Earth Day

মুখোশের আড়ালের সমীকরণ

কিছু দিন আগে আসা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশিকায় সবার কাছে আবেদন করা হয়েছিল যেন তাপমাত্রা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা হয় ইত্যাদি।

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২৪ ০৯:৫৩
Share:

এই বছর এই বঙ্গে বৃষ্টি আসার আগে মরুশহর ভেসে গেছে প্রবল বর্ষণে, অথচ গাঙ্গেয় উপত্যকা-সহ সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে মেঘ, বৃষ্টি, কালবৈশাখী ছিল না। ছিল তাপপ্রবাহ। বিভ্রান্ত, বিধ্বস্ত সাধারণ মানুষ। ‘উষ্ণায়ন’ বা ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ এখন শিশুপাঠ্য বইয়ের অংশ। এক অধুনা পরিচিত দৈত্য, যাকে জব্দ করার জন্য এসি ব্যবহার কম করতে হবে, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, বাড়ির বারান্দায় গাছ লাগাতে হবে, প্লাস্টিক বর্জন করতে হবে। উপায় যখন জানা, তা হলে বোঝা যায় সবাইকেই এই নিয়ম পালন করতে হবে।

Advertisement

কিছু দিন আগে আসা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশিকায় সবার কাছে আবেদন করা হয়েছিল যেন তাপমাত্রা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা হয় ইত্যাদি। এই সবাই সাধারণ মানুষ, যাঁরা বদলে যাওয়া তাপমাত্রার কারণে প্রাত্যহিক বাজেটের কাটছাঁট করেও এসি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। এবং যাঁদের এসি ব্যবহারকে দায়ী করা হচ্ছে উষ্ণায়নের ও বায়ুদূষণের এক বড় কারণ হিসেবে। যন্ত্র যদি সঠিক ভাবে সক্রিয় থাকে, তা হলে তা থেকে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন বার হয় না। সিএফসি নির্গত হয় এসি বা রেফ্রিজারেটর যন্ত্র তৈরি হওয়ার সময়। যদি ব্যবহারের সময় ক্ষতিকারক গ্যাস নির্গত হয়ও— তা ব্যক্তিগত ব্যবহারের থেকে অনেক বেশি হারে হয় শপিং মল বা বিপণিতে, যেখানে মাথাপিছু এসির ব্যবহার অনেক বেশি। কিন্তু যে নির্দেশিকা ব্যক্তিগত স্তরে আমাদের কাছে এসে পৌঁছছে, তা একই ভাবে শপিং মল বা নামীদামি উৎপাদক সংস্থার কাছে গেছে তো? অর্থনৈতিক উন্নতির দোহাই দিয়ে দেশি, বিদেশি সংস্থা অনেক বেশি ছাড় পেয়ে যাচ্ছে না তো? সাধারণ মানুষ ও বহুজাতিক সংস্থার মধ্যে তারতম্য তৈরি হচ্ছে না তো।

২২ এপ্রিল পালিত হল পৃথিবী দিবস। এ বছরের বিষয় ছিল ‘প্ল্যানেট ভার্সেস প্লাস্টিক’। প্লাস্টিক বর্জনের গুরুত্বের কথা সেখানে আলোচিত হয়, ব্যক্তিগত স্তরে এই নিয়ম পালনের উপর জোর দেওয়া হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মতো এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠে আসে— এখানে কি একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে? না কি পার্থক্য দেখা দেবে ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ উদ্যোগের মধ্যে? ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক ক্ষেত্রের মধ্যেও পার্থক্য দেখা দেবে কি? আমরা দুধ বা ঠাকুরের ফুল কেনার সময় বাড়ি থেকে বাজারের থলে নিয়ে যাব, ফুলওয়ালা ছেলেটিও শাস্তির ভয়ে প্লাস্টিক লুকিয়ে রাখবে, কিন্তু কোনও বড় ব্যবসার প্রয়োজনীয় প্লাস্টিক বা প্লাস্টিকজাত দ্রব্য বন্ধ হবে কি? বড় সংস্থাগুলি যে বায়োডিগ্রেডেবল ফাইবার প্লেট, ব্যাগের কথা বলে, তাতে প্লাস্টিকের সমানই রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়— কিন্তু প্রচার করা হয় কম দূষণমূলক বলে।

Advertisement

ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার ‘কর্পোরেশনস ভার্সেস কনজ়িউমার্স’ প্রবন্ধে গবেষকরা বলেন ১৯৮৮ সাল থেকে মাত্র ১০০টি সংস্থা সারা বিশ্বের ৭১% গ্রিনহাউস গ্যাসের জন্য দায়ী। বিভিন্ন তেল ও গ্যাস সংস্থা (যেমন— ইউনাইটেড কিংডমের ব্রিটিশ পেট্রলিয়াম) এখন বিদ্যুৎচালিত গাড়ির কথা বললেও এখনও তাদের ৯৬% বাজেট তেল ও গ্যাসেই ব্যবহৃত হয়। হার্ভার্ড পলিটিক্যাল রিভিউ-এর গবেষণা বলে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ২০টি সংস্থা এ-যাবৎ কালের গ্রিনহাউস নিঃসরণের ৩৩%-এর জন্য দায়ী। যে প্লাস্টিক ব্যাগ বা স্ট্র ব্যবহার বন্ধের কথা বলা হয় সাধারণ মানুষকে, তা বিশ্বের প্লাস্টিক দূষণের মাত্র ১%-এর জন্য দায়ী।

এই তথ্যরা মিলেমিশে তৈরি হয় সবুজ ধনতন্ত্রের জমি। যে ব্যক্তিগত কার্বন ফুটপ্রিন্টের কথা বলা হয়, তা উদ্ভাবন করেননি কোনও বিজ্ঞানী বা গবেষক। মার্ক কাউফম্যান ও রেবেকা সোলনিটের গবেষণা বলে, ব্রিটিশ পেট্রলিয়াম ২০০৪ সালে ব্যক্তিগত কার্বন ফুটপ্রিন্ট এবং তার পরিমাপের কথা প্রথম প্রচার করে। অগ্লিভি ও ম্যাথার নামক বিজ্ঞাপন সংস্থাকে তারা দায়িত্ব দেয়— সাধারণ মানুষের দায়ভার হিসেবে পরিবেশ দূষণকে প্রকাশ করার। এর ফলে তৈরি হয় অসংখ্য সবুজ বিকল্প, যার দাম সাধারণ ব্যবহৃত দ্রব্যের থেকে প্রায় ৫০% বেশি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশেষ রাজ্যে এই দামি পরিবেশবান্ধব দ্রব্যকেই একমাত্র ব্যবহারের নিয়ম করা হয়, যাতে বাড়তে পারে তাদের লাভের অঙ্ক। পাশও হয়ে যায় সেই নিয়ম।

এ অসাম্যের শিকড় জড়িয়ে আছে আরও গভীরে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জিনস প্রস্তুতকারক সংস্থার তৈরি ‘ওয়াশড’ জিনস তৈরিতে খরচ হয় ১৫০০ গ্যালন জল (তুলো উৎপাদন থেকে প্রস্তুত হওয়া অবধি)। প্রত্যেকটি জিনস তৈরি করতে শুধু প্রোডাকশন লাইনে ব্যবহৃত হয় ৭৬০০ লিটার পরিশুদ্ধ জল, যা রাজস্থানের একটি গ্রামের সারা মাসের পানীয় জলের প্রয়োজনের থেকেও বেশি। এই সবুজ ধনতন্ত্রের অসাম্যের সমীকরণে এসে গেল পৃথিবীর দু’টি অংশের দু’টি মুখ। অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে উন্নত দেশের সঙ্গে, সেই দেশে জন্ম নেওয়া বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে যোজন ফারাক তৈরি হয়ে গেল অনুন্নত দেশের, তার পিছিয়ে পড়া অংশের সাধারণ মানুষদের।

অথচ, পরবর্তী প্রজন্মকে আর একটু সবুজ পৃথিবী দিয়ে যাওয়ার আর্তি এখন আমাদের সকলের। পরিবেশের জন্য সত্যি হাত বাড়াতে হলে চিনতেই হবে মুখোশের তলায় থাকা সমীকরণ।

ধানসিঁড়িটির তীরে ফিরে আসতে চাই আমরা সবাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement