আবার বছর কুড়ি পরে
Gujarat Model

গুজরাত মডেল যথেষ্ট নয়, ২০০২-এর স্মৃতি ফেরানো জরুরি

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরে নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন চলছে, তখন প্রধানমন্ত্রী মোদী ঝাড়খণ্ডে ভোটের প্রচারে গিয়ে ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২২ ০৬:৩২
Share:

অস্মিতা? গুজরাত বিধানসভার নির্বাচনী প্রচারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। আমদাবাদ, ২২ নভেম্বর ২০২২। পিটিআই

নিহত ১০৪৪ জন। নিখোঁজ ২২৩ জন। আহত প্রায় আড়াই হাজার। ১০৪৪ জন নিহতের মধ্যে হিন্দু ২৫৪ জন। মুসলমান ৭৯০ জন। ২০০২ সালে গুজরাতের সাম্প্রদায়িক হিংসায় হতাহতের সরকারি হিসাব। কুড়ি বছর পরে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গুজরাতের ভোট প্রচারে গিয়ে যখন হাসতে হাসতে বলেন, ২০০২-এ নরেন্দ্র মোদীর শাসনে ‘ওদের’ এমন শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল যে, তার পরে গুজরাতে ‘অখণ্ড শান্তি’ বিরাজ করছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, তিনি কাদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার কথা বলছেন। কাদের দিকে ‘অশান্তি’ তৈরির অভিযোগ তুলছেন।

Advertisement

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের একাংশকে এ ভাবে দাগিয়ে দেওয়াটা নতুন নয়। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরে নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন চলছে, তখন প্রধানমন্ত্রী মোদী ঝাড়খণ্ডে ভোটের প্রচারে গিয়ে ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। দুমকার জনসভা থেকে বলেছিলেন, “কিছু লোক হল্লা করছে, ঝড় তুলছে। ওদের কথা কানে তোলা না হলে আগুন ছড়াচ্ছে। যারা আগুন লাগাচ্ছে, তাদের টিভিতে দেখা যাচ্ছে। এরা কারা, তা ওদের জামাকাপড় থেকেই জানা যায়।”

সিএএ-এনআরসি আপাতত শিকেয় তুলে রাখা হয়েছে— হয়তো প্রয়োজনে নামানো হবে। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ তাঁদের ঘরের মাঠ গুজরাতের ভোটে ঝুলি থেকে ২০০২-এর গুজরাতের হিংসা বার করে এনেছেন। প্রশ্ন হল, আবার বছর কুড়ি পরে হঠাৎ পুরনো হাতিয়ারে শাণ দেওয়ার কেন দরকার পড়ল? এমনিতেই গুজরাতের ভোটে কংগ্রেস পাঁচ বছর আগের মতো সক্রিয় নয়। আম আদমি পার্টি ময়দানে নেমেছে। তবে অরবিন্দ কেজরীওয়াল শেষ পর্যন্ত বিরোধী ভোট কেটে বিজেপিরই ফয়দা করে দেবেন বলে অনুমান। সমস্ত পূর্বাভাস বলছে, বিজেপি এ বার হাসতে হাসতে ভোটে জিতবে। তা সত্ত্বেও কেন বিশ বছর আগের সাম্প্রদায়িক হিংসার পক্ষে সওয়ালের প্রয়োজন পড়ল?

Advertisement

একে নিছক গুজরাত ভোটের আগে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা ভাবলে ভুল করবেন। কুড়ি বছর পরে ২০০২-এর গুজরাত হিংসাকে ‘উচিত শিক্ষা’ বলে তকমা দেওয়ার আসল উদ্দেশ্য হল এক প্রকার ইতিহাসের পুনর্লিখন। যে ভাবে এখন বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে এক পঙ্‌ক্তিতে বসানো হচ্ছে। বা মোগলদের সঙ্গে দেশীয় রাজাদের যুদ্ধকে স্রেফ হিন্দু বনাম মুসলমানের লড়াই হিসাবে দেখানো হচ্ছে। এটা সেই একই ভাবে ২০০২-এর গুজরাত হিংসার ইতিহাসকে নতুন মোড়কে পেশ করা। যা হয়েছিল, সব ঠিকই হয়েছিল বলে প্রমাণ করার চেষ্টা।

২০০২-এর হিংসা নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক জীবনে কালির দাগ হয়ে থেকে গিয়েছে। রাজ্যের নাগরিকদের একটি সম্প্রদায়ের মানুষের খুন-ধর্ষণ দেখেও মোদীর গুজরাত সরকার হাত গুটিয়ে বসেছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও মোদী বহু দেশের ভিসা পাননি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদীকে ‘রাজধর্ম’ পালনের কথা স্মরণ করিয়েছিলেন। তাই মোদী যে ঠিক কাজই করেছিলেন, তা প্রমাণ করার দায় থেকেই গিয়েছিল।

অমিত শাহ সেই কাজটিই করছেন। জমি তৈরিই ছিল। সুপ্রিম কোর্ট পাঁচ মাস আগেই গুজরাতের হিংসায় নিহত কংগ্রেস নেতা এহসান জাফরির স্ত্রী জ়াকিয়া জাফরির আর্জি খারিজ করে দিয়েছে। বিশেষ তদন্তকারী দল নরেন্দ্র মোদী ও রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের ‘ক্লিনচিট’ দিয়েছিল। তার প্রতিবাদেই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন জ়াকিয়া। দাবি করেছিলেন, ওই হিংসার পিছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র ছিল। সুপ্রিম কোর্ট তা খারিজ করে দিয়েছে। যার অর্থ, নরেন্দ্র মোদীকে দেওয়া ‘ক্লিনচিট’-এ শীর্ষ আদালত সিলমোহর বসিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পরেই গুজরাতের প্রাক্তন পুলিশকর্তা আর বি শ্রীকুমার ও সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাড়কে গ্রেফতার করেছিল গুজরাত পুলিশ। পুলিশের দাবি ছিল, শ্রীকুমার গুজরাত সরকারের দিকে মিথ্যে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন। আর তিস্তা প্রয়াত কংগ্রেস নেতা আহমেদ পটেলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গুজরাতের মোদী সরকারকে কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছিলেন। তথ্যপ্রমাণে কারচুপি করেছিলেন। ২০০২-এ ওই হিংসার সময়ই গোধরায় গণধর্ষণের শিকার হন বিলকিস বানো। বিলকিসের ধর্ষণে দোষীদেরও অক্টোবরে গুজরাতের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হল। অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তাতে সায় দিয়েছে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে ধর্ষণ-খুনে সাজাপ্রাপ্তদের রীতিমতো গলায় মালা পরিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয়েছে। তাদের ‘সংস্কারী ব্রাহ্মণ’ বলে তকমা দেওয়া বিজেপি বিধায়ক ফের ভোটে টিকিট পেয়েছেন।

যাবতীয় আয়োজনের একটাই লক্ষ্য। গুজরাতে নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বের ইতিহাস থেকে ২০০২-এর কালিমা ধুয়ে ফেলা। যা হয়েছিল, তা সমাজবিরোধীদের ঠান্ডা করার অভিযান বলে প্রমাণ করা। হিংসা হচ্ছে দেখেও সরকার কিছু করেনি বলে অভিযোগকে হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া। এর পিছনে মুসলিমদের দমনের কোনও বৃহত্তর ষড়যন্ত্র ছিল বলে যে অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই তা খারিজ করে দিয়েছে। ধর্ষণ-খুনে দোষী সাব্যস্তদেরও এ বার মূল স্রোতে ফেরানো শুরু হয়েছে। সব শেষে দেশের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গুজরাতের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, সবটাই ছিল ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার অভিযান। গুজরাতে ‘অখণ্ড শান্তি’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য। গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচন ছাড়া এর থেকে ভাল মঞ্চ আর কী-ই বা হতে পারত?

বিজেপি এ বার গুজরাতে রেকর্ড আসনে জেতার পণ করেছে। মোদী চাইছেন, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র পটেল তাঁর রেকর্ডও ভেঙে দিন। কেন? কারণ মোদী-শাহ জানেন, ৮ ডিসেম্বর গুজরাতের সঙ্গে হিমাচলের ভোটের ফল বেরোবে। ঠিক তার আগের দিন দিল্লির পুরভোটের ফল প্রকাশ। গুজরাত ছাড়া হিমাচলের বিধানসভা বা দিল্লির পুরভোটে বিজেপির জেতার নিশ্চয়তা নেই। ফলে গুজরাতের ভোটে রেকর্ড আসনে জিতলে তা হিমাচল, দিল্লির খারাপ ফলকে ঢেকে দিতে পরে। আগামী বছর কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান, তেলঙ্গানার মতো বড় রাজ্যে বিধানসভা ভোট। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে সেমিফাইনাল। কিন্তু এর কোনও রাজ্যেই বিজেপি নেতারা হলফ করে জয়ের দাবি করতে পারবেন না। নিজের রাজ্যে রেকর্ডসংখ্যক আসনে জয় থেকেই মোদী-শাহ ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের দৌড় শুরু করে দিতে চাইছেন।

এবং এখানেও ২০০২-এর গুরুত্ব। এখনও পর্যন্ত গুজরাতের ১৮২টি বিধানসভা আসনে বিজেপি সর্বোচ্চ ১২৭টি আসন জিতেছে। সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছে ৪৯.৮৫ শতাংশ। এই দুই রেকর্ডই তৈরি হয়েছিল ২০০২-এ, হিংসার ঠিক পরের নির্বাচনে। এ বার সেই রেকর্ড ভাঙতে তাই ২০০২-এর স্মৃতি ফেরানোর দরকার ছিল। শুধু গুজরাত মডেলের বাজনায় তা সম্ভব নয়।

যে ‘গুজরাত মডেল’ দেখিয়ে মোদীর দিল্লির গদিতে উত্থান, তার ফাঁকফোকর নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকে গিয়েছে। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে অধ্যাপক ক্রিস্তাফ জাফরেলো একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যার শিরোনাম ছিল, ‘হোয়াট গুজরাত মডেল? গ্রোথ উইদাউট ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড উইথ সোশিয়ো-পলিটিক্যাল পোলারাইজ়েশন’— গুজরাত মডেল কী? উন্নয়ন ছাড়া বৃদ্ধি এবং সামাজিক-রাজনৈতিক মেরুকরণ। তিনি লিখেছিলেন, মোদী জমানায় গুজরাত অভাবনীয় আর্থিক বৃদ্ধি ছুঁয়েছিল। উল্টো দিকে, তাঁর রাজনীতি ও সরকারি নীতি অসাম্য তৈরি করেছে। শিল্পপতিরা কর ছাড়, কম দামে সহজে জমি পেয়েছেন। শ্রমিকদের কম বেতন জুটেছে। অন্য রাজ্যের তুলনায় গুজরাতে শিক্ষা-স্বাস্থ্যে কম খরচ হয়েছে। মধ্যবিত্তরা লাভবান হলেও, গরিব মুসলিম, আদিবাসী, দলিতরা বঞ্চিত থেকেছেন। তৈরি হয়েছে সামাজিক মেরুকরণ। এই অসাম্য ও সামাজিক মেরুকরণ ধামাচাপা দিয়ে রাখতে বরাবরই ধর্মীয় মেরুকরণ নামক থান ইটের প্রয়োজন হয়। জাফরেলো লিখেছিলেন, দারিদ্র সত্ত্বেও মোদী জিতেছেন। কারণ, ২০০২-এর হিংসা ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ বিজেপিকে গরিব হিন্দুদের ভোট জিততেও সাহায্য করেছিল।

একই লক্ষ্যে ২০০২-এর হিংসা ভোটের ভাষ্যে ফিরে এসেছে। আবার বছর কুড়ি পরে।a

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement