৯৯৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ওড়িশার মনোহরপুরে গ্রাহাম স্টেনস আর তাঁর দুই শিশুপুত্রকে গাড়ির মধ্যে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। যতই জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের সেবা এবং কুষ্ঠরোগীর দেখাশোনা করুন গ্রাহাম— খ্রিস্টান যখন, নিশ্চয় হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করেন জোর করে। অতএব গাড়িতে আগুন লাগিয়ে ‘হিন্দুধর্ম উদ্ধার’-এর কাজ হয়েছিল।
২০১১ সালের জনগণনা বলছে, এ দেশের জনসংখ্যার ২.৩ শতাংশ খ্রিস্টান। যদিও অনেকের মতে এই শতাংশ ক্রমশ কমছে। ‘ভারতে সংখ্যালঘুর বিপন্নতা’ কেবল মুসলমানদের দুর্ভাগ্যের বৃত্তান্ত নয়। ২০০৮ সালে কর্নাটকে চার্চের উপর তীব্র আক্রমণ হয়েছে। ম্যাঙ্গালুরুতে ছ’হাজারের উপর বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। একশোর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ১৮০০-র বেশি। ভারতকে নাকি ‘বিধর্মী মুক্ত’ করতে হবে! ২০১৬ সালে ঝাড়খণ্ডের কাঠোলি গ্রামে, বিহারের নবীনগরে পাদরি-সহ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের উপর চূড়ান্ত অত্যাচার হতে দেখেছি বজরং দল এবং আরএসএস সদস্যদের দ্বারা। চার্চ ভাঙচুর; লাঠি, রড, পাথর ইত্যাদি দিয়ে মারধর; খুন, পুলিশ দ্বারা বিনা বিচারে থানায় আটক করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাশবিক নির্যাতন— সবই ঘটেছে। এই সব ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ ক্রমে একটি ধারাবাহিকতা লাভ করেছে, এবং অনেকেরই অভিযোগ, কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার পর তা নয়া ইন্ধন পেয়েছে।
সর্বব্যাপী ঘৃণা ও বিদ্বেষ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ, পরধর্মসহিষ্ণু চেহারাকে বিকৃত করতে বদ্ধপরিকর। শুধু ২০১৪-’১৭-র মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ২৮ শতাংশ। ধর্মরক্ষায় পেশিশক্তির ‘দেশপ্রেমিক উত্থান’ ঘটেছে। ভারত পরিচিত হয়েছে ‘খ্রিস্টানদের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক’ বিশ্বের প্রথম দশটি দেশের অন্যতম হিসাবে।
২০১৮ সালে আমরা এক যাজকের মৃতদেহকে বাড়ির ছাদ থেকে গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় ঝুলতে দেখলাম। মাত্র এক সপ্তাহ আগে তিনি উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জানিয়েছিলেন। ২০২০ সালের প্রথম ন’মাসে খ্রিস্টানদের উপর আক্রমণের সংখ্যা ছিল ৪৫০-এর উপর। যে তিন রাজ্যে সবচেয়ে বেশি এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রথমই হল উত্তরপ্রদেশ। তার পর যথাক্রমে ছত্তীসগঢ় ও মধ্যপ্রদেশ। একটি মর্মান্তিক ঘটনা মনে না করে পারা যায় না। মোবাইলের দোকানে ‘লকডাউন নিয়ম’ ভাঙার অভিযোগে প্রৌঢ় পি জয়ারাজকে গ্রেফতার করে তামিলনাড়ুর পুলিশ। খবর পেয়ে থানায় খোঁজ নিতে গেলে ছেলে ইমানুয়েলও গ্রেফতার হন। থানা থেকে জীবিত বেরোতে পারেননি কেউ। নৃশংস অত্যাচারের পর তাঁদের হত্যা করা হয়— এমনই অভিযোগ।
‘রাষ্ট্র’ এবং ‘ধর্ম’ রক্ষার নামে দেশের মধ্যে এই বেলাগাম বিভেদ সৃষ্টি করা, আইন আদালতকে বাজারের দাঁড়িপাল্লায় তোলা, তাদের অগ্রাহ্য করা—এই কি আমরা চেয়েছিলাম স্বাধীন ভারতে? অথচ ক্রমশই কিন্তু আমাদের কাছে ঘটনাগুলি ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এমন সব খবর যেন রুটিন প্রাত্যহিকতায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ভয় লাগে এই নর্মালাইজেশন বা স্বাভাবিকীকরণ দেখে। জনগণের, বিশেষত সংখ্যালঘুর ‘নিরাপত্তা কবচ’ বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকছে না। এই ভারতকে অস্বীকার করলেই আমরা ‘দেশদ্রোহী’।
‘ভারতীয়ত্ব’ আর ‘হিন্দুত্ব’-কে এক করে ফেলার এই অশুভ প্রচেষ্টা যে কেবল বিধর্মীর অস্তিত্ব সঙ্কট ডেকে আনছে তা-ই নয়, হিন্দু ধর্মের ইতিবাচক এবং ঐতিহ্যশালী দর্শনকে কলুষিত করছে। কিছু কাল আগে ‘ধর্ম জাগরণ সমিতি’র কথা শোনা গিয়েছে। তারা ‘ধর্মান্তরিত’ মুসলমান, খ্রিস্টানদের ‘ঘর ওয়াপসি’ করছে। ‘হিন্দু’ ঘরে ফেরানো ছাড়া যে দেশে আর কোনও সমস্যা আছে, তাদের তা মনেই হয় না। এদের নেতা রাজেশ্বর সিংহের সদম্ভ ঘোষণা ছিল, “২০২১ সালের মধ্যে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানো আমাদের লক্ষ্য।”
ভারত ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ কবে হবে জানা নেই, কিন্তু ধর্মকে ধ্বংসকামী করে তোলার চক্রান্ত এই ভারতে সফল হয়েছে। ‘পিউ সার্ভে’ (আমেরিকান সংস্থা, সামাজিক এবং জনগণ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণা করে) ২০২১ সালে ৩০০০০ ভারতীয়কে নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছে, প্রতি তিন জনের এক জন ভারতীয় খ্রিস্টানদের ‘প্রতিবেশী’ হিসাবেই মানতে অরাজি, সহযাপন তো দূর অস্ত্।
এই সব জেনেও অবশ্য আমাদের মনে হয়, ইতিহাসের এত রকম বাঁক পেরিয়ে এসে, ক্রুশবিদ্ধ ঈশ্বরপুত্র এবং ঝলসে যাওয়া ঈশ্বরপ্রেমীর মৃতদেহ নিশ্চয়ই আমাদের প্রিয় উপমহাদেশের শেষ কথা হতে পারে না। নিশ্চয়ই কৃষক সংগ্রামের ময়দান থেকে কুড়িয়ে আনা একতার শক্তি দিয়ে আমরা অন্য রকম কোনও ‘ধর্ম’— মানবধর্মের— সন্ধান পাব। আমাদের মাটির টুকরোগুলোকে জুড়ে আবার একটা ‘দেশ’ বানিয়ে ফেলতে পারব। অন্তত এমন একটা আশা নিয়েই শুভবোধসম্পন্ন নাগরিক আজও সামনের দিকে তাকাচ্ছেন।
না কি, এ সব আশাই অলীক?