ছিদ্রময়, না কি অভেদ্য বর্ম
EVM

নতুন ভোট-ব্যবস্থাকে যেতেই হবে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে

নতুন ভোট-ব্যবস্থাকে যেতেই হবে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে

Advertisement

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২১ ০৪:৫২
Share:

পশ্চিমবঙ্গের উপনির্বাচনের রেশ কাটতে না কাটতেই বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র অর্থাৎ ইভিএম নিয়ে পুরনো জীর্ণ সংশয় আর ক্লান্তিময় বিতর্ক হাজির। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার প্রায় সব প্রধান রাজনৈতিক দলই বোধ হয় কখনও না কখনও নিশানা করেছে মূক ভোটযন্ত্রকে। ক্ষেত্রবিশেষে ইভিএম-কে আঁকড়ে পরাজিতরা রাজনৈতিক মুখরক্ষার সুযোগ খুঁজেছে, এমন অভিযোগও উঠেছে। ইতিমধ্যে ইভিএম রূপ বদলেছে খানিকটা। তাতে ভিভিপ্যাট যোগ হয়েছে। ইভিএম-এ ভোটের যান্ত্রিক হিসাবের সঙ্গে ভিভিপ্যাট স্লিপ গুনে পাওয়া হিসাব মিলিয়ে দূর করা যায় সংশয়। কিন্তু সব ইভিএম-এর প্রাপ্ত ভোট যদি ভিভিপ্যাট গুনে মেলাতে হয়, তবে আর বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রের কী প্রয়োজন? ঠিক কত শতাংশ ইভিএম-এর ভিভিপ্যাট মেলালে ভোটযন্ত্রের সত্য সম্পর্কে কতটা নিশ্চিন্ত হওয়া সম্ভব, তার রাশিবিজ্ঞান-সম্মত হিসাবও কষা যায় সহজে।

Advertisement

এটা ঠিক, ভোটযন্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রয়োজন গণতন্ত্রের স্বার্থেই। কিন্তু তার চাইতে এতটুকু কম দরকারি নয় যন্ত্রের উপরে জনগণের আস্থা, বিশ্বাস। ভোটপ্রক্রিয়া নিয়ে নাগরিক-সংশয় গণতন্ত্রে অভিপ্রেত নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো আর ইভিএম যন্ত্রগুলোর পেট কেটে তার অ্যানাটমি বোঝার সুযোগ পাবেন না। তাঁদের নির্ভর করতে হবে বিশেষজ্ঞদের মতামতের উপরেই।

নির্বাচন কমিশন অবশ্য বার বার বলে এসেছে, যে যন্ত্রগুলি নিখুঁত, তাদের সততায় প্রশ্ন তোলার কোনও কারণ নেই। কিন্তু কিছু আমলা কিংবা প্রযুক্তিবিদ বিজ্ঞানী-অধ্যাপকের মতামতের চেয়ে জনগণের কাছে বোধ হয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাদের রাজনৈতিক নেতাদের মতামত। জনগণ অনেক বেশি প্রভাবিত হন নেতাদের কথাতেই। এটাই গণতন্ত্রের বাস্তবতা। আর বিভিন্ন সময়ে যাঁরা আঙুল তুলেছেন এই বোবা ভোটযন্ত্রের সততা আর বিশ্বাসযোগ্যতায়, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা, এমনকি আছেন দস্তুর মতো আইআইটি থেকে পাশ করা প্রযুক্তিবিদ মুখ্যমন্ত্রীও।

Advertisement

তবু ইভিএম থেকে পিছনে ফিরে আবার কাগজের ব্যালটে একশো কোটি ভোটারের ভোটপ্রক্রিয়া সংঘটিত হওয়ার খুব একটা সম্ভাবনাও দেখি না। তা হলে কি এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর সন্দেহের দোলাচলে, সময়বিশেষে রাজনীতিকদের সহজ লক্ষ্যের নিশানা হয়েই চলতে থাকবে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ভোটপ্রক্রিয়া? না, তাও হয়তো নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও ব্লকচেন প্রযুক্তির সাহায্যে ইন্টারনেট ভোটিং নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে পুরোদমে। এখন দূর থেকেও দেওয়া যেতে পারে ভোট। আইআইটি মাদ্রাজ এবং কয়েক জন বিদগ্ধ বিজ্ঞানীর সঙ্গে একযোগে একটি ব্লকচেন প্রকল্প নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সব কিছু ঠিকঠাক চললে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বেশ কিছু মৌলিক বদল আসতে চলেছে এ দেশে।

বিটকয়েন এবং সার্বিক ভাবে ক্রিপ্টোসম্পদ নিয়ে বিপুল বিতর্ক দুনিয়া জুড়ে। সে পরিসরে না ঢুকেও নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, বিটকয়েনের চলমান ইতিবৃত্ত দুনিয়াকে দিয়েছে অন্য এক বলিষ্ঠ উত্তরাধিকার। তা হল ‘ব্লকচেন প্রযুক্তি’, যার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে বিটকয়েনের বিজ্ঞান এবং নিরাপত্তার চক্রব্যূহ। ব্লকচেন যেন লেজার বা খেরোর খাতা, যার তথ্যগুলো জমা রয়েছে গাদা গাদা ব্লকের মধ্যে। একটা ব্লক তথ্যে পূর্ণ হয়ে গেলে, তা জুড়ে দেওয়া হয় আগের ব্লকগুলির সঙ্গে। শিকলের মতো, প্রায় অচ্ছেদ্য এক বন্ধনে। ব্লকচেন প্রযুক্তিতে জমা হওয়া তথ্যের প্রায় অলঙ্ঘনীয় নিরাপত্তার কারণেই এর বিপুল ব্যবহার শুরু হয়েছে জমি নিবন্ধনে, শেয়ার বাজারের কেনাবেচায়, ব্যাঙ্কের বিবিধ কাজকর্মে, ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশে। ভোটপ্রক্রিয়াতেও।

ইতিমধ্যেই ভোটের কাজে ব্লকচেনের ব্যবহার হয়েছে নানা দেশে। ২০২০-র আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্প-বাইডেনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের উত্তেজনার আবহে অনেকেই খেয়াল করেননি, সে দেশের উটা রাজ্যের উটা কাউন্টিতে ভোট হয়েছিল ‘ভোটজ়’ নামের ভোটিং অ্যাপের সাহায্যে, ব্লকচেন-ভিত্তিক প্রযুক্তির প্রয়োগে। এটা সম্ভব হয়েছে কারণ আমেরিকার বিভিন্ন অংশে ভোট হয় স্থানীয় নিয়মে। তার অনেক আগে, সেই ২০১৪-তেই, ডেনমার্কের রাজনৈতিক দল ‘লিবারাল অ্যালায়েন্স’ তাদের দলীয় নির্বাচনে ব্যবহার করেছে এই প্রযুক্তি। ব্লকচেন প্রযুক্তিতে প্রথম রাষ্ট্রীয় ভোট অবশ্য হয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিয়োনে, ২০১৮-তে। পরবর্তী কালে ব্লকচেনের সাহায্যে ভোট নেওয়ার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে জাপানের সুকুবা শহরের ভোটে, ২০১৯-এ মস্কোর সিটি কাউন্সিলের ভোটে, ২০২০-র রাশিয়ার সংবিধান সংশোধনের গণভোটে, এই সেপ্টেম্বরের রাশিয়ার পার্লামেন্টের নির্বাচনেও।

২০১৯-এর বই ইউভোটার— আ সিকিয়োর ই-ভোটিং সিস্টেম ইউজ়িং ব্লকচেন টেকনোলজি-তে দাবি করা হয়েছে, “এই পাবলিক লেজার থেকে, ব্লকচেনের অপরিবর্তনীয়তার কারণে বদলানো যাবে না ফলাফল, এবং ভোটাররা স্বাধীন ভাবে তাদের ভোটের অন্তর্ভুক্তি আর সামগ্রিক ভাবে নির্বাচনের ফলাফল নিরীক্ষণে সক্ষম হবেন।” আপাত ভাবে ব্লকচেনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যই তাই। কিন্তু সত্যিই কি ব্লকচেন-ভিত্তিক ভোটিং মানেই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা? না কি লখিন্দরের বাসর-ঘরের মতো সেখানেও থেকে যেতে পারে কোনও অমোঘ ছিদ্র? রাশিয়ার ভোটে ব্লকচেন প্রযুক্তির ব্যবহারের দুর্বলতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। ২০১৮-র আমেরিকার মিড-টার্ম নির্বাচনে ‘ভোটজ়’ অ্যাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয় পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে। সেই ভোটে হ্যাকিং-এর চেষ্টার অভিযোগ নিয়ে চলেছে বিস্তর চাপান-উতোর। ২০২০-র শেষ দিকে লেখা ‘গোয়িং ফ্রম ব্যাড টু ওয়ার্স: ফ্রম ইন্টারনেট ভোটিং টু ব্লকচেন ভোটিং’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে এমআইটি এবং হার্ভার্ডের বিজ্ঞানীরা আমেরিকার ভোটে ব্লকচেন প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক প্রয়োগের আলোচনা করেছেন, এক হাত নিয়েছেন মোবাইল অ্যাপ-নির্ভর সিস্টেমকে। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম থেকেই পরিষ্কার যে, এই গবেষকরা ব্লকচেনকে ভোটিংয়ের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অভেদ্য বর্ম বলে মনে করেননি।

প্রাচীন গ্রিসে মাটির পাত্রের ভাঙা টুকরোকে ব্যবহার করা হত ব্যালট হিসাবে। সেখান থেকে শুরু করে ইভিএম পর্যন্ত এসেই তো এই বিবর্তন থেমে যেতে পারে না। পরের ধাপে ব্লকচেনের সার্বিক ব্যবহার তাই এক প্রকার নিশ্চিত। তবে নতুন পদ্ধতি প্রয়োগের আগে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা-সমালোচনা, বাদানুবাদ হবেই। রাশিয়া বা আমেরিকায় ব্লকচেনের প্রয়োগের দুর্বলতা দেখে নিয়ে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই আঁটোসাঁটো করতে চাইবেন এর প্রয়োগ-পদ্ধতি। আশা করা যায়, যথেষ্ট নিরাপদ হবে ভবিষ্যৎ ভারতের ব্লকচেন ভোটিং। রাজনৈতিক দলগুলোর সহমত তৈরির চেষ্টাও নিশ্চয়ই হবে। দূর থেকে নয়, ভারতে ভোটারদের বুথে গিয়েই প্রয়োগ করতে হবে ভোটাধিকার।

কিন্তু গণতন্ত্রে ভোটযন্ত্রের প্রযুক্তির নিরপেক্ষতা ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা যতটা দরকারি, তার চাইতে এতটুকু কম প্রয়োজনীয় নয় জনগণের মনে প্রত্যয় জাগানো যে, ভোট এবং তার গণনা নিরপেক্ষ ভাবেই হয়েছে। প্রযুক্তি যাচাই করে বিশ্বাসের আবহ বিস্তারের মূল দায়িত্ব অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের। অগণিত সাধারণ মানুষ তো প্রযুক্তি বোঝেন না। যে সব বিশেষজ্ঞ ইভিএম-এর অ্যানাটমি বোঝেন, ব্লকচেনের উন্নততর প্রযুক্তি হয়তো তাঁদেরও অনেকের আয়ত্তের বাইরে। তাতে অবশ্য বিশেষ সমস্যা নেই। সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিবিদরা ব্লকচেন-ভোটিংকে সার্টিফিকেট দেবেন, প্রতিষ্ঠান একে ভরসাযোগ্য মনে করে তবেই এর প্রয়োগে উদ্যোগী হবে। প্রচারের মাধ্যমে জনগণের মনে এই অযান্ত্রিক ভোটযন্ত্র সম্পর্কে প্রত্যয় জাগানোর চেষ্টাও হবে। তবু, ইভিএম-এর ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে, কোনও কোনও রাজনৈতিক নেতা যে ভবিষ্যতে, বিশেষত ভোটে হারার পরে নতুন ভোটযন্ত্রের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? ওই যে বলেছি, সাধারণ মানুষ বেশি বিশ্বাস করেন, ভরসা করেন তাঁদের রাজনৈতিক নেতাদের। তাই রাজনৈতিক মহল থেকে সন্দেহ ছড়ালে তা জনগণের মনেও উস্কে দেবে সংশয়। তার ফলে দেশ থেমে থাকে না, কিন্তু গণতন্ত্রের ভিত নড়বড়ে হয় নিশ্চয়ই।

তাই ইভিএম হোক বা ব্লকচেন-ভিত্তিক ভোটযন্ত্র, কিংবা ভবিষ্যতের অনাগত কোনও প্রযুক্তি, ভোটের ক্ষেত্রে কাগজের বিস্ময়কর ক্ষমতার লেগ্যাসির সঙ্গে ভোটযন্ত্রকে কুস্তি চালিয়ে যেতেই হবে। আপাত-অবাস্তব, অসম, অথচ অনিবার্য এক লড়াই। অনাগত ভোটযন্ত্রকেও পার হতে হবে, শুদ্ধ হতে হবে নিরন্তর অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement