অতিমারি ও লকডাউনে ভারতে অর্থনৈতিক বৈষম্য উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। কুড়িটি স্বাধীন দাতব্য সংস্থার কনফেডারেশন ‘অক্সফ্যাম’-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, গত এক বছরে অতিমারি দেশের অর্থনীতিকে স্তব্ধ করে সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্র মিলিয়ে কয়েক কোটি মানুষকে কর্মচ্যুত করেছে। অথচ, একই সময়ে ভারতের বিলিয়নেয়ারদের সম্পত্তি বেড়েছে প্রায় ৩৫%।
বৈষম্যের এই বৃদ্ধি কি সাময়িক না স্থায়ী, এর অভিঘাত কেমন হতে পারে, এই পরিস্থিতিতে দারিদ্র মোকাবিলায় সরকারের কী পদক্ষেপ করা উচিত, প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার উপায় ভারতের ‘রেট অব ইন্টারজেনারেশনাল মোবিলিটি’ বা আন্তঃপ্রজন্ম অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার নির্ণয়।
আন্তঃপ্রজন্ম অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার বলতে বোঝায় সমাজে এক প্রজন্মের, তার আগের প্রজন্মের তুলনায়, অর্থনৈতিক উন্নতির (বা অবনতির) সম্ভাবনা। যদি দেখা যায় এই ওঠানামার হার কম, তা হলে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বৃদ্ধি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ থাকে। কারণ এ ক্ষেত্রে প্রজন্মান্তরে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয় না, দরিদ্ররা প্রজন্মান্তরে দরিদ্রই রয়ে যায়, বিত্তশালীরা বিত্তশালী। ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এই পরিস্থিতিতে, দারিদ্র মোকাবিলায় সরকারের উচিত দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প (যেমন দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্প) গ্রহণ করা, যা দরিদ্রদের পরবর্তী প্রজন্মের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে সাহায্য করবে। আর আন্তঃপ্রজন্ম অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার যথেষ্ট বেশি হলে বর্তমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ অনেকটাই কম। কারণ, এ ক্ষেত্রে প্রজন্মান্তরে অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসের নীচের দিকে থাকা মানুষ সহজেই উপরের দিকে অগ্রসর হতে পারে। ফলত, বৈষম্য দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট কম। এ পরিস্থিতিতে দারিদ্র মোকাবিলায় সরকারের তরফে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপই (যেমন দরিদ্রদের ঋণ ও বিমার বাজারে প্রবেশের বাধা দূর করা, বা তাঁদের প্রতি মাসে অর্থ পৌঁছে দেওয়া) যথেষ্ট, যা বর্তমান প্রজন্মকে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াইয়ে সাহায্য করবে।
আন্তঃপ্রজন্ম অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার সাধারণত নির্ণীত হয় ধারাবাহিক দুই প্রজন্মের আয় বা শিক্ষার ভিত্তিতে। এই দু’টি সূচক মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার অন্যতম শক্তিশালী নির্ধারক। ভারতে আয়ের ভিত্তিতে আন্তঃপ্রজন্মের অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসের হার নির্ণয় সম্ভব নয় তথ্যের অভাবে, কিন্তু শিক্ষার ভিত্তিতে এই হার নির্ণয় করা সম্ভব ইন্ডিয়া হিউম্যান ডেভলপমেন্ট সার্ভের (আইএইচডিএস) তথ্য ব্যবহারে। দেশ জুড়ে পরিচালিত এই সার্ভেতে আছে অংশগ্রহণকারী ৪০,০০০ পরিবারের প্রতিটির (পুরুষ) প্রধান এবং তাঁর পিতার শিক্ষাগত যোগ্যতার (কত বছর তাঁরা প্রথাগত শিক্ষায় ব্যয় করেছেন) তথ্য।
এই তথ্য ব্যবহার করে আমি আইএইচডিএস-এর নমুনায় অন্তর্ভুক্ত পিতা ও পুত্রদের দুই প্রজন্মকে চার ভাগে ভাগ করি: নিরক্ষর, সাক্ষর অথচ যাঁরা প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোননি, যাঁরা প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক অবধি পড়েছেন কিন্তু কলেজে যাননি, এবং যাঁরা কলেজ অবধি পৌঁছতে পেরেছেন। তার পর চারটি ভাগের প্রতিটির জন্য অঙ্ক কষে বার করি— একটি নির্দিষ্ট ভাগের অন্তর্ভুক্ত যে পিতারা, তাঁদের পুত্রদের একই ভাগে থাকার এবং অন্য তিনটি ভাগের প্রতিটিতে পৌঁছনোর সম্ভাবনা কতটা। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, নিরক্ষর পিতার পুত্রের নিরক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৪০%; সাক্ষর অথচ প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোতে পারার সম্ভাবনা প্রায় ২২%; প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বোচ্চ উচ্চ মাধ্যমিক স্তর অবধি পড়তে পারার সম্ভাবনা ৩৫%, স্কুলের গণ্ডি পেরনোর সম্ভাবনা মাত্র ৩%। বিপ্রতীপ মেরুর পিতাদের কী অবস্থা? স্কুলের গণ্ডি পেরনো পিতার পুত্রের অন্তত স্কুলের গণ্ডি পেরনোর সম্ভাবনা ৬৯%, প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বোচ্চ উচ্চ মাধ্যমিক অবধি পড়ার সম্ভাবনা ২৯%; সাক্ষর অথচ প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোতে পারার সম্ভাবনা প্রায় ২%; নিরক্ষর হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। পিতা স্বল্পশিক্ষিত হলে? সাক্ষর অথচ প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোতে পারা পিতার পুত্রের সাক্ষর অথচ প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোতে পারার সম্ভাবনা প্রায় ২৭%, নিরক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ১১%; প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বোচ্চ উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়ার এবং স্কুলের গণ্ডি পেরনোর সম্ভাবনা যথাক্রমে ৫৪ ও ৯%।
তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, ভারতে আন্তঃপ্রজন্ম অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার অত্যন্ত কম। পিতা যদি নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত হন, তাঁর পুত্রের নিরক্ষর হওয়ার বা সাক্ষর হয়েও স্কুলের গণ্ডি না পেরনোর সম্ভাবনা সর্বাধিক। অন্য দিকে, পিতা উচ্চশিক্ষিত হলে তাঁর পুত্রেরও উচ্চশিক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক। পিতা নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত কিন্তু পুত্র স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে অন্তত কলেজ অবধি পৌঁছে যাচ্ছে, এমনটা সিনেমায় হয়, বাস্তবে নয়।
জাত ও ধর্মের ভিত্তিতে আন্তঃপ্রজন্ম অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার নির্ণয় করা হলে কী দেখা যাবে? জাতের ভিত্তিতে দেখতে পাচ্ছি, প্রজন্মান্তরে, উচ্চবর্ণের তুলনায় তফসিলি অন্তর্ভুক্ত জাতি-জনজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে নীচ থেকে উপরে ওঠার হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কম, এবং উপরে রয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি। ধর্মের ভিত্তিতে এই ওঠানামার হার নির্ণয় করে দেখতে পাচ্ছি, প্রজন্মান্তরে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে নীচ থেকে উপরে ওঠার হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কম এবং উপরে রয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি। অতএব, এটা পরিষ্কার, উচ্চবর্ণের তুলনায় তফসিলি অন্তর্ভুক্ত জাতি-জনজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির, এবং হিন্দুদের তুলনায় মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আন্তঃপ্রজন্ম অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। আজকের ভারতে, যেখানে দলিত এবং সংখ্যালঘুরা ক্রমেই কোণঠাসা হচ্ছেন, এ যথেষ্ট উদ্বেগের তথ্য।
আন্তঃপ্রজন্ম অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার ভারতে যথেষ্ট কম হওয়ায় এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অতিমারির ফলে বৃদ্ধি পাওয়া অর্থনৈতিক বৈষম্য ভারতে দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে, এবং এই পরিস্থিতিতে দারিদ্র মোকাবিলায় সরকারের অবিলম্বে উচিত দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করা— যা দরিদ্রদের পরবর্তী প্রজন্মকে দারিদ্র থেকে বেরোতে সাহায্য করবে। শুধু তা-ই নয়, সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের আন্তঃপ্রজন্ম অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার সবচেয়ে কম হওয়ায়, সরকারের উচিত এঁদের মধ্যে যাঁরা দরিদ্র তাঁদের উপর বিশেষ নজর দেওয়া, বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা। তা না হলে কোভিড অতিমারি অচিরেই পরিণত হবে বৈষম্যের অতিমারিতে।
অর্থনীতি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব নটিংহাম