সূচনা: পাঞ্চেত জলাধারের উদ্বোধন করছেন আদিবাসী তরুণী বুধনি মেঝন। পাশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৫৯
ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি অবশ্যই উদ্যাপন করার মুহূর্ত, কিন্তু একই সঙ্গে দু’দণ্ড থমকে দাঁড়িয়ে এটাও ভাবা প্রয়োজন যে, এতটা পথ পেরিয়ে আসতে গিয়ে আমরা কোন কাজগুলো ঠিক করলাম, আর কোনগুলো ভুল। আজ দেশ একটা পথসন্ধিতে দাঁড়িয়ে— আমাদের রাজনীতির মেরুকরণ সম্পূর্ণ, সমাজে তার ছাপ প্রকট, অর্থব্যবস্থা গতি হারিয়েছে, এবং দেশে এখন একই সঙ্গে চড়া বেকারত্ব ও চড়া মূল্যস্ফীতি চলছে, যা সচরাচর দেখা যায় না। এই অস্থিরতা কি নতুন উচ্চতায় পৌঁছনোর জন্য যাত্রা শুরু করার প্রাক্মুহূর্ত, না কি এ এক পতনের সূচনালগ্ন? স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো নিয়ে ভাবা যায়, ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বর্তমানকে বোঝা যায়, যাতে আমরা উন্নতির পথটিই বাছতে পারি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এশিয়া এবং আফ্রিকার বহু দেশে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটল, দেশগুলি স্বাধীন হল। ভারতে যেমন ছিলেন জওহরলাল নেহরু, উপনিবেশ-উত্তর পৃথিবীতে তেমনই ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, পাকিস্তানের জিন্না, ঘানার এনক্রুমা, তানজানিয়ার নাইরেরের মতো নেতা— যাঁরা নিজের নিজের দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন, এবং সর্বজনীন অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে হাঁটার কথা ভেবেছিলেন। বেশির ভাগ দেশের ক্ষেত্রেই সেই যাত্রা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সামরিক অভ্যুত্থান, বিশৃঙ্খলা, ক্ষমতার মোহ গণতন্ত্রের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিল, বাক্স্বাধীনতা হারিয়েছিলেন নাগরিকরা। একটার পর একটা দেশে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সংঘাত চরমে উঠেছিল, একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে সাঙাততন্ত্রের অভিসার ঘটেছিল। ভারত ছিল উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। দেশে গণতন্ত্র, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা ও জাতিভেদ প্রথা দূর করার পথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ভারতকে এমন একটি উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল যে, গোটা উন্নয়নশীল দুনিয়ায় তার কোনও তুলনা ছিল না।
এর প্রভাব কতখানি সুদূরপ্রসারী ছিল, তা আমি ব্যক্তিগত ভাবে টের পেয়েছি— প্রথমে অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে বিভিন্ন দেশে গবেষকদের আন্তর্জাতিক সমাবেশে গিয়ে, এবং পরে ভারতের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে জি-২০ বৈঠকে, এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণ বৈঠকে যোগ দিয়ে। এই পরিসরগুলির প্রতিটিতেই ভারতের এক বিশেষ সম্মান ছিল, যা উন্নয়নশীল দুনিয়ার খুব কম দেশই পেত। এর পিছনে একটা বড় কারণ ছিল স্বাধীনতার প্রথম পর্বে উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণের পিছনে বিনিয়োগ; এবং, শিক্ষিত ভারতীয় নাগরিকদের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিও ভারতকে সম্মান দিয়েছিল। আমি মনে করি, তার জন্য আমরা প্রধানত ঋণী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জওহরলাল নেহরুর কাছে— তাঁদের লেখায়, ভাষণে এই মূল্যবোধগুলি প্রোথিত ছিল, এবং দেশের মননে তার প্রভাব পড়েছিল। প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক ও সর্বজনীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য আরও অনেক কিছু করা বাকি, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পরে প্রথম কিছু বছরে ভারত যে পদক্ষেপগুলি করেছিল, তা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
ভারতীয় অর্থব্যবস্থার সাফল্য অবশ্য এমন অবিমিশ্র ছিল না। সাফল্য ছিল, ব্যর্থতাও। স্বাধীনতার পরের তিন দশক ভারতীয় অর্থব্যবস্থা গড়ে বছরে সাড়ে তিন শতাংশ হারে বেড়েছিল— ১৯৫০, ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে গড় বাৎসরিক বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৩.৯১%, ৩.৬৮% এবং ৩.০৯%। এ দিকে জনসংখ্যা বাড়ছিল বছরে দুই শতাংশের চেয়ে বেশি হারে। ফলে, টানা তিন দশক ধরে ভারতে মাথাপিছু প্রকৃত আয় বেড়েছিল শম্বুকগতিতে— বছরে এক শতাংশের সামান্য বেশি হারে।
এই প্রাথমিক শ্লথগতির অন্যতম কারণ ছিল ভারতীয় রাজনীতির চরিত্র। দেশে গণতন্ত্রের অনুশীলন চলছিল, গণমাধ্যম ছিল টগবগে, নিয়মিত নির্বাচন আয়োজিত হত— ফলে, নীতিনির্ধারণের বিষয়ে সরকার অতিসতর্ক ছিল। নীতিগত ভ্রান্তির ফলে নির্বাচনী ভরাডুবি ঘটতে পারে, এই আশঙ্কাটি সর্ব ক্ষণ ছিল। অতএব, তাঁরা সাবধানে পা ফেলতেই পছন্দ করতেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় পার্ক চুং হি যা করতে পেরেছিলেন, চিনে মাও জেদংয়ের পক্ষে যা সম্ভব হয়েছিল, ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় তা করার উপায় ছিল না।
তা বলে, ভারতে কিছুই হয়নি, তেমনটা নয়। সোভিয়েট ইউনিয়নের অভিজ্ঞতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চালু হয়েছিল, ভারী শিল্প স্থাপনের পথে হেঁটেছিল দেশ— বড় ইস্পাত কারখানা, বড় নদীবাঁধ তৈরি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নীতি গৃহীত হয়েছিল। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যায়ে দেশে ‘সবুজ বিপ্লব’ ঘটেছিল— কৃষির নিম্নস্তরের উৎপাদনশীলতা, এবং দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্ত হয়েছিল দেশ। যদিও পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশেই সবুজ বিপ্লবের ফল সবচেয়ে প্রকট ছিল, কিন্তু তার সুফল পৌঁছেছিল গোটা দেশেই। এর পাশাপাশি, ভারতে উচ্চশিক্ষার কিছু অতি উচ্চমানের প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছিল— আইআইটি, আইআইএম, জেএনইউ-এর মতো বিশ্ববিদ্যালয়, বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে এই প্রতিষ্ঠানগুলির বিপুল অবদান ভবিষ্যতে পাওয়া গেল।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশংসা করার পাশাপাশি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সামগ্রিক সাক্ষরতা ও প্রাথমিক স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে ভারত ১৯৪৭ সাল থেকেই তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। এ এক আশ্চর্য দ্বৈত ব্যবস্থা— যাঁরা ভাল মানের শিক্ষা পেলেন, তাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্তর পার করলেন, আর জনসংখ্যার একটা বড় অংশ তেমন ভাবে শিক্ষার সুযোগই পেল না। এই ছবিটা বদলানো দরকার।
ভারতীয় অর্থব্যবস্থার গায়ে বড় ধাক্কা লাগল ১৯৭৫ সালে— তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দেশে একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালু করলেন। তৎক্ষণাৎ আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ল। ১৯৭৫-৭৬ সালে বৃদ্ধির হার দাঁড়াল ৯ শতাংশ। কিন্তু, যাঁরা মনে করেন যে, একনায়কতন্ত্র আর্থিক বৃদ্ধির পক্ষে ভাল, তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, এই উচ্চ বৃদ্ধি ছিল পতনের ঠিক আগের মুহূর্ত। ১৯৭৭ সাল থেকে আর্থিক বৃদ্ধির হারের পতন শুরু হল, এবং ১৯৭৯-৮০ সালে তা গিয়ে দাঁড়াল -৫.২%, অর্থাৎ অর্থব্যবস্থা পাঁচ শতাংশেরও বেশি সঙ্কুচিত হল। বস্তুত, তার পর থেকে ২০২০ সাল অবধি ভারতে আর কখনও আর্থিক সঙ্কোচন হয়নি।
সৌভাগ্যক্রমে জরুরি অবস্থা দু’বছরেরও কম সময় স্থায়ী হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে পরাজিত হলেন। ১৯৮০ সালে তিনি যখন ক্ষমতায় ফিরলেন, তখন ভারতের নীতি পাল্টাতে আরম্ভ করল। আমার মনে হয় যে, নেহরুর যেমন নিজস্ব অর্থনৈতিক দর্শন ছিল, ইন্দিরা গান্ধীর তা ছিল না। রাজনৈতিক প্রশ্নে তাঁর মতামত ছিল প্রবল, কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে তেমন কোনও গভীর বিশ্বাসের জায়গা ছিল না। অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বকে দুটো স্পষ্ট ভাগে ভেঙে নেওয়া যায়— প্রথম পর্বে তিনি তাঁর বাবার মেয়ে, মূলত নেহরুর অর্থনৈতিক মূল্যবোধের দ্বারা পরিচালিত; এবং দ্বিতীয় পর্বে তাঁর ছেলের মা, সঞ্জয় ও রাজীব গান্ধীর অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা দ্বারা চালিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ১৯৬৯ সালে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের সিদ্ধান্তটি ছিল জওহরলাল নেহরুর কন্যার; আবার, ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে ধীর লয়ে হলেও যে বাজার সংস্কারের কাজ ভারতে শুরু হয়েছিল, তা ছিল রাজীবের মায়ের তৈরি নীতি।
অর্থব্যবস্থায় প্রকৃত পরিবর্তনের সূচনা হল ১৯৯১ সালে। ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে আর্থিক বৃদ্ধির হারে উন্নতি ঘটছিল বটে, কিন্তু তার পিছনে বড় ভূমিকা ছিল বর্ধিত সরকারি ব্যয়ের। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধ ভারতকে সঙ্কটের মুখে দাঁড় করাল। সে সময় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় উৎস ছিল উপসাগরীয় অঞ্চলে কর্মরত ভারতীয়দের দেশে পাঠানো অর্থ। যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ায় তাতে ছেদ পড়ল। বিপদ যতখানি বড় হওয়ার কথা ছিল, কার্যক্ষেত্রে তার চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিল, কারণ এর আগের বছরগুলিতে সরকার রাজকোষ থেকে খরচের পরিমাণ ক্রমেই বাড়িয়ে গিয়েছিল।
এই সঙ্কট তৈরি করল এক নতুন সুযোগ। ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে চিন, এবং ১৯৭০-এর দশকে কোরিয়া যা করেছিল, ১৯৯১-৯৩ সালে ভারতও সে পথেই হাঁটল— তার নাম আর্থিক সংস্কার। তার সুফল মিলল। প্রথমত, ভারতের কুখ্যাত ‘লাইসেন্স রাজ’-এর অবসান ঘটল। ডানা মেলল দেশের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে— তার পরবর্তী তিন দশকে এই ক্ষেত্র ভারতীয় অর্থব্যবস্থার উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পরিবর্তন করল। নতুন নিয়মে বাণিজ্য সহজতর হল; দেশে বিদেশি মুদ্রা নিয়ে আসা, এবং দেশ থেকে বিদেশি মুদ্রা বার করাও সহজ হল। তার ফল দেখা গেল ভারতের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারের স্ফীতিতে— ১৯৫৪-৫৫ সালে ভারতে বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার ছিল ২০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি; ১৯৮৯-৯০ সালে তা দাঁড়িয়েছিল ৪০০ কোটি ডলারে; আর্থিক সংস্কারের এক দশকের কিছু বেশি সময় পরে, ১৯৯৪-২০০৫ সালে এই ভান্ডারে ছিল ১৪১০০ কোটি ডলার। এই সময়ে এসে ভারত আন্তর্জাতিক মানচিত্রে এমন একটি জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল, যা দশ বছর আগেও কল্পনার অতীত ছিল।
১৯৯৪ সাল থেকেই দেশের জিডিপি-র বৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৬-৭ শতাংশের ঘরে পৌঁছয়। ১৯৯৭ সালে পূর্ব এশিয়ার আর্থিক সঙ্কটের ফলে তাতে খানিক ধাক্কা লাগে বটে, কিন্তু ২০০৩ সাল থেকে তা ফের গতিশীল হয়। ২০০৫ থেকে টানা তিন বছর বৃদ্ধির হার ৯ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। বস্তুত, ২০০৩ থেকে ২০১১ অবধি ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল দুনিয়ার অন্যতম সেরা। এবং এই প্রথম বার ভারতীয় অর্থব্যবস্থার তুলনা হতে আরম্ভ করল চিনের সঙ্গে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই জায়গায় পৌঁছতে ভারতকে গণতন্ত্র বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে হয়নি। ভারতের সাফল্য আন্তর্জাতিক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল।
ভারতের এই আর্থিক বৃদ্ধির প্রধান চালক ছিল পরিষেবা ক্ষেত্র। গোটা দুনিয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই এটা যথেষ্ট বিরল ঘটনা। পরিষেবা ক্ষেত্রে ভারত সফল হল কেন, তা বিশ্লেষণ করলে কয়েকটা তাৎপর্যপূর্ণ কারণ পাওয়া যায়। প্রথমত, বেশ কিছু বছর আগে একটা নীতিগত পরিবর্তন ঘটেছিল, যার মুখ্য কারণটি ছিল রাজনৈতিক, কিন্তু তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেশের পক্ষে লাভজনক হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে আইবিএম-এর সঙ্গে সরকারের বিরোধ বাধে, ফলে সংস্থাটিকে দেশ ছাড়তে হয়। তার ফলে ভারতের কম্পিউটিং সেক্টর-এ বেশ দোলাচল সৃষ্টি হয়। কিন্তু, তার ফলেই ভারত বাধ্য হয় এই ক্ষেত্রটিতে নিজেদের উদ্যোগে অগ্রসর হতে। এতেই জমি প্রস্তুত হয়ে ছিল। ১৯৯১-৯৩ সালে যখন আর্থিক সংস্কার হল, ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র তখন বিশ্ববাজারে ডানা মেলতে তৈরি ছিল। ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের পক্ষে ১৯৯১-৯৩’এর সংস্কার অতি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, কারণ তার ফলেই আমলাতন্ত্রের কালান্তক লাল ফিতের ফাঁস থেকে মুক্তি মেলে। যে ক্ষেত্রটির সাফল্য নির্ভর করে দ্রুততার উপর, আর্থিক সংস্কার তাকে সেই গতির অধিকার দিয়েছিল।
অতিমারির কারণে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার পক্ষে গত দু’বছর অত্যন্ত কঠিন ছিল। কিন্তু, আশঙ্কার কারণ তৈরি হয়েছে তার আগেই। ২০১৬ সাল থেকেই ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি ধাক্কা খেতে আরম্ভ করেছে। সে বছরের পর থেকে, পর পর চার বছর আর্থিক বৃদ্ধির হার তার আগের বছরের তুলনায় কম হয়েছে। সঙ্কটের সূচনা নোট বাতিলের অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তে। কিন্তু, অর্থব্যবস্থার গতিভঙ্গের আরও কারণ ছিল। একটা কথা অনেক সময় সহজে বোঝা যায় না— কিন্তু, গবেষণা থেকে পাওয়া ক্রমবর্ধমান প্রমাণ বলছে যে, কোনও দেশের আর্থিক সাফল্য শুধুমাত্র তার আর্থিক নীতির উপরই নির্ভরশীল নয়। দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি কেমন, নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার মাত্রা কেমন, তার উপর নির্ভর করে আর্থিক বৃদ্ধি। দেশে ঘৃণার রাজনীতির প্রাবল্য ভারতে মেরুকরণ বাড়িয়েছে, আস্থার পরিমাণ কমিয়েছে, বাক্স্বাধীনতার পরিসর খণ্ডিত হচ্ছে। যে বিষয়গুলির জন্য ভারত গোটা বিশ্বে খ্যাতিমান ছিল, সম্মান অর্জন করত, ঠিক সেগুলিই ধ্বংস হচ্ছে।
ঠিক এই সময়েই ডিজিটাল প্রযুক্তির একটি নাটকীয় পর্বান্তর ঘটছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। ফলে, কিছু দেশ এখন নতুন অর্থব্যবস্থায় বিজয়ী হবে, কিছু দেশ সেই লড়াইয়ে পারবে না। আমার ধারণা, এই নতুন পর্বে দু’টি ক্ষেত্র বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হবে। প্রথমটি শিক্ষা— সৃষ্টিশীল শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিজ্ঞানমুখী গবেষণা; এবং দ্বিতীয়টি স্বাস্থ্যক্ষেত্র— চিকিৎসাক্ষেত্রে যুগান্তকারী গবেষণা ঘটতে চলেছে। গোটা দুনিয়াতেই এই দু’টি ক্ষেত্রে জিডিপির আরও বড় অংশ নিয়োজিত হবে।
এই ক্ষেত্রগুলি ঐতিহাসিক ভাবেই ভারতের জোরের জায়গা। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তির শুভক্ষণে দাঁড়িয়ে আমাদের শপথ নেওয়া উচিত যে, এক দিকে আমরা আধুনিক গণতন্ত্র হিসাবে আমাদের হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করব; বাক্স্বাধীনতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করব; অন্য দিকে, শিক্ষায় নতুন উৎসাহে লগ্নি করব, যাতে এই ক্ষেত্রে গবেষণা ও সৃষ্টিশীলতার প্রথম সারিতে থাকতে পারে ভারত।
অর্থনীতি বিভাগ, কর্নেল ইউনিভার্সিটি,আমেরিকা