বাংলা ভাষার এই দুর্দিনে ভাল অনুবাদ ও জ্ঞানচর্চার সঙ্কল্প হোক
International Mother Language Day

‘বদনখানি মলিন হলে’

মাতৃভাষার উদ্‌যাপনে ভালবাসা আর গর্বের সঙ্গে থাকুক কিছু বিষাদ আর আত্মসমালোচনা।

Advertisement

অনুরাধা রায়

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৬:৪৬
Share:

জননী বঙ্গভাষার মুখখানি আজ মলিন। ক্ষমতার ভাষা ইংরেজি ও হিন্দির পাশে তিনি হীনমর্যাদা। তদুপরি তাঁর নিজের সন্তানদের মধ্যেও বিভাজন ও বিদ্বেষ। তাই মাতৃভাষার উদ্‌যাপনে ভালবাসা আর গর্বের সঙ্গে থাকুক কিছু বিষাদ আর আত্মসমালোচনা।

Advertisement

বাংলা ভাষা মধ্যযুগ থেকে নিজস্ব চেহারা নেয় এবং একটা ভাষিক-ভৌগোলিক আত্মপরিচয়ের উৎস হয়ে ওঠে। ইতিহাস বলে, এটা হয় হিন্দু-মুসলমানের যৌথ প্রয়াসে। তবু উনিশ শতক থেকে ব্রিটিশ-আহৃত আধুনিকতা (মধ্যশ্রেণির উদ্ভব ও জাতীয়তাবাদ যার অঙ্গ) এবং মুদ্রণ যন্ত্রের দৌলতে বাংলা ভাষার প্রমিতকরণ (স্ট্যান্ডার্ডাইজ়েশন) শুরু হলে ভাষা হয়ে উঠল হিন্দু-মুসলমান বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। ষোড়শ শতক থেকেই বাংলায় দু’টি সম্প্রদায়ের মানুষই প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করতেন। শিক্ষিত হিন্দুরা ভাল ফারসি জানতেন। দোভাষী বাংলায় রচিত পুঁথিসাহিত্য দুই সম্প্রদায়েরই তলার দিকে জনপ্রিয় ছিল। উনিশ শতকে প্রমিতকরণ প্রক্রিয়াটির চালক হিন্দু মধ্যশ্রেণি তথা ভদ্রলোকরা সচেতন ভাবে আরবি-ফারসি বর্জন করে ভাষাকে সংস্কৃতায়িত করে তুললেন। এ তাঁদের ‘হিন্দু’ ধারণার ভিত্তিতে জাতি কল্পনার অনুষঙ্গ।

উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে মুসলমান মধ্যশ্রেণির উত্থান। সংস্কৃতায়িত বঙ্গভাষা তাঁদের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য হল না, বাংলা সাহিত্যের বিষয়বস্তু বড় বেশি ‘হিন্দু’ মনে হল, মধ্যযুগীয় মুসলিম নিপীড়নের বর্ণনা দিয়ে জাতীয়তাবাদের প্রকাশ বিরূপতা জাগাল। ছিল ‘প্যান-ইসলামিজ়ম’এর প্রভাবও। ক্রমে তাঁরা শুরু করলেন ‘মুসলমানি বাংলা’র চর্চা (নিম্নবর্গীয় ‘দোভাষী বাংলা’ তাঁদের উপযুক্ত সাহিত্যভাষা বলে মনে হয়নি)। হয়তো গোড়ার দিকে হিন্দুদের সঙ্গে সম্মানজনক সংলাপই তার লক্ষ্য ছিল; কিন্তু ক্রমে স্বতন্ত্রতা গেল বিচ্ছিন্নতার দিকে। অন্তিম ঔপনিবেশিক যুগে কেউ কেউ প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ নিতান্ত কৃত্রিম ভাবে আমদানি করতে লাগলেন বাংলায়, যা তাকে সাধারণ হিন্দু-মুসলমানের কাছে দুর্বোধ্য করে তোলে। সাহিত্যে বঙ্কিম, রবি, শরৎ তো বটেই, আক্রান্ত হলেন নজরুলও। ধর্মীয়সত্তা আচ্ছন্ন করল দুই সম্প্রদায়কেই। পার্থিব অসন্তোষ, আকাঙ্ক্ষা তো ছিলই। মন ভাঙতে লাগল, দেশও ভাঙল।

Advertisement

তার পরেও অবশ্য পূর্ব বাংলার বাঙালি তার বাঙালি আর মুসলমান সত্তাকে ঠিকমতো জুড়তে পারল না। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে রক্ত দিয়ে বাঙালিসত্তার মর্যাদা পুনরুদ্ধারের পরেও না। আজ সেখানে বাঙালিত্বকে পদদলিত করে উগ্র ইসলামি আগ্রাসন দৃশ্যমান। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের যে শহিদদের স্মরণ করে গোটা বিশ্ব একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস পালন করে, ইতিহাস কি তাঁদের আত্মদানকে স্বদেশেই অপ্রাসঙ্গিক করে তুলল?

এপার বাংলার বাঙালি আবার ১৯৪৭-এর পর ভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হল, আন্তর্জাতিক ও সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার জন্য তার কতটা ইংরেজি আর কতটা হিন্দি প্রয়োজন? ‘হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ’-এর বিরুদ্ধে বাঙালি বরাবর সরব। কিন্তু এই প্রসঙ্গে কারও কি মনে পড়ে, উনিশ শতকে উত্তর ভারতে প্রবাসী বাঙালি এলিটরা কেমন সেখানকার সবর্ণ হিন্দু এলিটদের সঙ্গে মিলে নাগরি/হিন্দি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, উর্দুভাষী আওয়াধি মুসলিম এলিটদের কোণঠাসা করার লক্ষ্যে? অনেকটা বাঙালিদের দৌলতেই মূলত লিপিরপ্রশ্নে সংগঠিত একটি আন্দোলন হয়ে উঠেছিল হিন্দি বনাম উর্দু ভাষার লড়াই, শেষ পর্যন্ত তিক্ত হিন্দু-মুসলমান সংঘাত।

বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকদের বিচ্ছিন্নতা অবশ্য শুধু মুসলমানদের থেকে নয়, তাদের দুস্তর ব্যবধান নিচু শ্রেণির (ও নিচু জাতির) হিন্দুদের থেকেও। ফলে ভাষার প্রমিতকরণের প্রক্রিয়ায় তারা আমজনতার মুখের ভাষা তথা মাতৃভাষাকে একেবারেই তুচ্ছ করেছিল। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল ও গোষ্ঠীর মানুষদের মাতৃভাষা, এমনকি ওড়িশা ও অসমের ভাষাকেও ভদ্রলোকরা তাঁদের কলকাতাঘেঁষা ‘মান্য বাংলা’র উপভাষা বলেই গণ্য করেছিলেন। আসলে মান্য ভাষা আর উপভাষার তফাতটা করে দেয় ভাষার প্রমিতকরণ ও লিখিত রূপের বিকাশ, যেটা হয় মধ্যশ্রেণির উদ্যোগে, যার সঙ্গে আবার জড়িয়ে থাকে মধ্যশ্রেণির প্রতিষ্ঠালাভের আকাঙ্ক্ষা। এই প্রক্রিয়ায়, উনিশ শতকের একটু পরের দিকে হলেও, ওড়িয়া আর অসমিয়া ভাষারও প্রমিতকরণ হল এবং বাংলার ভাষিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ঘনিয়ে উঠল। বাংলার ভিতরে অবশ্য মুসলমান মধ্যশ্রেণি ছাড়া আর কেউ চট করে প্রতিবাদের কথা ভাবেনি। কলকাতায় পড়তে আসা পূর্ববঙ্গীয় ছাত্ররা বিদ্রুপবিদ্ধ হতে হতেই সমাজপ্রতিষ্ঠার তাগিদে কলকাতার ভাষা আয়ত্ত করে ফেলত। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর কাল দেখেছে রাজবংশী তথা কামতাপুরী ভাষার আত্মঘোষণা। পার্থিব স্বার্থের রাজনীতি যে ভাষাকে ভাগ করেদেয়, একই রাজবংশী সম্প্রদায়ের দু’টি পৃথক আন্দোলন তার প্রমাণ। আবার পার্থিব প্রসঙ্গ থেকে আলাদা করে নিলে একদা বাংলার উপভাষা হিসেবে পরিচিত রাজবংশী সত্যি বাংলা থেকে খুব আলাদা কি না সেটাও গোলমেলে প্রশ্ন। কিন্তু মাতৃভাষাকেন্দ্রিক আবেগের সঙ্গে পার্থিব সুযোগসুবিধার আকাঙ্ক্ষা মিলিয়ে উদীয়মান মধ্যশ্রেণি তো ইতিহাসবদলাতেই পারে।

এটাও ঠিক যে, স্বভূমিতে অন্যের মাতৃভাষাকে তাচ্ছিল্য করা বাংলা ভাষা অন্যত্র নিজেই অনাদরের শিকার হয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বাধীনতা-উত্তর অসমে বাংলার দুর্দশা। বাঙালিপ্রধান বরাক উপত্যকায় ১৯৬১ সালে ১১ শহিদের আত্মদান স্মরণীয়। আবার বাংলাভাষী মানভূমকে বিহার থেকে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য (১৯৫৬) প্রবল আন্দোলন করতে হয়েছিল। এই জন্যই নিজের মাতৃভাষাকে ভালবাসার পাশাপাশি অন্যের মাতৃভাষার দাবিও মনে রাখা জরুরি। অবশ্য সমমর্মিতা ও পারস্পরিকতা থাকলে তবেই সেটা সম্ভব। না থাকলে মাতৃভাষার অংশীদারিও প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য যথেষ্ট নয়।

তবে আজ বিশ্বায়িত মধ্যশ্রেণির পার্থিব উচ্চাশার কাছে তার মাতৃভাষাপ্রীতি অনেকটাই পরাভূত। নিছক ভালবাসার তাগিদে ভাষার চর্চা কত আর করা যায়! বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ততটা ভালবাসাও কি আছে? ভাষা পার্থিব স্বার্থান্বেষণে সহায়ক হলে আলাদা কথা। প্রমিত আঞ্চলিক ভাষার সংস্কৃতিতে প্রান্তিকায়িত অনেক নিম্নবর্গীয় মানুষেরই মধ্যবিত্তায়নের প্রক্রিয়ায় ইংরেজিকেই বেশি কাঙ্ক্ষিত মনে হতে পারে (উত্তরপ্রদেশের বাঙ্কায় দলিতদের প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি দেবীর মন্দিরও আছে)। সভ্যতার সমসত্ত্বীকরণের প্রক্রিয়ায় সারাপৃথিবীতেই মাতৃভাষাগুলি সঙ্কটাপন্ন। বাংলাও কোণঠাসা, বিপুল সংখ্যক মানুষের ভাষা এবং অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভাষা হয়েও।

দোকানের সাইনবোর্ড বাংলায় লিখে (প্রায়শ ভুল বানানে) আর বাংলায় গান গেয়ে কিন্তু বাংলাকে চাঙ্গা করা যাবে না। প্রয়োজন মনোযোগী চর্চা, অন্য ভাষা থেকে আহরণের ঔদার্যও যার অপরিহার্য অঙ্গ। তার জন্য দরকার প্রচুর অনুবাদ। পশ্চিমবঙ্গে একদা যারা প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি উঠিয়ে দিয়েছিল, তারা কিন্তু অনুবাদের দিকে নজর দেয়নি এবং এই ভাবে ইংরেজি-বাহিত বৈশ্বিক জ্ঞান ও বোধি থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল অসংখ্য ছেলেমেয়েকে, যা ছিল শিক্ষাকে অবহেলারই অনুষঙ্গ। এটা বিশেষ করে ক্ষতিসাধন করেছিল নিম্নবর্গীয়দের (এলিট স্তরে ইংরেজি-মাধ্যম রমরমিয়ে উঠেছিল)। পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে প্রায়ই মনে হত, নিতান্ত দুর্বল ছাত্র— যারা ইংরেজি তো নয়ই বাংলাটাও ভাল জানে না, বিষয়বস্তুর উপর দখলও হতাশাজনক— তাদের কোনও ক্রমে পরীক্ষায় উতরে যাওয়ার ভাষা হিসেবেই বোধ হয় বেঁচে থাকবে আমাদের সাধের বাংলা ভাষা। কিন্তু শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, এত যে সাহিত্যপ্রিয় বাঙালি, ভাল অনুবাদের অভাবে অন্যান্য ভাষার এমনকি ভারতীয় সাহিত্যের সঙ্গেও তার পরিচয় খুবই কম। সেটা সাহিত্যচর্চায় তার নিজেরও দৈন্যের কারণ।

কিন্তু শুধু সাহিত্যচর্চা করেও ভাষাকে বাঁচানো যায় না। চাই জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা। একটা প্রমাণ দিই। রেনেসাঁস ইটালিতে দান্তে, পেত্রার্ক ও বোকাচ্চিওর উজ্জ্বল সাহিত্যকৃতির পরেও শতাধিক বছর ধরে ইটালীয় ভাষা দীনহীন হয়েই ছিল, কারণ বিদ্যাচর্চা হত লাতিন ভাষায়। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সচেতন ভাবে ইটালীয় ভাষায় বিদ্যাচর্চা শুরু হলে ইটালীয় সাহিত্যেরও বিকাশ ঘটল। আজ বাঙালির উচ্চপর্যায়ের বিদ্যালোচনা কিন্তু প্রধানত ইংরেজিতে, বিজ্ঞানের জন্য তো বটেই (একদা এ ক্ষেত্রে বাংলার আদর থাকলেও)। অন্যের মাতৃভাষার প্রতি সম্ভ্রমের পাশাপাশি বাংলায় ভাল অনুবাদ আর জ্ঞানচর্চা আমাদের মাতৃভাষা দিবসের সঙ্কল্প হতে পারে কি? অবশ্য আদৌ যদি বাংলার বেঁচেবর্তে থাকায় আগ্রহী হই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement