Demography

সত্যিই ভারতের জনসংখ্যা এই মুহূর্তে চিনের থেকে বেশি? প্রকৃত ছবিটা ঠিক কেমন?

রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যান কোনও দৈববাণী নয়। এর পিছনে অন্য কিছু হিসেবনিকেশও কাজ করে। ভারতের জনসংখ্যার প্রকৃত ছবিটি ঠিক কেমন?

Advertisement

টি এন নাইনান

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৩ ১০:৪১
Share:

মানবিক ক্ষমতার সম্ভাবনাগুলিকে ইতিবাচক ভাবে ব্যবহার করা গেলে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-কে কাজে লাগানো যায়। ছবি: সংগৃহীত।

বেশির ভাগ গণমাধ্যমই সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রকাশ করা একটি তথ্যকে বিনাবিচারে মেনে নিয়েছে।সেটি হল— চলতি মাসে ভারত বিশ্বের সব থেকে জনবহুলদেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিসাব অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৪২ কোটি ৯০ লক্ষ।যা চিনের চাইতে সামান্য বেশি। আধুনিক জনগণনা শুরু হওয়ার পর থেকে এমনটি আগে কখনও ঘটেনি। বিশ্ব ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যানে সায় দিয়েছে। যদিও সেই সঙ্গে জানিয়েছে যে, তারা বিভিন্ন তথ্যসূত্র ব্যবহার করেছে, যেগুলির কোনওটিই সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের এই চিনকে ছাপিয়ে যাওয়া জনসংখ্যার বিষয়টিকে অনুমোদন করেনি।

Advertisement

আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, চিন বা ভারত— কেউই জনসংখ্যার নিরিখে ভারতের চিনকে ছাপিয়ে যাওয়ার তথ্যে সমর্থন জানায়নি। ২০২৩ সালে সরকারি ভাবে ভারতের জনসংখ্যা জানানো হয়েছিল ১৩৮ কোটি ৩০ লক্ষ। তুলনায় চিনের শেষতম জনগণনায় পাওয়া সে দেশের পরিসংখ্যান ছিল ১৪১ কোটি ২০ লক্ষ। আমেরিকার সেন্সাস ব্যুরো ভারতের স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (যার কাজ জন্ম-মৃত্যুর হারনির্ণয় করা) থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান, সেই সঙ্গে অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্য, কোভিডে মৃত্যুর হার এবং বিভিন্ন তথ্যভ্রান্তি মেনে যে সংখ্যাটি জানায়২০২৩ সালে,সেটি ১৩৯ কোটি ৯০ লক্ষ। আমেরিকার সেন্সাস ব্যুরোর দেওয়া চিনের জনসংখ্যাটি হল ১৪১ কোটি ৩০ লক্ষ। দেখাই যাচ্ছে, তাদের মতে ভারতের জনসংখ্যা চিনের চেয়ে বেশ খানিকটা কম। এর বাইরে ‘ওয়ার্ল্ডোমিটার’ নামে এক স্বাধীন ডিজিটাল ডেটা সংস্থা রাষ্ট্রপুঞ্জ উল্লিখিত পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে ‘বিস্তারিত’ ভাবে জানাচ্ছে যে, ভারতের সাম্প্রতিক জনসংখ্যা ১৪১ কোটি ৮০ লক্ষ, সেখানে চিনের জনসংখ্যা ১৪৫ কোটি ৫০ লক্ষ।

পরিসংখ্যানে সামান্য হেরফের নিয়ে এই আলোচনা অনেকের কাছেই বাগাড়ম্বর বলে মনে হতে পারে। চিনের চেয়ে ভারত যদি সামান্য পিছিয়েও থাকে, তাতে কী এমন এসে যায়! আগামী বছর দুয়েকের মধ্যেই ভারত চিনকে ছাপিয়ে যাবে। লক্ষ্য করার বিষয় এটাই যে, রাষ্ট্রপুঞ্জ জনসংখ্যা সংক্রান্ত বিষয়ে যখনই তথ্য দিতে গিয়েছে, তখনই তাতে ভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। ২০১০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ জানায়, ২০২১ নাগাদ ভারতের জনসংখ্যা চিনকে ছাপিয়ে যাবে। ২০২৫ নাগাদ চিনের চেয়ে ভারতের জনসংখ্যা কম করে ৬ কোটি ৩০ লক্ষ বেশি তো হবেই। ২০২১ সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়নি। ২০২৫ সংক্রান্তটিও যে ভ্রান্ত প্রমাণিত হতে চলেছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশই প্রায় নেই। ২০১৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়েছিল, ২০৫০ সাল নাগাদ ভারতের জনসংখ্যা ১৭০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। তেমনও ঘটবে বলে মনে হয় না। এ সবের মাঝখানে বলে রাখা ভাল যে, জনসংখ্যা সম্পর্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের দেওয়া এই পরিসংখ্যানগুলি পুনর্বিচারের প্রয়োজন রয়েছে, এগুলিকে দৈববাণী হিসেবে মেনে নেওয়ার কোনও মানে হয় না। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলি অবান্তর।

Advertisement

আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, চিনের জনসংখ্যা যখন তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে, তখনও ভারতের জনসংখ্যার বৃদ্ধি অব্যাহত। বহু পর্যবেক্ষক দেখিয়েছেন যে, ভারতীয় পরিসরে কর্মক্ষম বয়ঃসীমার জনগোষ্ঠীর মধ্যে এবং তরুণ বয়সিদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পিছনে কিছু সুবিধার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই কারণেই এক লপ্তে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ (কোনও দেশের জনসংখ্যার পরিবর্তনের ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক বৃদ্ধি) লাভ করা সম্ভব।কিন্তু এই লভ্যাংশ সম্পর্কে যতখানি বলা হয়, গত আড়াই দশকে তার থেকে বেশি ব্যয়িত হয়ে গিয়েছে। এমন একটি দেশ, যেখানে হামেশাই যতখানি প্রকৃত অর্জন, তার থেকে অনেকটাই বাড়িয়ে বলা হয়। ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’সম্পর্কিত অতিকথন হল— তা নিঃশেষিত হওয়ার পরেও বহমান থাকে। চিন কিন্তু বার বার এ কথাই বলে এসেছে যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের গুণগত উৎকর্ষের বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের জনসংখ্যার বৃদ্ধি আসলে এ দেশের শিক্ষা এবংস্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয়ই বহন করে। এমনকি,এখনও এক জন নিরক্ষর ভারতীয় নারী গড়ে কম করে তিনটি সন্তানের জন্ম দেন।সেখানে এক জন মোটামুটি লেখাপড়া জানা মহিলার ক্ষেত্রে সংখ্যাটি ১.৯। উত্তরপ্রদেশেশিশুজন্মেরহারকেরলেরদ্বিগুণ। অন্যদিকেআয়ুরদিক থেকে দেখলে কেরলের অংশ বিশেষের তুলনায় মধ্যপ্রদেশের মৃত্যুহার মোটামুটি হিসেবে প্রায় আট গুণ বেশি। উচ্চ মৃত্যুহার মায়েদের বেশি সংখ্যাক সন্তানের জন্ম দিতে প্রাণীত করে। এই বিশেষ চক্রব্যুহ থেকে তখনই বেরিয়ে আসা সম্ভব, যখন শিক্ষা ও গণস্বাস্থ্যের বিষয়গুলি এক বিশেষ গুণগত মান অর্জন করে।

এ সবের মধ্যে ইতিবাচক দিকটি এই যে, ভারতের জনসংখ্যার দশকওয়াড়ি বৃদ্ধির হার অর্ধেক কমে গিয়েছে। ১৯৬০, ’৭০ এবং ’৮০-র দশকে যা ছিল ২৪ শতাংশ, তা গত দশকে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে এবং এই হার ক্রমেই কমছে। দক্ষিণ এবং পশ্চিমের রাজ্যগুলিতে প্রজননের হার ‘রিপ্লেসমেন্ট লেভেল’ (প্রজনন হারের সেই স্তর, যেখানে জনসংখ্যা একটি প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছয়)-এর নীচেই থেকে গিয়েছে। দেশের দরিদ্রতর, শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা, উন্নয়নে পশ্চাদপদ অঞ্চলগুলিতেই জনসংখ্যা দীর্ঘমেয়াদে বেড়ে চলবে।

কিন্তু যখন জন্ম ও মৃত্যুর হার একই বিন্দুতে মিলে যায় এবং জনসংখ্যা পরিবর্তনের সীমায় উপনীত হয়, সেই সময়ে মানবিক ক্ষমতার সম্ভাবনাগুলিকে ইতিবাচক ভাবে ব্যবহার করা গেলে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-কে কাজে লাগানো যায়। এতে হয়তো দু’দশক সময় লেগে যেতে পারে। এই সময়ে সাম্প্রতিক প্রবণতা বজায় থাকলে ভারত হয়তো মধ্যকালপর্বের প্রারম্ভে উপস্থিত এক উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ হয়ে উঠতে পারে। এর জন্য ভারতকে অন্তত পক্ষে দু’দশক ধরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, লাতিন আমেরিকা বা চিনের মতো দেশের বর্তমান সময়ের জীবনযাপনের মান বজায় রাখতে হবে, যে সব দেশের মাথাপিছু আয় (ক্রয়ক্ষমতার সাম্য–সূচক বা পারচেজিং প্যারিটি নাম্বার্স-এর নিরিখে) ভারতের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement