Values & Lifestyle

বৈভবের ঘরে অভাবে আত্মহত্যা সপরিবার, একের পর এক, নেপথ্যে এক অসভ্যতার ইতিহাস

ভোগের জন্য বেপরোয়া খোঁজাখুঁজি। তার থেকে অবসাদ। অবসাদে ক্লান্ত হওয়া। ক্লান্তি কাটাতে মাউসে ক্লিক বা স্মার্ট ফোনের উপর আঙুলের অবিরাম চলাফেরা। তারই অনুষঙ্গ হিসাবে এক দফা ক্লান্তি থেকে আর এক দফায় যাওয়া।

Advertisement
প্রশান্ত রায়

প্রশান্ত রায়

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:০০
Share:
Family suicide due to acute economic problem in the luxurious housing estates are exposing the crisis of social values

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বৈভবের সন্ধানে যাত্রা করে অভাবে পৌঁছনোর কাহিনি সংবাদমাধ্যমে আমরা জেনেই থাকি। আমাদের চারপাশের মানুষজনের হাবভাব ও খরচ করার ধরন থেকে সহজেই অনুমান করতে পারি যে, তাঁরা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দুর্যোগের সীমানার কাছেই আসেন। এমনকি, একটু সাহস করে নিজেদের জীবনের কামনা-বাসনার সূক্ষ্ম বিচার করলে বুঝতে পারব, নিজেদের নিয়ন্ত্রণ না করলে আমরাও ‘ট্র্যাজেডি’র মুখোমুখি হতে পারি। তাই সংবাদমাধ্যমের খবরে বিস্মিত হই না। খবর হয়ে যাওয়া মানুষগুলির নাম-ধাম-পরিস্থিতি ছাড়িয়ে আমরা এক ধরনের চরিত্র, এক ধরনের সাময়িকতা, এক ধরনের ভবিতব্য বুঝতে পারি।

Advertisement

সম্প্রতি প্রায় একই সময়ে কলকাতার গড়িয়া এবং আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে দুই পরিবার নিজেদের শেষ করেছে। তার পরে গত বুধবার, ৩ জানুয়ারি গড়িয়া স্টেশনের অদূরে দামি ফ্ল্যাট থেকে বাবা, মা এবং ছেলের দেহ উদ্ধার হয়। বাবা স্বপন মৈত্র ইঞ্জিনিয়ার। মা অপর্ণা মৈত্র গৃহবধূ। ছেলে সুমনরাজ মৈত্র। প্রতিবেশীদের দাবি, বড়লোকি চাল ছিল সুমনের। তবে কাজ কী করতেন, কেউ জানেন না। ওই ফ্ল্যাট থেকেই হঠাৎ এক দিন দুর্গন্ধ পেয়ে পুলিশে খবর দেন পড়শিরা। পুলিশ এসে দেখে ফ্ল্যাটের তিনটি আলাদা জায়গায় ঝুলছে তিন জনের দেহ। ৭৯ বছরের স্বপন, ৬৮ বছরের অপর্ণা এবং ৩৯ বছরের সুমনরাজের দেহে তত দিনে পচন ধরেছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, বিলাসের জীবনের সঙ্গে তাল রাখতে না পেরেই অভাবের পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন মৈত্ররা। তবে তিন জনই একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছেন, না কি এক জন অন্যদের খুন করে আত্মঘাতী হয়েছেন, তা স্পষ্ট হয়নি এখনও।

একই রকম ভাবে গত ২৮ ডিসেম্বর আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে অভিজাত এলাকার এক বিলাসবহুল বাংলো থেকে উদ্ধার হয়েছিল ভারতীয় দম্পতি এবং তাঁদের তরুণী কন্যার দেহ। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছিল, আর্থিক সঙ্কটের কারণে স্ত্রী টিনা এবং কন্যা আরিয়ানাকে গুলি করে খুন করে আত্মঘাতী হয়েছিলেন রাকেশ কমল। মুখ থুবড়ে পড়েছিল ব্যবসা। এক বছর আগে লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন নিজেদের ১১ কামরার বাংলো। এমন ঘটনা দেশের নানা প্রান্তে পর পর ঘটেই চলেছে।

Advertisement

‘পরশ পাথর’ ছবির পোস্টার।

বিকৃত আপ্তবাক্য— ঋণ‌ং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, আমাদের সুপ্ত লোভকে ভয়ডরহীন করে দেয়। উচিতবোধকে অবজ্ঞা করতে শুরু করি আমরা। এই বৈভবের লোভ কিন্তু ব্যক্তির সহজাত নয়। ছোট বয়স থেকেই সমাজে উপরে ওঠার কথা শোনানো হয়। উচ্চাশা নিন্দার নয়, এ কথা শেখানো হয়। ঝুঁকি নিতে উৎসাহ দেওয়া হয়। স্বার্থপরতা স্বাভাবিক, এই বলে আশ্বস্ত করা হয়। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু— এ কথা শোনা যায় না। ফুটপাথে ছড়ানো ছবির রাশি থেকে যমপট উধাও। পুঁজিবাদী ভোগবিলাস চাওয়া-পাওয়ার আয়ত্তে চলে এসেছে। ইহসুখবাদ এখন চালু। অথচ এর নানা বিপদ আমাদের অজানা নয়। হঠাৎ বিনা পরিশ্রমে পাওয়া বিত্ত কী করে পারিবারিক সম্পর্কে বিপর্যয় ডেকে আনে, তা আমরা ‘পরশপাথর’ পাওয়া পরেশবাবুর কাহিনি (পরশুরামের লেখা) পড়ে ও দেখে (সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা) জানি। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘সহৃদয়া’ নামে ছোট উপন্যাসে দুঃখ-দেওয়া লোভের করুণ কাহিনিও জানা। দ্রাক্ষাফলে আকৃষ্ট শিয়ালের গল্পও পড়েছি। সেই ছবি— শিয়াল ঝুলন্ত আঙুরের থোকার দিকে লোভের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তা-ও দেখেছি। কিন্তু সেই প্রাণীটি, ‘আঙুর ফল টক’ এই মন্তব্য করে নিঃশব্দে স্থানত্যাগ করেছে। আরও ছোট বয়সে শুনেছি ও পড়েছি ‘আলিবাবা’। সেখানে কাসেমের বৌ সাকিনা পারেনি। তবে আলিবাবার বৌ ফতিমা এবং পরেশবাবুর বৌ গিরিবালা, ‘সহৃদয়া’র মুখ্য নারীচরিত্র— সবাই নিজেকে লোভমুক্ত করতে পেরেছে। পারছে না আজকের মানুষ, যারা পুঁজিবাদী ইহসুখবাদে মজে আছে। কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই।

ছবি: সংগৃহীত।

বস্তুত, দীক্ষাটাই পাল্টে দেওয়া হয়েছে। বড় বড় বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপনে লেখা হচ্ছে ‘লোভে পুণ্য’। নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতি ও তার নানা অপরিহার্য দিক শ্রেণিনির্বিশেষে এক ধরনের একঘেয়েমির জন্ম দিয়েছে। ‘আমার কাছে দৈনন্দিন জীবনের চাপ ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে,’— সব বয়সের মানুষ সহজেই এ কথা জানিয়ে দিচ্ছে। এই ক্লান্তিই নিত্যনতুন বাসনার বীজতলা। ক্লান্তির বোধ তৈরির এই কারখানা ক্লান্তির নতুন নতুন চিহ্ন আমাদের জোগান দিচ্ছে। ইলেকট্রনিক বিজ্ঞাপনের সুন্দরী স্বল্পবসনা কন্যা, তাদের চকচকে দাঁত, মখমলের মতো নরম ঝকমকে ত্বক, মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল— সব সময় ‘আয়-আয়’ বলে ডাকছে। ব্র্যান্ড কালচারের চমৎকার চিহ্ন ‘করো জ়াদা কা ইরাদা’।

বাজার প্রতি ক্ষণে ব্র্যান্ড পাল্টাচ্ছে। আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি তাদের। কিনি বা না-কিনি, চোখে দেখি তো! দোকান সাজাতে, চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেওয়ার জন্য কাচ ও আয়নার ব্যবহার দেখার মতো। আর তেমনই, আলো। সব প্রশ্নবোধক ভাবনা খুন হয়ে গিয়েছে। আমাদের চোখ আর খুলছে না। সুরাসিক্ত পুরুষের মতো। আমরা বুঝেও বুঝছি না যে, বাজারই আমাদের অচেতন করে দিচ্ছে। টিভি খুললেই বিজ্ঞাপন না-দেখে উপায় নেই। নতুন বলে যা-ই দেখাচ্ছে, পর মুহূর্তেই তা ক্লান্তিকর হয়ে যাচ্ছে। আমার শরীর-মন-পরমাত্মার খিদে মেটানোর জন্য বিজ্ঞাপনের মেধাবী রূপকার মোটা টাকার চাকরি করছেন। তাঁরা লোক ঠকানোর জাদুকর। কত বলিয়ে-কইয়ে চটকদার স্ত্রী-পুরুষ খাদ্যের রেসিপি আর রান্নার পদ্ধতি সর্ব ক্ষণ দেখাচ্ছেন। রেঁধে, সাজিয়েগুছিয়ে (কিন্তু আদৌ না ঘেমে) আমাদের রসনাকে ‘কে খাবি আয় বলে’ ডাকছেন। তার আকর্ষণে আমরা খাবি খাচ্ছি। ভ্রমণের চ্যানেলে নীল জল ও নীল পরীদের ছড়াছড়ি। ‘সিডাকশন’ প্রতিনিয়ত রোমাঞ্চকর।

ছবি: সংগৃহীত।

লোভ শুধু অর্থের নয়। যৌনতা এবং ক্ষমতাও তো চাই। তবে তা কিনতে হয়! কিনতে হলে অর্থ চাই। কুপথে অর্থ সহজেই আসে, যা আমরা এই বাংলায় চোখের সামনে দেখলাম। কিন্তু তার পরের জীবন? ভোগের জন্য বেপরোয়া খোঁজাখুঁজি। তার থেকে অবসাদ। অবসাদে ক্লান্ত হওয়া। ক্লান্তি কাটাতে মাউসে ক্লিক বা স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে আঙুলের অবিরাম চলাফেরা। তারই অনুষঙ্গ হিসাবে এক দফা ক্লান্তি থেকে আর এক দফায় যাওয়া। এক ঈর্ষা থেকে অন্য ঈর্ষায় যাওয়া… এ যেন থামতেই চাইছে না!

কিন্তু বুঝতে পারি না। পারলেও, ভোগ-ইচ্ছার রোলার কোস্টারে সেই সময় কোথায়! বুঝতে পারি না, ধনহরণ করার ইচ্ছায় বাজারি ধূর্তেরা এই ভাবে মোহিত লোকেদের প্রতারণা করে। মগজধোলাই করে নতুন দীক্ষা দেয়: যত দিন বাঁচবে, সুখে বাঁচবে; মৃত্যুর অগোচরে কিছুই নেই। ছাই হয়ে যাওয়া প্রাণহীন দেহ কোথায় (বা কোথা থেকে) আবার ফিরে আসে? দান, আহুতি, আচার, দেবতা, ঋষি বলে কিছু নেই। মন্ত্রমুগ্ধে আমরা দীক্ষিত হয়েছি। বাজারের মুনাফাবাজদের চাতুরির সঙ্গে যোগ দিয়েছে দক্ষিণপন্থী স্বঘোষিত জনবাদী রাজনীতি। সর্বদাই নতুন উত্তেজনার সন্ধানে আমরা। জানতে পারলাম রাকেশ-টিনা-আরিয়ানা, স্বপন-অপর্ণা-সুমনরাজের কথা। তার পর পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। নৈতিক বিপর্যয়ের আতঙ্ক নিয়ে ভাবার সময় কই! এতই নিরেট হয়ে গিয়েছি। হবই তো! কারণ, ষড়রিপুর চাপ বড্ড বেশি!

ছবি: সংগৃহীত।

এটাই অসভ্যতার ইতিহাস। সুস্থ চিন্তার বিনাশের ইতিহাস। আত্ম বিশ্লেষণের ধার ধারি না। ইহসুখের প্রভাবে খুশি হয়ে ভাবছি: ‘‘আমি বাদশা বনেছি/ তুই বেগম হয়েছিস। বাদশা বেগম ঝমঝমাঝম বাজিয়ে চলেছি।’’ পরহিতার্থে নিজের সম্পদের এক কণাও কখনও খরচ করিনি। আলিবাবা তো তবু বুঝতে পেরেছিল, সম্পদে বিপদ আছে। বুঝেছিল: ‘‘যেত্তা রুপেয়া তেত্তা দিকদারি/ লাহোল বিলা ইয়ে ক্যায়া ঝকমারি। হাজার যে উঠ যায়ে লাখো মে/ লাখো ভি পঁহছে কড়োর মে/ রুপেয়া বড় যায়ে, দিল ছোটি হো যায়ে, ক্যায়সে চলেগা মেরা দিনদারি।’’

হত্যালীলার আগে রাকেশ ও স্বপনেরা কি বলতে পেরেছিলেন, ‘‘বাসনা যখন বিপুল ধুলায়/ অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়/ ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র,/ রুদ্র আলোকে এসো।’’

এক জন কেবল ফেসবুকে বলতে পেরেছিলেন অসীম অবসাদের কথা। বিচারবুদ্ধি শূন্য হয়ে ভুলে গেলেন নিজেকে প্রশ্ন করতে যে, স্ত্রী-সন্তানকে মেরে ফেলার অধিকার তাঁর আছে কি? কত কথা তাঁদের না-বলা থেকে গেল! আসলে সবাই এক নির্দয় সমাজের হতবাক শিকার। কিছু মুনাফাবাজ ও ক্ষমতালোভী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সমাজে অপরাধপ্রবণতার সৃষ্টি করে। আর কিছু নির্বোধ তার জালে ধরা পড়ে। নিজের লোভই লোভীকে নষ্ট করে। ভয়ানক আকর্ষণের ঊর্ধ্বগতিচক্র থেকে মুক্তি কি আসবে? কারা আনবে? দলপতিমুক্ত সাধারণ মানুষ? না কি গবেষণাগারে বংশাণুর আমূল সংশোধন? কে জানে!

(লেখক সমাজতত্ত্বের এমেরিটাস অধ্যাপক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়মতামত নিজস্ব।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement