Stan Swami

নীরব দর্শক ছিলেন না তিনি

নিজের কর্মজীবনের প্রায় গোটা পর্ব জুড়ে জনজাতিদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন এই পাদরি।

Advertisement

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২২ ০৫:০৪
Share:

জনজাতিভুক্ত মহিলা দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি পদে এনডিএ প্রার্থী হওয়ায় কি খুশি হতেন স্ট্যান স্বামী? তিনি কি মনে করতেন, যে প্রান্তিক মানুষজনের অধিকারের লড়াই লড়তে গিয়ে গোটা জীবনটাই চলে গিয়েছে, তাঁদেরই এক প্রতিনিধির দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে বসার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হওয়াটা এই লড়াইয়ের বড় অগ্রগতি? জানা নেই। যেমন জানা নেই, যে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হয়ে রাষ্ট্রপতি পদে দাঁড়িয়েছেন দ্রৌপদী, সেই শাসককুলের জমানায় জেলেই মৃত্যুবরণ করা পাদরি এই প্রতিনিধিত্বকে চমৎকার প্রহসন বলে মনে করতেন কি না।

Advertisement

জেসুইট ফাদার স্ট্যানিস্লাস লার্ডুস্বামী চলে গিয়েছেন এক বছর আগে। যে ভারতে তিনি জন্ম নেন, তা ছিল পরাধীন, ব্রিটিশ শাসকের অধীনে। আর যে স্বাধীন ভারতের কয়েদখানায় থাকাকালীন তিনি চিরতরে চলে গেলেন, সেই দেশটাও যে কার্যত পরাধীন থাকবে, তা সম্ভবত তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। তফাতের মধ্যে, ব্রিটিশ শাসকদের বদলে এসেছেন দেশীয় শাসকেরা। এসেছেন অবশ্য গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনেই! ফাদারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ভীমা-কোরেগাঁও মামলায়। যে মামলায় এখনও জেলখানায় পচছেন আরও কয়েক জন মানবাধিকার ও সমাজকর্মী, আইনজীবী, কবি, অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ। তাঁদের মধ্যে অবশ্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে এই মুহূর্তে জামিনে মুক্ত রয়েছেন কবি ও মানবাধিকার কর্মী ভারাভারা রাও। জামিনে মুক্ত আছেন সুধা ভরদ্বাজও।

নিজের কর্মজীবনের প্রায় গোটা পর্ব জুড়ে জনজাতিদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন এই পাদরি। শেষের দিকের বেশ কয়েকটি দশক কাটিয়েছেন‌ ঝাড়খণ্ডে। অজস্র জনজাতি গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন। জল-জঙ্গল-জমির লড়াইয়ে জনজাতিদের ভূমিকা কী হবে, তাঁদের অধিকার কতটা, সে সম্পর্কে তাঁদের সচেতন করার কাজ করে গিয়েছেন গোটা জীবন ধরে। জনজাতিদের অধিকার রক্ষায় প্রায় সত্তরটি বই লিখেছেন।

Advertisement

এই অধিকার রক্ষার লড়াই লড়তে গিয়ে যে অসংখ্য যুবক রাজরোষে পড়ে বিভিন্ন জেলে পচছেন, তাঁদেরও আইনি সহায়তা দেওয়ার লড়াই চালাতে হত স্ট্যানকে। সংগঠনের কাজে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরতেন ট্রেনের সাধারণ শ্রেণিতে, জীবনযাপন করতেন একেবারে অনাড়ম্বর ভাবে। পারকিনসন্স রোগে ভুগতেন, স্ট্র ও সিপার ছাড়া খেতে পারতেন না, চশমা ছাড়া বস্তুত কিছুই দেখতে পেতেন না অশীতিপর এই পাদরি। কানে শোনার ক্ষেত্রেও তীব্র সমস্যা ছিল তাঁর। ভারসাম্য হারিয়ে বেশ কয়েক বার পড়েও গিয়েছিলেন তিনি। সেই স্ট্যান স্বামীকে এনআইএ গ্রেফতার করে তাঁর রাঁচীর বাড়ি থেকে।

২০১৮-র ১ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের ভীমা-কোরেগাঁওয়ে দলিত ও উচ্চবর্ণের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এক দলিত যুবকের মৃত্যু হয়। দলিতদের উপর হামলার জন্য হিন্দুত্ববাদী দুই নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে পুলিশ। এই মামলাতেই একে একে গ্রেফতার করা হয় সুধীর ধাওয়ালে, সোমা সেন, সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলখা, অরুণ ফেরেরা, রোনা উইলসন, আনন্দ তেলতুম্বডে, ভারাভারা রাও, হানি বাবু, ভার্নন গঞ্জালভেস, সুরেন্দ্র গ্যাডলিংয়ের মতো ব্যক্তিত্বকে। ‘আরবান নকশাল’ তকমা দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে সিপিআই (মাওবাদী)-র সঙ্গে যোগাযোগ, ভীমা-কোরেগাঁওয়ে হিংসা ছড়ানো ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার চক্রান্তের অভিযোগ আনা হয়। আনা হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ। জুড়ে দেওয়া হয় ইউএপিএ-র মতো ভয়ঙ্কর আইনে আনা মামলা, যাতে ধৃতেরা চটজলদি জামিন না পেতে পারেন।

এই ব্যাপক ধরপাকড়ের পরেই দেশ জুড়ে তীব্র আলোড়ন ওঠে। আন্তর্জাতিক স্তরেও এই নির্বিচার দমন-পীড়নের নিন্দা করা হয়। অভিযোগ ওঠে, ধৃতদের ল্যাপটপে বেশ কিছু ‘অত্যন্ত সংবেদনশীল নথি’ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফাদার স্ট্যান স্বামী কস্মিন্ কালে পুণে না গেলেও তাঁকে জড়িয়ে দেওয়া হয় ভীমা-কোরেগাঁও মামলায়।

জেল হেফাজতে স্ট্যান স্বামী যখন গুরুতর অসুস্থ, যখন তাঁর প্রাণসংশয়, সে সময়েও তাঁর জামিনের আর্জি নিয়ে বার বার নানা টালবাহানা চলেছে। তাঁর মৃত্যুর মাত্র মাস দুয়েক আগে ভিডিয়ো কনফারেন্সে নবি মুম্বইয়ের তালোজা জেল থেকে বম্বে হাই কোর্টের বিচারপতিকে হাতজোড় করে কাঁপতে কাঁপতে স্ট্যান বলেছিলেন, জেলে তাঁর শরীর খুব তাড়াতাড়ি খারাপ হচ্ছে। তাঁকে অন্তর্বর্তী জামিন না দেওয়া হলে শীঘ্রই মৃত্যু হবে তাঁর। কিন্তু তিনি তা পাননি। মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ আগেও নতুন করে জামিনের আর্জি জানিয়েছিলেন ফাদার। কিন্তু যে দিন ওই আবেদনের শুনানি হবে, তার আগের সন্ধ্যায় প্রায় অচেতন ও গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে এক বেসরকারি হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়।

জামিনের আবেদনের শুনানি শুরু হতেই ফাদারের আইনজীবী কার্যত নাটকীয় ভাবেই আদালতে বলেছিলেন, আর কোনও শুনানির প্রয়োজন নেই। তাঁর মক্কেলের জামিনেরও আর প্রয়োজন পড়বে না। ওই দিনই দুপুরে মৃত্যু হয়েছে স্ট্যান স্বামীর।

তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পরিচিতদের হাতে যে প্যাকেট তুলে দেওয়া হয়েছিল, তাতে ছিল একটি ভোটার কার্ড, তার একটি স্ক্যান করা কপি এবং মাত্র কয়েকশো টাকা। হ্যাঁ, ওটাই ছিল স্ট্যান স্বামীর ‘সম্পত্তি’! পার্থিব নানা চাহিদাকে হেলায় নস্যাৎ করে মানবাধিকার রক্ষায় কালাতিপাত করতেন যে মানুষটি, দয়া ভিক্ষা নয়, যে মানুষটি শেখাতেন অধিকার রক্ষার লড়াই, সেই মানুষটি নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক। দেশদ্রোহী! তাঁর মতো মানুষজনের কণ্ঠ যত রুদ্ধ হবে, আগ্রাসী রাষ্ট্রের পক্ষে তা ততই স্বস্তিদায়ক।

স্ট্যান এক বার বলেছিলেন, “আমি খুশি, কারণ আমি নীরব দর্শক নই। এ জন্য যে কোনও মূল্য দিতে রাজি আছি।” তাঁকে অবশ্য কড়ায়-গন্ডায় সেই ‘মূল্য’ চুকিয়ে দিতে হয়েছে। মুশকিলটা হল, স্ট্যানিস্লাস লার্ডুস্বামীর মতো মানুষ মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকতে পারেন।

জীবিত স্ট্যান স্বামীর থেকে মৃত স্ট্যান স্বামী কিন্তু কম ভয়ঙ্কর নন!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement