাজারে বিক্রির প্রকল্পের অন্তর্গত পূর্ব-নির্ধারিত দামে যে গম আর চাল খোলা বাজারে পাওয়া যায়, সেটাই ভারতের খাদ্যশস্য রফতানি বৃদ্ধি করেনি তো? প্রশ্ন হল, এই ধরনের চ্যালেঞ্জের প্রত্যুত্তর দেওয়ার মতো কৌশল সরকারের তৈরি আছে তো?
সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ় অ্যান্ড প্ল্যানিং, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়