India Politics

রাষ্ট্রহীন, অ-নাগরিক

সংবিধানে লেখা ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ বহুবিধ। রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম থাকবে না, সব ধর্ম থেকেই সে সচেতন ভাবে সমদূরত্ব বজায় রাখবে।

Advertisement

হর্ষ মান্দার

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২৪ ০৯:৫৫
Share:

বিক্ষোভ: সিএএ - এনআরসি - এনপিআর এর প্রতিবাদে রাজপথে। কলকাতা, ২০২০

ভারতে কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন মাইলফলক হয়ে আছে— ১৯৫১-৫২’র প্রথম নির্বাচন বা জরুরি অবস্থা-অবসানের পর ১৯৭৭ সালের নির্বাচন যেমন। তবু বলতেই হয়, ২০২৪-এর জাতীয় নির্বাচন স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলেই স্থির হবে যে, ভবিষ্যৎ ভারত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র হিসাবে টিকে থাকবে কি না।

Advertisement

সংবিধানে লেখা ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ বহুবিধ। রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম থাকবে না, সব ধর্ম থেকেই সে সচেতন ভাবে সমদূরত্ব বজায় রাখবে। নাগরিকের— তিনি সংখ্যাগুরুর ধর্মে বিশ্বাসী হোন কি সংখ্যালঘুর— পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে নিজস্ব ধর্মাচরণ ও প্রচারেরও। সংবিধানে নিহিত নৈতিকতার বোধে হাত পড়লে রাষ্ট্রও নাগরিকের ধর্মাচরণে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। সংখ্যালঘু ধর্মবিশ্বাসের সব মানুষ পূর্ণ নাগরিকত্বের সুযোগ-সুবিধা পাবেন, যেমন পান সংখ্যাগুরু ধর্মবিশ্বাসীরা। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই সব অধিকার রক্ষা, রাষ্ট্র যাতে ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ না করে তা নিশ্চিত করা। ভারতীয় গণতন্ত্রের নির্মাণপর্বে এই ধর্মনিরপেক্ষতার অভ্যাস যে শত শতাংশ আচরিত হয়েছে তা বলা যাবে না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে গত এক দশকের যাত্রায় ভারত এমন সব আক্রমণের ঘটনা দেখেছে, অনেকে আশঙ্কা করছেন, ভারত এর মধ্যেই কার্যত এক ধর্মীয় রাষ্ট্র তথা হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

১৯৩৫-এর জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলার দুটো আইন ঘোষণা করেন— ইতিহাসে যা ‘নুরেমবার্গ আইন’ নামে পরিচিত। এই আইনবলে জার্মান ইহুদিদের নাগরিকত্বের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়; এবং ভিন্ন ধর্মে বিয়ে ও যৌনতা অপরাধ বলে ঘোষিত হয়। এই দুই আইনে জার্মানির ইহুদিরা হয়ে যান রাষ্ট্রহীন অ-নাগরিক, ইহুদি ও জার্মানের মধ্যে বিয়ে ও যৌনতা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হয়। মোদীর ভারতে এমন আইন পাশ হয়েছে যা মুসলমানদের সম-নাগরিকত্বের নীতি ও অধিকারকে আক্রমণ করছে, ভিন্ন ধর্মে বিয়েতে ধর্মান্তরণকে বেআইনি দাগিয়ে দিচ্ছে। এই আইনে কি ‘নুরেমবার্গ আইন’-এর প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে?

Advertisement

২০১৯-এর নাগরিকত্ব সংশোধন আইনে (সিএএ) সরাসরি ভারতীয় মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু একটা জিনিস এই প্রথম ঘটছে: ধর্মপরিচয়কে করে তোলা হচ্ছে ভারতের নাগরিক হয়ে ওঠার সুস্পষ্ট যোগ্যতা। সেই সঙ্গে নাগরিকত্বের পরিচয়বাহী কাগজহীন মুসলমানদেরকে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে অন্য ধর্মের সেই সব মানুষের থেকে, যাঁদের ভাবা হচ্ছে ভারতের পড়শি মুসলমান-অধ্যুষিত দেশগুলি থেকে চলে আসা, নিপীড়িত সংখ্যালঘু হিসেবে।

সিএএ-র সমর্থনে এই যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে, এ হল শরণার্থীদের প্রতি মানবিক একটা আইন, পড়শি দেশে অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের সাহায্য ও আশ্রয় দিতে যার উদ্ভব। কিন্তু অত্যাচার, নিপীড়ন এই শব্দগুলো এই আইনে বা তার নির্দেশিকায় কোথাও লেখা নেই। কেন এই সংশোধন পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ নামের শুধু তিনটি মুসলমান-অধ্যুষিত দেশ থেকে আসা কাগজপত্রহীন অমুসলমান মানুষের নাগরিকত্বের আবেদনকেই সবিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, এই আইনে তারও কোনও ব্যাখ্যা নেই। ধর্মীয় নিপীড়ন ভারতের প্রতিবেশী সব দেশেই এক রূঢ় বাস্তব, পাকিস্তানে তার শিকার হিন্দু, খ্রিস্টান ও আহমদিয়ারা; আফগানিস্তানে হিন্দু, শিখ ও হাজ়ারা-রা; চিনে উইগুর মুসলিম ও তিব্বতিরা; মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানরা; শ্রীলঙ্কায় তামিল ও মুসলমানরা; বাংলাদেশে হিন্দুরা। মানবিকতার খাতিরেই যদি এই আইন করতে হয়, তা হলে ভারত কেন পড়শি দেশের সেই সব মানুষ— যাঁরা কিনা পৃথিবীতে সবচেয়ে নিপীড়িত ও অত্যাচারিত মানুষের অন্যতম— মায়ানমারের রোহিঙ্গা, পাকিস্তানের আহমদিয়া আর চিনের উইগুরদের জন্য দরজা খুলে দিল না? শ্রীলঙ্কার তামিলরা বাদে ওঁদের বাকি সবাই ধর্মপরিচয়ে মুসলমান বলেই কি?

মানবিকতা নয়, এই আইনের পিছনে কাজ করেছে মতাদর্শ— এমন ধারণাকে অযৌক্তিক বলা যাবে না। ইজ়রায়েল ঠিক যেমন প্রতিটি ইহুদির ‘দেশ’, ২০১৯-এর সিএএ-র পশ্চাৎধারণাটি হল, ভারত হিন্দুদের ‘দেশ’, সেই হিন্দু বিশ্বের যে কোনও জায়গার হতে পারেন। কিন্তু এই ধারণাটি সংবিধানে নিহিত ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী; ভারত যে একই ও সমান ভাবে প্রতিটি অ-হিন্দু নাগরিকেরও দেশ, এই ধারণার পরিপন্থী।

রাষ্ট্রের একটা আইন এসে ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে যে নাগরিকত্ব তথা অধিকার হারানোর ভয় ঢুকিয়ে দিল, তা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে— প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় কথায়, প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে মুসলিমদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে দাগিয়ে দেওয়ায়। ‘ক্রোনোলজি’ বলছে— প্রথমে সিএএ, এর পর আসবে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি। অসমে এনআরসি-র বাস্তবায়ন লক্ষ লক্ষ নাগরিকের দুর্দশা ডেকে এনেছে, নাগরিককে পুরনো কাগজপত্র জোগাড় করে ও দেখিয়ে প্রমাণ করতে হচ্ছে যে, তিনি এ দেশের নাগরিক। ব্যর্থ হলে রাষ্ট্র ধরে নিচ্ছে সেই নাগরিক এক জন ‘অনুপ্রবেশকারী’, তাঁকে ঘোষণা করছে ‘নন-সিটিজ়েন’ হিসেবে, চোখের সামনে ঝুলছে ডিটেনশন সেন্টারে বন্দি হওয়ার খাঁড়া। কিন্তু আপনি যদি ‘কাগজ’ দেখাতে না-পারা হিন্দু হন, তা হলে চিন্তার কিছু নেই। কারণ, সিএএ মোতাবেক ধরে নেওয়া হবে আপনি বাংলাদেশে নিপীড়িত হিন্দু, আপনার ভারতীয় নাগরিকত্বের আবেদন ‘ফাস্ট-ট্র্যাক’ করা হবে। উল্টো দিকে, যিনি মুসলিম তিনি বঞ্চিত হবেন রাষ্ট্রের ‘আশ্রয়’ থেকে।

ভারতীয় মুসলমানদের জন্য সমান ভয়ের কারণ ‘লাভ জেহাদ’ সংক্রান্ত আইনগুলির বাড়বাড়ন্তও, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বকালে গত এক দশকে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে যে আইনের ব্যাপক প্রয়োগ ঘটেছে। আবারও বলতে হয়, নুরেমবার্গ আইনে যেমনটা হয়েছিল, এই আইনে মুসলিম পুরুষ ও হিন্দু নারীর সম্পর্ককে প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ করা হয়নি বা অপরাধ দাগিয়ে দেওয়া হয়নি। কিন্তু যে ভাবে এই আইনের ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, পুলিশের হাতে কিংবা কখনও কখনও আদালতেও তার প্রয়োগ হচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, এই আইনবলে আসলে এই কার্যসিদ্ধিই চাওয়া হয়েছে। যে যুগলেরা অন্য ধর্ম বা ‘নিচু’ জাতের মানুষকে বিয়ে করে বা এক সঙ্গে থাকতে চাইছেন, তাদের জন্য ভারত বহু দিনই এক বিপজ্জনক জায়গা। এই বিপদ বহুগুণ বেড়েছে সঙ্ঘ-পন্থী সংগঠন ও তার সমর্থকদের প্রচারিত ‘লাভ জেহাদ’-এর বিষাক্ত ষড়যন্ত্র তত্ত্বে; যে তত্ত্ব বলে যে, এই ‘ভালবাসা’র আসল লক্ষ্য হিন্দু মেয়েদের ধর্মান্তরণ ও সন্তানজন্ম সূত্রে মুসলমানদের বাড়বৃদ্ধি। ‘লাভ জেহাদ’ আইনে তাই ভিন্ন ধর্মে থাকা যুগল ও দম্পতিদের বিপদ ক্রমশ বাড়ছে।

বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই ধর্ম পাল্টে যাওয়া নয়— ধর্মান্তরণ সংক্রান্ত এমন যে আইনগুলি ছিল, ‘লাভ জেহাদ’ আইন আসলে তারই এক রূপান্তর। মোদীর আমলে সাতটি বিজেপি-শাসিত রাজ্যে এই আইন চালু করে বলা হয়েছে, ভিন ধর্মী দম্পতিদের সরকারি আধিকারিকের কাছে আবেদন করতে হবে, প্রচারমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিয়ের কথা বা বিয়ের ইচ্ছার কথা জানাতে হবে। এই সূত্রেই বাড়ছে কারাদণ্ডের ভয়, বিয়ে খারিজ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি, উপরন্তু রাজনৈতিক নজরদারদের হুমকি, ভীতি প্রদর্শন, হিংসার শিকার হওয়ার ভয়। বিয়ে না করে এক সঙ্গে থাকতে চাওয়া যুগলদের ক্ষেত্রে এই সব সমস্যা বেড়ে যায় বহুগুণ। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে এই আইনকে হাতিয়ার করে পুলিশ, আদালত, পরিবারের সদস্য ও সঙ্ঘ-ভাবাপন্ন নজরদারেরা ভিন ধর্মী যুগল ও দম্পতিদের বিয়ে বা একত্রবাস আটকাতে উঠেপড়ে লেগেছে। ব্যাহত হচ্ছে নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা, নিজের ধর্মের বাইরে সঙ্গী বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা।

নাৎসি জার্মানিতে ইহুদি, রোমা, সিন্টি ও কৃষ্ণাঙ্গ জার্মানদের নাগরিকত্ব-বঞ্চনা ছিল রাখঢাকহীন। ইহুদি ও জার্মানের বিয়ে ও যৌনতাকে অপরাধ বলে দাগিয়ে দিতে রাষ্ট্রের বাসনাও ছিল তীব্র। নরেন্দ্র মোদীর ভারতে এই বাসনা, এমনকি সমাজবয়ানও নাৎসি আমলের থেকে আলাদা নয়। তবে আইনের মাধ্যমে এবং রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ করে দেশের মুসলিম নাগরিকদের আলাদা করে রাখা, বা তাঁদের দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়াটি নাৎসি জার্মানির নুরেমবার্গ আইনের তুলনায় এখনও অনেকটা ঢাকাচাপা দেওয়া। তবু মুসলিমদের প্রতি ভারতরাষ্ট্রের যে বয়ান ও আচরণ দেখা যাচ্ছে, তাতে ভারতের আকাশে ১৯৩৫-এর নুরেমবার্গের কালো মেঘ অতি স্পষ্ট।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement