নেতৃত্ব: ১৯৩৯ সালে মণিপুরে নুপি লান আন্দোলনে মেয়েরা। উইকিমিডিয়া কমন্স।
কলকাতা, ১৯৪৬। এই ডেটলাইন দেখলে আজও হয়তো ১৬ অগস্ট, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম মনে পড়ে। কিন্তু এ কাহিনি তারও আগে, ১০ এপ্রিলের। লালবাজার সে দিন ইম্ফলের স্বাধীনতাকামীদের একটি বার্তা ধরে ফেলে। নিখিল মণিপুর মহাসভা-র সভাপতি গোপন মেমোয় লিখছেন, “ইরাবত খোলাখুলি তাঁর মনোভাব জানান। মহাসভা কংগ্রেসের সমর্থক, কমিউনিস্টদের নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই।”
ইরাবত মানে হিজাম ইরাবত সিংহ। মহাযুদ্ধের শেষে তখনও ব্রিটিশ পুলিশ ‘কংগ্রেস’, ‘কমিউনিস্ট’ শব্দগুলি দেখলে সতর্ক। যে মণিপুর মহাসভা তাঁর জবাবদিহি চাইছে, ইরাবত তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। শুরুতে মণিপুরের মহারাজ চূড়াচন্দ্র সিংহ এর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তখন নাম ছিল নিখিল হিন্দু মণিপুর মহাসভা। সাংস্কৃতিক সংগঠন, মণিপুরের কবি-লেখকের অনেকেই সদস্য। ইরাবত নিজেও কবি, সিদাম সিরেং নামে কবিতার বইও আছে। ১৯২২-এ মেইতেই চানু নামে হাতে-লেখা পত্রিকা বার করেন, সেটাই মণিপুরের প্রথম সাময়িকপত্র। বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইল অনুবাদ করেছেন। চমৎকার পোলো খেলেন। মঞ্চে অভিনয়ও করেন, ওঁর আরেপ্পা মারুপে, নৃসিংহ নাটক রীতিমতো জনপ্রিয়। ইম্ফলে আধুনিক নাটকের প্রাণপুরুষ ললিত সিংহের ডান হাত এই ছেলে। মহাযুদ্ধের আগেই ‘মণিপুরি সঙ্গীত সম্মেলনী’ তৈরি করেন, সেটা এখন মণিপুরি সাহিত্য পরিষদ।
ছেলেবেলাতেই মা-বাবাকে হারানো, গরিব ঘরের প্রতিভাবান ছেলেটির সঙ্গে মণিপুরের মহারাজা চূড়াচন্দ্র সিংহ নিজের ভাইঝির বিয়ে দেন। তাঁকে সদর পঞ্চায়েতের সদস্যও করেছিলেন। ফি মাসে পঁচিশ টাকা মাইনে, সঙ্গে নিষ্কর ২৫ হেক্টর জমি। ইম্ফলের বৈষ্ণব মণিপুরি সমাজে মহারাজই প্রধান সমাজপতি। কে জাতে থাকবে, কাকে জল-অচল করা হবে, তিনিই ঠিক করেন। রাজবাড়ির জামাই প্রথমেই এই ‘মেংবা সেংবা’ প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, জাত-বেজাত তিনি মানেন না। তার পর গরিব চাষি ও জেলেদের উপর কর কমাতে বললেন। রাজদরবারের নির্দেশে পাহাড়ের বাসিন্দাদের সরকারি অফিসারদের মালপত্র বইতে হয়, বেগার শ্রম দিতে হয়। ইনি তারও বিরুদ্ধে। বলেন, হিন্দু-মুসলমান-সমতল-পাহাড় নির্বিশেষে মণিপুরের জনজাতিরা সকলে এক। পুরো রাজ্যে শাসনসংস্কার করে একটা আইনসভা থাকা উচিত। তা ঠিক হবে ভোটের নিরিখে, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে প্রত্যেকের একটি করে ভোট থাকবে! তাঁর এই সব দাবিদাওয়ার জেরে মহারাজ চূড়াচন্দ্র রেগে নিখিল হিন্দু মণিপুর মহাসভার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেন, সদস্যদের ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হন ইরাবত। সভাপতি হয়ে প্রথমেই ‘হিন্দু’ শব্দটিকে ছেঁটে দেন। সংগঠনের নাম তখন থেকে নিখিল মণিপুর মহাসভা। সেই সংগঠনই আজ ইরাবত সিংহের স্বীকারোক্তি চায়!
কিন্তু ইরাবত কি সত্যিই কমিউনিস্ট? তিনি গণতন্ত্রের কথা বলেন, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে প্রত্যেকের ভোটের অধিকার চান। শ্রেণিহীন সমাজ বা সর্বহারার একনায়কতন্ত্র নয়। নিখিল মণিপুর মহাসভা তৈরির পর রাজার সাফ নির্দেশ, কোনও সরকারি কর্মী ওই সংগঠনে থাকতে পারবেন না। তাঁরা চাকরির দায়ে বেরিয়ে এলেন। ইরাবত উল্টে ২৫ বিঘা জমি ও সদর পঞ্চায়েতের চাকরি ফিরিয়ে দিলেন। অতঃপর স্বদেশি ও সত্যাগ্রহ। আদালত চত্বরে খাদি পরে সঙ্গীদের নিয়ে এলেন ইরাবত, ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে জ্বালিয়ে দেওয়া হল বিলিতি বস্ত্র। মণিপুরে সেটাই প্রথম খাদি, প্রথম ‘বন্দে মাতরম্’। ব্রিটিশ পুলিশের গোপন রিপোর্ট, ১৯২২-এ কলকাতায় গান্ধীর সভায় যোগ দেন মণিপুরের এই রাজনীতিক। বয়স তখন মাত্র ছাব্বিশ। স্বদেশি, খাদিই কি তাঁকে প্রথম দেশপ্রেমের বার্তা দিয়েছিল?
ছিল নারীর প্রতি সহমর্মিতা। মণিপুরিরা যাতে নিজেরা ব্যবসায় নামেন, তা নিয়ে নিখিল মণিপুর মহাসভায় প্রায়ই কথা বলেছেন ইরাবত। ১৯৩৯-এ একটা ঘটনা ঘটল। বরাবর মণিপুর থেকে চাল বাইরে পাঠানো হত। রাজদরবার ঠিক করত, কত চাল রফতানি হবে। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে ব্রিটিশের তৈরি নতুন প্রথায় সেই নিয়ন্ত্রণ আর নেই, পুরোটাই ব্যবসায়ীদের হাতে। দুর্ভিক্ষ দেখে সেপ্টেম্বরে রাজা জানালেন, নতুন বিজ্ঞপ্তি না দেওয়া অবধি মণিপুরের বাইরে চাল পাঠানো বন্ধ। কিন্তু কিস্তোরচাঁদ সারাওগি, গোবিন্দ লাল প্রমুখ ব্যবসায়ীর চাপে নভেম্বরেই নোটিস তুলে দেওয়া হল। নৃপতি ও ব্যবসায়ীর অসাধু সমঝোতার বিরুদ্ধে শুরু হল ‘নুপি লান’ আন্দোলন, পুরোভাগে মেয়েরা। অতঃপর পুলিশের বুলেটে এক মহিলার মৃত্যু, কেউ কেউ মহাসভার শরণাপন্ন হলেন। অন্য নেতারা নীরব, কিন্তু ইরাবত কয়েক জনকে নিয়ে তৈরি করলেন ‘মণিপুর প্রজা সম্মেলনী’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল। বললেন, “চেয়েছিলাম এক মুঠো ভাত, দাম দিতে হল দুই মুঠোভর্তি রক্ত। মেয়েদের কাজ শেষ, এ বার আমাদের ওই রক্তঋণ শোধ করতে হবে।” রাজা ও ব্রিটিশ কমিশনারের কাছে এ কথা হিংসাত্মক ঠেকল। বিচারে ইরাবতকে তিন বছরের জন্য পাঠানো হল রাজ্যের বাইরে, শ্রীহট্টের জেলে।
শ্রীহট্টেই কংগ্রেসি রাজবন্দিদের পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। ১৯৪৩-এ তাঁর মুক্তির সময় ব্রিটিশ পলিটিক্যাল এজেন্টকে মহারাজ বোধচন্দ্রের চিঠি, “ইরাবত সিংহ যদি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে থাকেন, তাঁকে মণিপুরে ঢুকতে না দেওয়া উচিত।” বেচারি ইরাবত চলে গেলেন অসমের কাছাড়ে। সেখানেই বিজন ভট্টাচার্য, বলরাজ সাহনি, সলিল চৌধুরীর গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যোগাযোগ। হেমাঙ্গ বিশ্বাস আত্মজীবনীতে লিখছেন, “আমাদের জনপ্রিয় গানগুলি মণিপুরি ভাষায় অনুবাদ করে তিনি কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন।... ১৯৪৬ সালে আমাদের একটি দল নেত্রকোনায় সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলনে যোগদান করে। সেখানে ইরাবতও গিয়েছিলেন।” সে বছরেই অসমের প্রাদেশিক নির্বাচনে শিলচর থেকে সিপিআই প্রার্থী হিসাবে দাঁড়ান ইরাবত। কিন্তু কংগ্রেস প্রার্থী সতীন্দ্রমোহন দেবের কাছে ৩৯৫৩ ভোটে হেরে যান।
ভোটে পরাস্ত সেই প্রার্থীকে নিয়েই গোপন বার্তা বাজেয়াপ্ত করেছে কলকাতা পুলিশ। আর ইরাবত? তিনি বারংবার জানাচ্ছেন, মণিপুর মহাসভার হয়েই তাঁর কাজ, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য তিনি নন। কিন্তু শোনে কে? বছরের শেষ দিকে ইম্ফলের এরিয়ান থিয়েটার হলে তুমুল হট্টগোল, সব রাজনৈতিক দল চায় দায়িত্বশীল সরকার তৈরির দায়ভার। কমিউনিস্ট সন্দেহে ইরাবত সিংহ ও তাঁর প্রজা সঙ্ঘকে কিছু বলতে দেওয়া হল না, তাঁরা বেরিয়ে গেলেন। সভায় তৈরি হল নতুন দল— মণিপুর রাজ্য কংগ্রেস।
এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট সকালে দেশ ‘জনগণমন’ গাইতে গাইতে স্বাধীন হয়ে গেল, এমন নয়। কাশ্মীর, হায়দরাবাদের মতো মণিপুরকেও ভারতভুক্তির চুক্তি সই করতে হয়েছিল। তবে বোধচন্দ্র ভেবেছিলেন, ভোটে একটা সংবিধানসভা তৈরি করা যাক! ইরাবতের মণিপুর প্রজা সঙ্ঘ এই ভোট বয়কট করে। রাজ-আজ্ঞা ছিল, যারা জমির মালিক শুধু তারাই ভোট দেবে। ইরাবতের বক্তব্য, ভোট সবার অধিকার। এমনকি মণিপুর ভারতের সঙ্গে থাকবে কি না সেটাও রাজার ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, লোকে ভোটে ঠিক করবে! ইরাবতরা ভোট বয়কটে, কংগ্রেসও পেল না নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা। ১৯৪৮-এ প্রজা শান্তি পার্টি নামে অ-কংগ্রেসি এক দল কৃষকসভা ও পাহাড়ের নির্দল বিধায়কদের সঙ্গে তৈরি করল মণিপুরের প্রথম নির্বাচিত বিধানসভা। রাজা বোধচন্দ্র অধিবেশনের শুরুতেই জানালেন, “এঁরাই এখন দায়িত্বে, আমি সাংবিধানিক প্রধান মাত্র।” এই সময়েই নয়াদিল্লির পূর্বাঞ্চল রাজ্যের প্রস্তাব: মণিপুর, কাছাড়, ত্রিপুরা ও লুসাই পাহাড় নিয়ে তৈরি হবে আলাদা রাজ্য। স্থানীয়রা সকলে বিপক্ষে, ২১ সেপ্টেম্বর ইম্ফলে এর বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন ইরাবত, তখনই পুংদোংবাম-এর মিছিলে পুলিশের গুলি চলল। জনতার পাল্টা মারে এক পুলিশ অফিসার মারা যান। খবরটা পৌঁছতেই সভার মাঝপথে বেরিয়ে যান ইরাবত। জানতেন, তাঁকেই এ বার দোষী সাজানো হবে। সেটাই হল। ইরাবতের মাথার দাম ধার্য হল দশ হাজার টাকা। অথচ পুংদোংবাম নিয়ে তদন্ত হল না।
ইরাবত তত ক্ষণে অনেক দূরে, মায়ানমারের পথে। ১৯৫১ সালে খবর এল, তিনি মারা গিয়েছেন। আরও পরে হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁকে নিয়ে ‘সীমান্তপ্রহরী’ কবিতা লিখবেন, “সীমান্তে তুমি সান্ত্রী আজ/ সীমান্তে তোমার দীপ্ত অগ্নিশিখা।” আর তাঁর সাধের মণিপুর? অন্তর্ধানের পর বছর ঘুরল না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই পটেলের নির্দেশে বোধচন্দ্রকে গৃহবন্দি রাখা হল, ১৯৪৯-এর ২১ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতভুক্তির চুক্তিতে সই করলেন। আগের বছরই নবগঠিত মন্ত্রিসভাকে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সদ্যনির্মিত ভারতরাষ্ট্রের লৌহপুরুষ ছাড়বেন কেন? সে দিন থেকেই মণিপুর নিয়ে কেউ আর প্রশ্ন তোলে না। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট কেউ না। ইরাবত সিংহ অন্তর্ধান থেকে ফেরেননি যে!
হিজাম ইরাবত সিংহ।
ছেলেবেলাতেই মা-বাবাকে হারানো, গরিব ঘরের প্রতিভাবান ছেলেটির সঙ্গে মণিপুরের মহারাজা চূড়াচন্দ্র সিংহ নিজের ভাইঝির বিয়ে দেন। তাঁকে সদর পঞ্চায়েতের সদস্যও করেছিলেন। ফি মাসে পঁচিশ টাকা মাইনে, সঙ্গে নিষ্কর ২৫ হেক্টর জমি। ইম্ফলের বৈষ্ণব মণিপুরি সমাজে মহারাজই প্রধান সমাজপতি। কে জাতে থাকবে, কাকে জল-অচল করা হবে, তিনিই ঠিক করেন। রাজবাড়ির জামাই প্রথমেই এই ‘মেংবা সেংবা’ প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, জাত-বেজাত তিনি মানেন না। তার পর গরিব চাষি ও জেলেদের উপর কর কমাতে বললেন। রাজদরবারের নির্দেশে পাহাড়ের বাসিন্দাদের সরকারি অফিসারদের মালপত্র বইতে হয়, বেগার শ্রম দিতে হয়। ইনি তারও বিরুদ্ধে। বলেন, হিন্দু-মুসলমান-সমতল-পাহাড় নির্বিশেষে মণিপুরের জনজাতিরা সকলে এক। পুরো রাজ্যে শাসনসংস্কার করে একটা আইনসভা থাকা উচিত। তা ঠিক হবে ভোটের নিরিখে, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে প্রত্যেকের একটি করে ভোট থাকবে! তাঁর এই সব দাবিদাওয়ার জেরে মহারাজ চূড়াচন্দ্র রেগে নিখিল হিন্দু মণিপুর মহাসভার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেন, সদস্যদের ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হন ইরাবত। সভাপতি হয়ে প্রথমেই ‘হিন্দু’ শব্দটিকে ছেঁটে দেন। সংগঠনের নাম তখন থেকে নিখিল মণিপুর মহাসভা। সেই সংগঠনই আজ ইরাবত সিংহের স্বীকারোক্তি চায়!
কিন্তু ইরাবত কি সত্যিই কমিউনিস্ট? তিনি গণতন্ত্রের কথা বলেন, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে প্রত্যেকের ভোটের অধিকার চান। শ্রেণিহীন সমাজ বা সর্বহারার একনায়কতন্ত্র নয়। নিখিল মণিপুর মহাসভা তৈরির পর রাজার সাফ নির্দেশ, কোনও সরকারি কর্মী ওই সংগঠনে থাকতে পারবেন না। তাঁরা চাকরির দায়ে বেরিয়ে এলেন। ইরাবত উল্টে ২৫ বিঘা জমি ও সদর পঞ্চায়েতের চাকরি ফিরিয়ে দিলেন। অতঃপর স্বদেশি ও সত্যাগ্রহ। আদালত চত্বরে খাদি পরে সঙ্গীদের নিয়ে এলেন ইরাবত, ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে জ্বালিয়ে দেওয়া হল বিলিতি বস্ত্র। মণিপুরে সেটাই প্রথম খাদি, প্রথম ‘বন্দে মাতরম্’। ব্রিটিশ পুলিশের গোপন রিপোর্ট, ১৯২২-এ কলকাতায় গান্ধীর সভায় যোগ দেন মণিপুরের এই রাজনীতিক। বয়স তখন মাত্র ছাব্বিশ। স্বদেশি, খাদিই কি তাঁকে প্রথম দেশপ্রেমের বার্তা দিয়েছিল?
ছিল নারীর প্রতি সহমর্মিতা। মণিপুরিরা যাতে নিজেরা ব্যবসায় নামেন, তা নিয়ে নিখিল মণিপুর মহাসভায় প্রায়ই কথা বলেছেন ইরাবত। ১৯৩৯-এ একটা ঘটনা ঘটল। বরাবর মণিপুর থেকে চাল বাইরে পাঠানো হত। রাজদরবার ঠিক করত, কত চাল রফতানি হবে। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে ব্রিটিশের তৈরি নতুন প্রথায় সেই নিয়ন্ত্রণ আর নেই, পুরোটাই ব্যবসায়ীদের হাতে। দুর্ভিক্ষ দেখে সেপ্টেম্বরে রাজা জানালেন, নতুন বিজ্ঞপ্তি না দেওয়া অবধি মণিপুরের বাইরে চাল পাঠানো বন্ধ। কিন্তু কিস্তোরচাঁদ সারাওগি, গোবিন্দ লাল প্রমুখ ব্যবসায়ীর চাপে নভেম্বরেই নোটিস তুলে দেওয়া হল। নৃপতি ও ব্যবসায়ীর অসাধু সমঝোতার বিরুদ্ধে শুরু হল ‘নুপি লান’ আন্দোলন, পুরোভাগে মেয়েরা। অতঃপর পুলিশের বুলেটে এক মহিলার মৃত্যু, কেউ কেউ মহাসভার শরণাপন্ন হলেন। অন্য নেতারা নীরব, কিন্তু ইরাবত কয়েক জনকে নিয়ে তৈরি করলেন ‘মণিপুর প্রজা সম্মেলনী’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল। বললেন, “চেয়েছিলাম এক মুঠো ভাত, দাম দিতে হল দুই মুঠোভর্তি রক্ত। মেয়েদের কাজ শেষ, এ বার আমাদের ওই রক্তঋণ শোধ করতে হবে।” রাজা ও ব্রিটিশ কমিশনারের কাছে এ কথা হিংসাত্মক ঠেকল। বিচারে ইরাবতকে তিন বছরের জন্য পাঠানো হল রাজ্যের বাইরে, শ্রীহট্টের জেলে।
শ্রীহট্টেই কংগ্রেসি রাজবন্দিদের পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। ১৯৪৩-এ তাঁর মুক্তির সময় ব্রিটিশ পলিটিক্যাল এজেন্টকে মহারাজ বোধচন্দ্রের চিঠি, “ইরাবত সিংহ যদি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে থাকেন, তাঁকে মণিপুরে ঢুকতে না দেওয়া উচিত।” বেচারি ইরাবত চলে গেলেন অসমের কাছাড়ে। সেখানেই বিজন ভট্টাচার্য, বলরাজ সাহনি, সলিল চৌধুরীর গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যোগাযোগ। হেমাঙ্গ বিশ্বাস আত্মজীবনীতে লিখছেন, “আমাদের জনপ্রিয় গানগুলি মণিপুরি ভাষায় অনুবাদ করে তিনি কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন।... ১৯৪৬ সালে আমাদের একটি দল নেত্রকোনায় সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলনে যোগদান করে। সেখানে ইরাবতও গিয়েছিলেন।” সে বছরেই অসমের প্রাদেশিক নির্বাচনে শিলচর থেকে সিপিআই প্রার্থী হিসাবে দাঁড়ান ইরাবত। কিন্তু কংগ্রেস প্রার্থী সতীন্দ্রমোহন দেবের কাছে ৩৯৫৩ ভোটে হেরে যান।
ভোটে পরাস্ত সেই প্রার্থীকে নিয়েই গোপন বার্তা বাজেয়াপ্ত করেছে কলকাতা পুলিশ। আর ইরাবত? তিনি বারংবার জানাচ্ছেন, মণিপুর মহাসভার হয়েই তাঁর কাজ, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য তিনি নন। কিন্তু শোনে কে? বছরের শেষ দিকে ইম্ফলের এরিয়ান থিয়েটার হলে তুমুল হট্টগোল, সব রাজনৈতিক দল চায় দায়িত্বশীল সরকার তৈরির দায়ভার। কমিউনিস্ট সন্দেহে ইরাবত সিংহ ও তাঁর প্রজা সঙ্ঘকে কিছু বলতে দেওয়া হল না, তাঁরা বেরিয়ে গেলেন। সভায় তৈরি হল নতুন দল— মণিপুর রাজ্য কংগ্রেস।
এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট সকালে দেশ ‘জনগণমন’ গাইতে গাইতে স্বাধীন হয়ে গেল, এমন নয়। কাশ্মীর, হায়দরাবাদের মতো মণিপুরকেও ভারতভুক্তির চুক্তি সই করতে হয়েছিল। তবে বোধচন্দ্র ভেবেছিলেন, ভোটে একটা সংবিধানসভা তৈরি করা যাক! ইরাবতের মণিপুর প্রজা সঙ্ঘ এই ভোট বয়কট করে। রাজ-আজ্ঞা ছিল, যারা জমির মালিক শুধু তারাই ভোট দেবে। ইরাবতের বক্তব্য, ভোট সবার অধিকার। এমনকি মণিপুর ভারতের সঙ্গে থাকবে কি না সেটাও রাজার ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, লোকে ভোটে ঠিক করবে! ইরাবতরা ভোট বয়কটে, কংগ্রেসও পেল না নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা। ১৯৪৮-এ প্রজা শান্তি পার্টি নামে অ-কংগ্রেসি এক দল কৃষকসভা ও পাহাড়ের নির্দল বিধায়কদের সঙ্গে তৈরি করল মণিপুরের প্রথম নির্বাচিত বিধানসভা। রাজা বোধচন্দ্র অধিবেশনের শুরুতেই জানালেন, “এঁরাই এখন দায়িত্বে, আমি সাংবিধানিক প্রধান মাত্র।” এই সময়েই নয়াদিল্লির পূর্বাঞ্চল রাজ্যের প্রস্তাব: মণিপুর, কাছাড়, ত্রিপুরা ও লুসাই পাহাড় নিয়ে তৈরি হবে আলাদা রাজ্য। স্থানীয়রা সকলে বিপক্ষে, ২১ সেপ্টেম্বর ইম্ফলে এর বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন ইরাবত, তখনই পুংদোংবাম-এর মিছিলে পুলিশের গুলি চলল। জনতার পাল্টা মারে এক পুলিশ অফিসার মারা যান। খবরটা পৌঁছতেই সভার মাঝপথে বেরিয়ে যান ইরাবত। জানতেন, তাঁকেই এ বার দোষী সাজানো হবে। সেটাই হল। ইরাবতের মাথার দাম ধার্য হল দশ হাজার টাকা। অথচ পুংদোংবাম নিয়ে তদন্ত হল না।
ইরাবত তত ক্ষণে অনেক দূরে, মায়ানমারের পথে। ১৯৫১ সালে খবর এল, তিনি মারা গিয়েছেন। আরও পরে হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁকে নিয়ে ‘সীমান্তপ্রহরী’ কবিতা লিখবেন, “সীমান্তে তুমি সান্ত্রী আজ/ সীমান্তে তোমার দীপ্ত অগ্নিশিখা।” আর তাঁর সাধের মণিপুর? অন্তর্ধানের পর বছর ঘুরল না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই পটেলের নির্দেশে বোধচন্দ্রকে গৃহবন্দি রাখা হল, ১৯৪৯-এর ২১ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতভুক্তির চুক্তিতে সই করলেন। আগের বছরই নবগঠিত মন্ত্রিসভাকে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সদ্যনির্মিত ভারতরাষ্ট্রের লৌহপুরুষ ছাড়বেন কেন? সে দিন থেকেই মণিপুর নিয়ে কেউ আর প্রশ্ন তোলে না। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট কেউ না। ইরাবত সিংহ অন্তর্ধান থেকে ফেরেননি যে!