কিছু দিন আগেই এক বৃহৎ সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক নির্বাচন হল। সেই নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি আর ফলাফল দেখে বোঝা গেল যে, কিছু জিনিস চিরন্তন— তার একটি হল চাটুকারিতার বস্তুগুণ। মনস্তাত্ত্বিক ও আচরণমূলক দিক থেকে ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করা যাক। ধরা যাক, কোনও একটি দলে তিন জন সদস্য আছেন। দলের যিনি নেতা, তিনি চান না, দলটি যে তাঁর পারিবারিক সম্পত্তি, সেই চিত্র বাইরে যাক। যদিও সবাই সে কথা ভালই জানেন, তবুও আত্মপ্রবঞ্চনা অনেকেই করে থাকে। তাই তিনি তিন জনের মধ্যে এক জনকে দলের সভাপতি করতে চান।
এ বার সেই তিন জনের কথা বলা যাক। প্রথম জন রাজনৈতিক ভাবে প্রতিভাধর— তাঁর নিজের জোরে জনমত গঠন করার ক্ষমতা আছে। দ্বিতীয় জনের প্রতিভা মাঝারি মানের। তাঁর ক্ষমতা সীমিত, কিন্তু কিছু গঠনমূলক কাজের ক্ষমতা আছে। তৃতীয় জনের রাজনৈতিক প্রতিভা নেই বললেই চলে। রাজনীতিতে তাঁর অস্তিত্ব অনেকটাই তাঁর দলের নেতার বদান্যতায়। তাই নিজেকে ভাসিয়ে রাখতে নিজের স্বার্থেই দলের নেতাকে খুশি রাখা তাঁর একান্ত প্রয়োজনীয়। দলের নেতা সে কথা জানেন, এবং এটাও জানেন যে, এঁকে দিয়ে নিশ্চিন্তে নিজের কাজ পিছন থেকে করিয়ে নেওয়া যাবে। তাই চুপিসারে তাঁকেই সমর্থন করা শ্রেয়।
দ্বিতীয় ব্যক্তি জানেন যে, প্রতিযোগিতামূলক চাটুকারিতায় তিনি হয়তো পেরে উঠবেন না, কিন্তু চেষ্টা করতে তো বাধা নেই। তাই তিনিও প্রাণপণ চেষ্টা করবেন, যাতে নেতাকে খুশি রাখা যায়। তাঁর যেটুকু প্রতিভা ছিল, সেটুকু জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে চেষ্টা করবেন নেতার কৃপা পাওয়ার। এ দিকে, প্রথম জন জানেন যে, নেতা তাঁকে কোনও দিনই ক্ষমতার কাছাকাছি আনবেন না, কারণ তিনি নেতার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাহীনতার কারণ। যিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন, প্রত্যেকে মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। আর ‘সর্বময়’ নেতানেত্রীদের মধ্যে এই নিরাপত্তাহীনতা একটু বেশিই বিদ্যমান— কেউ আমার জায়গা দখল করে নিল না তো, এই উদ্বেগ তাঁদের প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়। কোনও যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান পেলেই তাঁরা ভাবেন, যদি এই ব্যক্তি আমার জনপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে যান, তা হলেই তো আমি আর জননেতা থাকব না! আমার অক্ষমতা ধরা পড়ে গেল না তো? এই আশঙ্কা সব সময় তাঁদের নিদ্রাহীনতার কারণ। তাই নিম্নপ্রতিভার ব্যক্তিটিকেই তাঁর ভারী পছন্দ, নিজের পুত্র কন্যা বা আপনজন ছাড়া। তাই অগত্যা প্রতিভাধর ব্যক্তিটিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দর্শন করেই ক্ষান্ত হতে হবে, আর নিম্নপ্রতিভার সেই ব্যক্তিই নেতার কৃপা পাবেন, এ আর নতুন কী! শেষ পর্যন্ত হয় প্রতিভাধর মানুষটি রণে ভঙ্গ দেবেন আর দলে দ্বিতীয় শ্রেণির নেতা হয়ে থাকবেন, বা প্রচণ্ড তেজি হলে নিজের দল শুরু করবেন। দুঃখের বিষয় হল, প্রতিভাধর মানুষটি যদি সফল ভাবে নিজের দল গড়তে সমর্থ হন, তিনিও চাটুকারপ্রিয় হয়ে ওঠেন। নিজের অতীত বঞ্চনার কথা আর মনে থাকে না। নিজের প্রাক্তন নেতার মতোই আর এক নিরাপত্তাহীন কূপমণ্ডূক নেতা হয়ে ওঠেন।
উপরোক্ত কাল্পনিক ঘটনাগুলি যে শুধু রাজনীতির জগতে হয়ে থাকে, তা কিন্তু নয়। আমাদের কর্মজগতেও এ রকম চাটুকারদের উপরে ওঠাকে একই ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। অবশ্য কর্মক্ষেত্রে মাঝে মাঝে উপরওয়ালারা উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন হন, তাই প্রতিভাবানদের কিছু আশা হয়তো থাকে। কিন্তু, রাজনীতির বাজারে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ— যে কোনও দলেই। কর্মক্ষেত্রের বাজারে প্রতিভাধরদের তাও কিছু মূল্য আছে। একটি সংস্থাকে লাভের মুখ দেখতে হয়, তার জন্য কিছু শিক্ষা, কিছু প্রতিভার প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতির বাজারটি অদ্ভুত; শিক্ষা, সৃষ্টিশীল প্রতিভার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে কম।
আসলে সর্বত্র চাটুকারিতার একটি বাজার আছে। সেখানেও চাহিদা-জোগানের খেলা। যে কোনও সংগঠন বা রাজনৈতিক দলে চাটুকারিতার প্রবল চাহিদা। কিন্তু সমস্যা হল, তার চেয়েও জোগান অনেক বেশি, কৃপা চাইবার লোক অনেক বেশি। তাই নেতা-নেত্রীরা চাটুকারিতা খুব স্বল্প দামে পেয়ে যান। অর্থনীতির পরিভাষায় চাটুকারিতা এখন প্রায় ‘ফ্রি গুড’। চাটুকারিতার বাজার যত প্রতিযোগিতামূলক, নেতা-নেত্রীদের ততই ভাল।
চাটুকারিতা যে শুধু রাজনৈতিক দলের কর্মীরা করছেন, তা কিন্তু নয়। অন্য জগতের মানুষেরাও ক্ষমতাসীন দলের কৃপা পেয়ে ধন্য হচ্ছেন। সরকারি খেতাব পাওয়ার হুড়োহুড়ি, সরকারি ভাল ‘পোস্ট’ পাওয়ার হুড়োহুড়িতে কেউ জিতেছেন, কেউ হারছেন। তবে জিতে যাওয়ার মোক্ষম উপায় হল নিজের নীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে আখের গোছানোর চেষ্টা করা, ‘চ্যাম্পিয়ন চাটুকার’ হয়ে ওঠা। এই প্রবণতাটিকেও অর্থনীতির তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। এক জন চাটুকার হলে বাকিদেরও চাটুকার হওয়াটাই ‘অপটিমাম স্ট্র্যাটেজি’, যদি না কারও নীতিবোধ বা মানসম্মানবোধ প্রখর হয়। নীতিবোধ, মানসম্মানজ্ঞান এখন খুব দুষ্প্রাপ্য। তাই সবই কেমন যেন নিম্নগামী, অর্থাৎ ‘রেস টু দ্য বটম’।
রাজনৈতিক চাটুকারিতার স্তর এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, কোনও বক্তব্য পেশ করার সময় কোনও দলীয় মুখপাত্র নেতা বা নেত্রীর নাম প্রতি দু’মিনিটে এক বার উচ্চারণ করছেন। এমনও হতে পারে যে, দলীয় নেতা বা নেত্রী এটাই চান, মুহুর্মুহু তাঁর নাম না বললে সেই ব্যক্তিকে আর দলের কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হবে না। আর প্রত্যেক মুখপাত্র তাই ভক্তিভরে নেতা-নেত্রীর নাম দু’মিনিট অন্তর বলে যাচ্ছেন। এটি অনেকটা ইষ্টনাম জপ করার মতো। বিভিন্ন ধর্মে আমরা যেমন কথায় কথায় ‘ঈশ্বরের আশীর্বাদে, ঈশ্বরের আশীর্বাদে’ বলি, এটিও অনেকটা সে রকম। এর আর একটি ব্যাখ্যাও হয়। নেতা বা নেত্রী হয়তো চান যে, দলের সমস্ত কর্মী বা সদস্য যেন সর্ব ক্ষণ মনে রাখেন তাঁদের সর্বময় কর্তা বা কর্ত্রীকে। সেটা যাতে কেউ ভুলে না যান, তার জন্য তাঁর নাম দু’মিনিট অন্তর অন্তত এক বার বলা আবশ্যক। এটাও এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক কৌশল, সর্বময় ক্ষমতা হাতে রাখার কৌশল— এক মুহূর্তের জন্যও যেন কেউ নিজেকে বেশি কিছু ভেবে না ফেলেন। নেতা বা নেত্রী যে ঈশ্বরের সমতুল, সেটা যেন কেউ ভুলে না যান। এর জন্যই এই ব্যবস্থা। আর না মানলেই অন্য ব্যবস্থা। এটিও নেতা নেত্রীদের মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। সমস্ত দল নির্বিশেষে এটি লক্ষ করা যায়, কিছু কম কিছু বেশি।
সার্বিক ভাবে দেখলে এ ভাবে হয়তো কিছু সময় দলের উপর ক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব। তাতে কোনও ব্যক্তির স্বল্পমেয়াদি লাভ হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনও লাভ দলের বা সংগঠনের হয় না। দলের বা সংগঠনের ভাবনাচিন্তায় স্থবিরতা আসে, নতুন কোনও ‘আইডিয়া’ নিয়ে কেউ আসেন না, শুধু নেতা নেত্রীদের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলানোই লোকের অভ্যাসে পরিণত হয়। অন্তর্মুখিতা বা ‘ইনব্রিডিং’ যে কোনও সংগঠন বা দলের অধঃপাতে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই একটি সময় প্রবীণদের নতুনদের জায়গা ছেড়ে দিতে হয়, নবীনরা নতুন ‘আইডিয়া’ নিয়ে আসে, সেগুলিকে প্রাধান্য দিতে হয়। এটি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ক্রীড়াজগৎ, শিল্প, সর্বত্র সত্যি, রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। না হলে তিনশো থেকে ত্রিশে নামতে সময় লাগে না।
সংগঠন বা দল যদি কারও ‘আইডেন্টিটি’ হয়ে ওঠে, পারিবারিক ব্যবসা হয়ে যায়, তখন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কোনও নিরাপত্তাহীন নেতা যে অন্তর্মুখী হবেন, চাটুকারপ্রিয় হবেন, তাতে সংশয় নেই।
অর্থনীতি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়