লতা মঙ্গেশকর। ফাইল চিত্র।
সলিল চৌধুরী তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী জীবন উজ্জীবন-এ বলেছিলেন, লতা মঙ্গেশকরকে বিশ্লেষণ করা যায় না! সলিল চৌধুরীর মতো এক জন সুরকার, যাঁর কাছে সুর ছিল বিজ্ঞান, গণিত, তিনি কিনা বললেন, লতা বিশ্লেষণের ঊর্ধ্বে! তা হলে বুঝতে হবে যে, লতার কণ্ঠে এমন কিছু একটা ছিল, যা সুর, তাল, লয় পেরিয়েও আরও কিছু— যা সচরাচর শিল্পীদের মধ্যে পাওয়া যায় না।
সুরকাররা আসলে সঙ্গীতের কাঠামো তৈরি করেন, আর লতা সেই সব কাঠামোয় প্রলেপ দেন মাটির, চক্ষুদান করেন! প্রথমেই মনে পড়ে মদন মোহনের কথা। মেরা সায়া ছবিতে ‘নৈনোঁ মে বদরা ছায়ে’ গানটি। ঠুংরি অঙ্গের গান। লতার কণ্ঠে ফুটে উঠল বেনারসি ঠাট! যেন তিন মিনিটের একটা গানে অনন্ত যুগের সঙ্গীতের বন্দিশ ঢুকে পড়ল। যেন কত কাল তিনি সন্ধ্যায় মেহফিল জমিয়েছেন ঠুংরি গেয়ে! আবার মদন মোহনেরই আর একটি গান ‘আপকি নজ়রোঁ নে সমঝা’— একটি প্রেমের গান, গজল-অঙ্গে গাওয়া। সেখানে সমস্ত বেনারসি চাল কণ্ঠ থেকে ছেঁটে ফেলছেন লতা! গানটি হয়ে উঠছে সাক্ষাৎ প্রেমের আয়না। এর পরেই আবার দস্তক ছবিতে ‘বৈয়াঁ না ধরো’— একটি ছোট খেয়াল, সেখানে উধাও হয়ে যাচ্ছে গজলের মুড়কিগুলো। এই যে ব্যাপ্তি, তা কি শুধুই আলাদা আলাদা সুর, ঘরানা বলে আপনিই বদলে যাচ্ছে? তা নয়! এ যে শিল্প! বাঁধা ফর্মুলায় কি আর একে কষা যাবে?
যা লতার প্রচণ্ড মেধার পরিচয় দেয়, তা ওঁর এই মননশীল পর্যবেক্ষণগুলো। তিনি যেন পড়ে ফেলতে পারতেন কম্পোজ়ারের মনের কথা! সুরকার তাঁর সুরের মধ্যে কী বলতে চাইছেন এবং বলে উঠতে পারছেন না, তাই যেন হয়ে উঠত লতার গবেষণার বিষয়, আর তাঁর মৌলিক শিল্পের ক্ষেত্র! না হলে লতার যে আশ্চর্য স্বরক্ষেপণ— তা অমন মায়া তৈরি করতে পারত কি?
এই সুবাদে শচীন দেব বর্মণের সুরের কথা কি না বলে পারি! কত গান যে মনে পড়ে ওঁর— কত সুর কত নদী...! ছবির নাম অভিমান। লতার কণ্ঠে ‘নদিয়া কিনারে’। কী টান দিলেন গানের শুরুতে! কে বলবে লতা গ্রামবাংলার মানুষ নন? যেন কত যুগ ধরেই তাঁর ঘরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মেঘনা-পদ্মা! যেন কত যুগ ধরে লতা শুনে আসছেন দরাজ কণ্ঠের মাঝিমাল্লার ভাটিয়ালি। ওই একটা টানেই লতা ওঁর শ্রোতাদের টেনে নিলেন, এবং নিজেকে মিশিয়ে দিলেন বাংলার শিরায়। এটা শচীনকর্তার সুর, কিন্তু সেটার স্বরক্ষেপণ, কণ্ঠকে ঠিক ঠিক মাত্রায় নিয়ে যাওয়া, মাঝিমাল্লার উদাসী কণ্ঠকে সুরের মধ্যে চিনে ফেলা— এ তো এক অসাধারণ ব্যাপার। এর মধ্যে লতা কিন্তু কোথাও তাঁর নিজস্বতাকে সুরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন না। যদি দিতেন তা হলে কণ্ঠশিল্পী আর সুরকারের মধ্যে সুর মিশ খেত না।
আসলে প্রত্যেক সুরকারেরই একটা নির্দিষ্ট থিম থাকে। তাঁরা হয়তো তাঁদের সুরের মূল অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তাঁদের আশৈশবের চেনা কোনও সুর থেকে! হয়তো তা ভাটিয়ালি, গজল, বা ঠুংরি। শিল্পী হিসাবে লতার কাজ ছিল সুরকারদের সেই মূল তানটিকে চিনে নেওয়া। তার পর তাঁদেরই সুরের ধাঁচে নিজের আশ্চর্য পর্যবেক্ষণে কাঠামোর উপর প্রলেপ দেওয়া মাটির, রঙের।
শুধু স্বরক্ষেপণই অবশ্য লতার পরশপাথর নয়। আরও আছে। যেমন, গাইড ছবির ‘আজ ফির জীনে কী তমন্না হ্যায়’। গানের গতি যেন অন্তরা থেকে স্থায়ীর দিকে। তাই গানটার মধ্যে একটা অদ্ভুত স্বতঃস্ফূর্ত ভাব আছে। কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই যেন— স্রেফ মুহূর্তের ডাকেই— ওয়াহিদার ঠোঁটে লতা গানটা গেয়ে ওঠেন। পুরো গানটার মধ্যেই তাই ছড়িয়ে পড়ে একটা বাঁধন ছেঁড়া নীল আকাশ আর হুহু করে বয়ে যাওয়া মুক্তির হাওয়া। এই গানটা গাইতে গেলে লতাকে কি ছবির চরিত্রের বেদনাকে বুঝতে হয়নি? নিশ্চয়ই হয়েছে। আর হয়েছে বলেই তাঁর জীবনের সমস্ত আনন্দকেই যেন ঢেলে দিয়েছেন লতা— গানটির মধ্যে। ওঁর কণ্ঠে বার বার চলে আসছে শুধু সুরেরই ম্যাজিক নয়, অর্কেস্ট্রেশন, দৃশ্য, এবং সমস্ত অ্যারেঞ্জমেন্ট মিলিয়ে একটা সম্পূর্ণ গান।
আবার প্রেম পূজারী ছবিতে শচীন দেব বর্মণেরই সুরে ‘রঙ্গিলা রে’ গানটির মধ্যে যেন প্রেম নাছোড়বান্দা। সে কী আকুতি লতার কণ্ঠে! কে বলবে ছবিতে ওয়াহিদা রহমান অভিনেত্রী, লতা মঙ্গেশকর নন? এমন জাদু তখনই বোধ হয় ঘটানো সম্ভব, যখন গায়িকা গানের প্রত্যেকটি কথাকে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারেন। তার পর যখন গান হয়ে ওঠে কথাগুলো, তখন আর তা সুরকার, গায়কের মধ্যে আলাদা থাকে না, হয়ে যায় এক এবং অবিচ্ছিন্ন।
খুব মনে পড়ে সলিল-লতা জুটির কথা। সলিল চৌধুরীর গান যেন ঠিক ঝর্নার ধারা। কত আশ্চর্য সব বিচিত্র সুর, মিউজ়িক অ্যারেঞ্জমেন্ট, কত বিভিন্ন রকমের অর্কেস্ট্রেশন। কী অপূর্ব সব গান তৈরি করেছেন সলিল-লতা। পরখ ছবির ‘ও সজনা’ গানটা ভাবুন! সুরের আয়োজনে সেতারের মিড়, কৃন্তন এমন ভাবে কণ্ঠে আনছেন লতা, যেন মনে হয় যে কণ্ঠ আলাদা নেই! সব মিলিয়ে একটা সুর! তুলনামূলক ভাবে কম শোনা অন্য একটি গানের কথা বলি— ‘ওয়ো এক নিগাহ ক্যায়া মিলীঁ’। ছবির নাম হাফ টিকিট। এই গানের সুরটা ঠিক একটা হলিউডি মিউজ়িক্যাল অপেরার মতো! ছবিতে কিশোরকুমারকে ভিলেন প্রাণ তাড়া করেছেন, এবং কিশোর এক নৃত্য অনুষ্ঠানের মধ্যে ঢুকে নটীকে গানের মাধ্যমে তাঁর দুর্দশার কথা বোঝাচ্ছেন এবং সাহায্য প্রার্থনা করছেন। কী পরিমাণ নাটক কণ্ঠে দরকার গানটি গাইতে গেলে, বুঝতেই পারছেন! কিশোর অমন নাটুকে গান আগেও গেয়েছেন— কিন্তু লতা? সম্ভবত পশ্চিমি ভাইব্রেটো ব্যবহার করে তিনি সে রকম গান আর কখনও গাননি।
ছোটী সী বাত ছবির ‘না জানে কিউঁ’ গানটিতে সে এক লম্বা সুরে ধরে রেখেছেন লতা, মনে হয় যেন ওই মিউজ়িক অ্যারেঞ্জমেন্টটিকে তিনি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন। আর, সে কী অসাধারণ মিউজ়িক অ্যারেঞ্জমেন্ট— ক্যাথেড্রাল কয়্যার গাইছে, তারই মধ্যে কর্ডসে, মিউজ়িক্যাল কাউন্টার পয়েন্টে, ফিলারে, অবলিগেটোতে লতা যেন মিশে যান। শুনে মনে হয় ঠিক যেন একটা মিউজ়িক্যাল শুনছি। বুঝতে অসুবিধে হয় না, এই গানটা গাইতে গেলে গায়িকাকে মিউজ়িক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট সম্বন্ধে অসম্ভব ওয়াকিবহাল হতে হবে! ঠিক কোন মাপে কোন ওজনে গানটা গাইলে ওই অনবদ্য অর্কেস্ট্রাকে ঠিকঠাক ফুটিয়ে তোলা যায়, তা লতা জানতেন।
অন্য দিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— সহজ সুরের জাদুকর। সেই ‘আষাঢ় শ্রাবণ, মানে না তো মন’! আহা-হা কী সরল, কী সুন্দর! ঠিক যেন বাংলার এক স্নিগ্ধ বর্ষার সন্ধ্যা। সেই লতা, যিনি মদন মোহনের ‘বৈয়াঁ না ধরো’ গেয়েছিলেন, তিনিই যেন এখন এই নিরাভরণ সুরটির মারফত তৈরি করে দিলেন মায়া! কত যুগ ধরে কত প্রেমিক যে সে মায়ায় ডুবে থেকেছে, থাকবেও!
আবার ‘বলে বলুক লোকে, কলঙ্ক আমার ভাল লাগে’ গানটির কথা মনে করুন। গানটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে লেগে থাকে বাংলার পৌষালি সন্ধ্যার কীর্তনের সুর। গানটির অন্তরাতে একটি কীর্তনী আলাপ গান লতা— মনে হয়, যেন কত কাল ধরে কত কীর্তনের আসরেই না গেয়ে আসছেন, আমার রাধারানি লতা। সেই আলাপটাই যেন টান দিল বাংলার নাড়িতে। এই বাংলাই সমস্ত ভারতে ছড়িয়ে পড়ে ‘ও নদী রে’ থেকে ‘ও বেকরার দিল’-এ। হলফ করে বলা যায়, এমন করে এই সুরকে আর কেউ পারতেন না কণ্ঠে ধারণ করতে। এই বাংলাকে লতা কী ভাবে এমন আপন করে নিতে পারলেন? উপলব্ধি করলেন এমন করে? সে তো শুধুই সুরের মাধ্যমে নয়, অসামান্য মননশীলতার মাধ্যমেও তো!
রাহুল দেব বর্মণের সুরে প্রথম লতা তাঁর আধুনিকতম সাজে এলেন। আঁধি ছবির ‘তেরে বিনা জ়িন্দগী’ গানটিতে সুরের সঙ্গে ছন্দকে যে ধরে রাখতে পেরেছেন লতা, এর জন্য তাঁকে কুর্নিশ করতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, এই যে সুরের নতুন রকমের একটা চলন, এটা তো আগের আর কোনও সুরকার লতার জন্য তৈরি করে দেননি। অর্থাৎ, রাহুলের গান গাইতে গিয়ে লতাকে রপ্ত করতে হয়েছে সুরের সেই নতুন ধারাটিকে! এই ছবিরই ‘ইস মোড় সে’ গানটিতে তবলায় যেখানে সম্ পড়ে, তখন একটা সুফি ঢং উদাস করে দেয়। লতা ফ্রেসিং করেন পঞ্চমেরই মতো। গানের তলায় গ্রুপ ভায়োলিনের অবলিগেটো আর রিদম কানে নিয়ে যেন গেয়ে ওঠেন লতা।
আবার ‘আমার মালতীলতা’ গানটিতে সেই লতা প্রকাশিত হচ্ছেন, যিনি সহজেই ছন্দে গা ভাসাতে পারেন। ধ্রুপদী গায়কি তো পঞ্চমেরও ছিল, কিন্তু তা মদন মোহনের চেয়ে একেবারে আলাদা। কী ভাবে আলাদা করতে পারতেন এমন করে লতা? এইখানেই দরকার মননের, মেধার। ‘রৈনা বীতী জায়ে’-র মধ্যে মুক্তোর মতো দানা দানা কাজ লেগে থাকে! আর তবলা বাজতে পারে আড়ে আড়ে। কী কঠিন গান! আমি এক বার পঞ্চমদার সঙ্গে একটি ছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী ভাবে এমন একটা গান তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি? উত্তরে বলেছিলেন, সে কৃতিত্ব নাকি লতারই! আমিও পরে গানটি পঞ্চমদার কণ্ঠে শুনেছি— কিন্তু লতার ভার্শনটির থেকে সে যে একেবারেই আলাদা।
এত সুরকারের সঙ্গে কাজ করেও লতার নিজস্বতা যেন একটুও হারায় না। ঠিক যেন জলের মতো— যে পাত্রেই রাখি, তৃষ্ণার সময় তা মানুষের মনে ঢেলে দিতে পারে শান্তি। তবে লতা যেন পাত্রের থেকে উপচেও পড়েছেন। সেই উপচানোটা তাঁর নিজস্ব স্টাইল— যিনি জানতেন কোন গানে গমক লাগবে, কোন গানে লাগবে ছুট তান, মুড়কি।