সম্ভাবনা: উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনী প্রচারে কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা। ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১। ফিরোজ়াবাদ। ছবি পিটিআই।
গত অক্টোবরে মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী— দুই মিলিয়ে সরকারের প্রধান পদে নরেন্দ্র মোদীর দু’দশক পূর্ণ হল। সেই উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে রাজনাথ সিংহ বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদী আসলে একটা ‘ভাবনা’ বা ‘দর্শন’। নিছক এক জন ব্যক্তি হিসাবে তাঁকে দেখা উচিত নয়।
বিনা কারণে কাউকে তোষামোদ করার লোক রাজনাথ সিংহ নন। এ-হেন পোড়খাওয়া রাজনাথ যখন নরেন্দ্র মোদীকে একটা ‘ভাবনা’ হিসাবে দেখতে বলেন, তখন চিন্তা করা উচিত যে, নরেন্দ্র মোদী নামক ভাবনার উপাদানগুলি কী কী?
নরেন্দ্র মোদী নিজে তাঁর ভাবমূর্তি যে ভাবে তুলে ধরতে চান, সেগুলিই দেখা যাক। এক, সবল নেতা; দুই, দুর্নীতিমুক্ত, পরিবারের পিছুটানহীন, ফকির, এক রকম সন্ন্যাসী; তিন, বিকাশপুরুষ; চার, হিন্দু হৃদয়সম্রাট। কেউ যদি নরেন্দ্র মোদীর অনুকরণ করতে চান, তাঁকে নিজের বায়োডেটায় এ সব কথা রাখতেই হবে। যোগী আদিত্যনাথ ঠিক সেটাই করছেন। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের প্রচারে তিনি নিজেকে কড়া প্রশাসক, বিকাশপুরুষ এবং হিন্দুত্বের প্রতীক হিসাবে তুলে ধরছেন। আর তিনি এমনিতেই গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী। পরিবারের পিছুটান নেই। করোনা সামলাতে ব্যস্ত বলে পিতার শেষকৃত্যেও যাননি। ফলে মোদীর মতো তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যক্তিগত দুর্নীতির অভিযোগ তোলা কঠিন।
বিজেপিতে নরেন্দ্র মোদীর এখনও কোনও চ্যালেঞ্জার নেই। উত্তরসূরিও নেই। যোগী চ্যালেঞ্জার না হয়ে মোদীকেই অনুকরণ করে তাঁর উত্তরসূরি হয়ে উঠতে চাইছেন, তা স্পষ্ট। পারবেন কি? উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন সে প্রশ্নের উত্তর দেবে।
এ বার কংগ্রেসের কথায় আসা যাক। উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস জিতবে, আর প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা মুখ্যমন্ত্রী হবেন, এমন স্বপ্ন কংগ্রেস সেবাদলের কর্মীরাও দেখেন না। কিন্তু প্রিয়ঙ্কাকে সামনে রেখে কংগ্রেস উত্তরপ্রদেশে এক নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেছে। এই প্রথম প্রিয়ঙ্কা কোনও রাজ্যের ভোটে কংগ্রেসের নেতৃত্বে। তাঁকে সামনে রেখে ‘লড়কি হুঁ লড় সকতি হুঁ’ প্রচারমন্ত্রে পাখির চোখ মহিলাদের ভোটব্যাঙ্ক। এই মডেল সফল হলে অন্যান্য রাজ্যেও এর অনুকরণ হবে। প্রিয়ঙ্কাকে মুখ করেই। সে ক্ষেত্রে কি কংগ্রেসের অন্দরে রাহুল গান্ধীর চ্যালেঞ্জার হয়ে উঠবেন প্রিয়ঙ্কা?
এত দিন হিন্দি বলয়ে জাতপাতের রাজনীতির দুই প্রধান চরিত্র ছিলেন মুলায়ম সিংহ যাদব ও মায়াবতী। জাতপাতের যোগবিয়োগে যে যখন সফল হয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসেছেন। অমিত শাহের আমলে বিজেপি পাটিগণিত বদলে দিয়েছে। বিজেপি হিন্দু উচ্চবর্ণ, ব্রাহ্মণের সঙ্গে ওবিসি, দলিত সবই জুড়ছে। বাকি নেই মুলায়মের যাদব সম্প্রদায় ও মায়াবতীর দলিত জাটভ সম্প্রদায়ও। জাতপাতের অঙ্কই শেষ হয়ে গেলে অখিলেশ ও মায়াবতীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী? উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন এই প্রশ্নের উত্তরও দেবে।
যাঁরা বলছেন, উত্তরপ্রদেশের বাইশের বিধানসভা নির্বাচন চব্বিশের লোকসভা ভোটের দিশা ঠিক করে দেবে, তাঁরা হয়তো ঠিকই বলছেন। যদিও ২০১২-র উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় তৃতীয় স্থানে আটকে যাওয়া বিজেপির ২০১৪-র লোকসভা ভোটে জিততে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু বাইশের ফল যে বিজেপি, কংগ্রেসের অন্দরের সমীকরণ ও সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজবাদী পার্টির ভবিষ্যৎ বাতলে দেবে, তাতে কোনও ভুল নেই।
গত অক্টোবরে অমিত শাহ লখনউতে প্রচারে গিয়ে বলেছিলেন, “মোদীজিকে চব্বিশে আরও এক বার প্রধানমন্ত্রী করতে হলে, বাইশে ফের যোগীজিকে মুখ্যমন্ত্রী করতে হবে।” অমিত শাহের এই মন্তব্যে মোদী বা যোগী, কারও খুশি হওয়ার কথা নয়। কারণ তাঁর ফের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অন্য কারও উপর নির্ভর করে, মোদী তা দেখাতে চাইবেন না। আর যোগীও চাইবেন না, তিনি জিতলেও মানুষ তাঁকে মোদীর নামে ভোট দিয়েছেন বলে বার্তা যাক। এক সময় অমিত শাহকেই অনেকে মোদীর উত্তরসূরি হিসাবে ভাবতেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ভোটে সেনাপতি হিসাবে ব্যর্থতা শাহের ‘বিজেপির চাণক্য’ উপাধিতে কিঞ্চিৎ কাদা লেপেছে। আরএসএস-এর আঁতুড় ঘরে রাজনৈতিক যোগীর জন্ম না হলেও সঙ্ঘ পরিবার তাঁকে কার্যত দত্তক নিয়ে ফেলেছে। দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হলে যোগী নয়া নাগরিকত্ব আইন, ৩৭০ রদের রূপকার শাহকে ছাপিয়ে যাবেন কি?
এই প্রশ্নের উত্তর মেলার আগেই বিজেপির শীর্ষনেতৃত্বে টানাপড়েন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। মেঘালয়ের রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক বলেছেন, অমিত শাহ তাঁর কাছে নরেন্দ্র মোদীর বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। সত্যপাল পরে ঢোক গিলেছেন। কিন্তু তিনি অসত্য বলেছিলেন, এমন কথা অমিত শাহ বা বিজেপির কেউই দাবি করেননি। কেন? উপরমহলে কি সব ঠিকঠাক নেই?
পাঁচ বছর আগে অমিত শাহ যখন উত্তরপ্রদেশ ভোটে বিজেপির জয়ের ঘুঁটি সাজাচ্ছেন, তখন প্রশান্ত কিশোর কংগ্রেসকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, রাহুল বা প্রিয়ঙ্কাকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে কংগ্রেস ভোটে যাক। গান্ধী পরিবার এত ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত নয়। রাহুল অখিলেশের সঙ্গে জোট করলেন। ‘ইউপি কে লড়কে’ বলে প্রচার শুরু হল। অখিলেশ সেই ভোটের পরে মুখ্যমন্ত্রীর গদি হারিয়েছিলেন। দু’বছর পরে লোকসভা ভোটে ধরাশায়ী রাহুল কংগ্রেসের সভাপতির পদই ছেড়ে দেন।
পাঁচ বছর পরে রাহুল, অখিলেশ দু’জনেই আবার রাজনৈতিক কেরিয়ারের নতুন মোড়ে দাঁড়িয়ে। উত্তরপ্রদেশ ভোটের পরেই কংগ্রেসের সাংগঠনিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু বকলমে তিনিই কংগ্রেসের সভাপতি হলেও, আনুষ্ঠানিক ভাবে রাহুল ফের কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনের লড়াইয়ে নামবেন, তা তাঁর পরম আস্থাভাজনরাও বাজি ধরে বলতে পারেন না। সেই পরিস্থিতিতে উত্তরপ্রদেশের ভোটে প্রিয়ঙ্কার মহিলা ভোট-ব্যাঙ্কের রণনীতি সামান্য সাফল্য পেলেই কংগ্রেস তাঁকে ইন্দিরা গান্ধী, সনিয়া গান্ধী, জয়ললিতা, মায়াবতী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মহিলা রাজনীতিবিদের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে বসাতে চাইবে। রাহুল ফের সভাপতি হতে গড়িমসি করলে প্রিয়ঙ্কাকে কংগ্রেস সভানেত্রী করার দাবিও উঠবে।
আর অখিলেশ? পিতা মুলায়মের মতোই তিনি যাদব তথা ওবিসি ভোটব্যাঙ্কের সঙ্গে মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক জুড়তে চাইছেন। সঙ্গে কৃষক বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে জাঠ ভোটব্যাঙ্ক। কিন্তু জাতপাতের এই অঙ্ক কাজে না লাগলে, সমাজবাদী পার্টির রাজনীতির মূল কৌশল নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। আর জিতলে তিনি বিরোধী শিবিরের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে উঠবেন। হয়তো চব্বিশে বিরোধী জোটের লাগামও তাঁর হাতে চলে আসবে।
এক সময় মায়াবতীও কংগ্রেস-বিরোধী জোটের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু দলিতদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ এবং মুসলিম ভোট জুড়ে ফেলা মায়াবতী গত পাঁচ বছরে কত বার নিজের বাংলোর বাইরে পা রেখেছেন, বলা মুশকিল। সিএএ বিরোধী আন্দোলন, করোনা মোকাবিলায় যোগী সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বা কৃষক আন্দোলন— কোথাও তাঁকে দেখা যায়নি। বিজেপি দলিত ভোটে আগেই ভাগ বসিয়েছিল। মায়াবতী নিজে যে জাটভ সম্প্রদায়ের কন্যা, এ বার সেই জাটভ ভোটও বিজেপি ঝোলায় পুরতে চাইছে। উল্টো দিকে ভীম আর্মির চন্দ্রশেখর আজ়াদ নিজেকে নতুন দলিত নেতা হিসাবে তুলে ধরতে মরিয়া। এ বারের উত্তরপ্রদেশের ভোটে জিতে মায়াবতী ফের মুখ্যমন্ত্রী হবেন, এমন আশা কেউই করছেন না। কিন্তু ৪০৩ আসনের বিধানসভায় বিএসপি গত বারের মতো উনিশটি বা তারও কম আসনে জিতলে মায়াবতী জাতীয় রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন।
যোগী, অখিলেশ, প্রিয়ঙ্কা, মায়াবতী—উত্তরপ্রদেশের ভোট অনেকের ভবিষ্যৎ স্থির করবে।