মেয়েরা ভোট দেন বা দেন না, কিন্তু তাঁদের কথা শোনে কে
Women Empowerment

‘আর হাত কাঁপবে না’

লিস্টে নাম থাকলেই কি আর সব সময় ভোট দেওয়া সম্ভব হয়? আমরা তো ভুলে যাই যে, এ দেশে মেয়েদের পরিযাণ বা মাইগ্রেশন-এর প্রধান কারণ বিয়ে হয়ে স্থানান্তরণ।

Advertisement

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪ ০৮:৫৯
Share:

এক দিন আড্ডা হচ্ছিল দক্ষিণবঙ্গের একটি গ্রামের মেয়েদের সঙ্গে। মে মাসের শেষের দিকে। সকলের ভোটার লিস্টে ঠিকঠাক নাম আছে কি না, কত দূরে বুথ— এ সব কথা যখন হচ্ছে, তখন এক জন বললেন, “যদি ভুল হয় এই ভয়ে আর আমার হাত-পা কাঁপবে না, নাম পড়ে নিয়ে তবে বোতাম টিপব।” তাঁর কথা শেষ না হতেই আরও দু’তিন জন বলে ওঠেন, “এখন আমরা দেওয়ালে দেওয়ালে সব প্রচার পড়তে পারছি, কাউকে জিজ্ঞাসা করে জানতে হচ্ছে না।” ওই দেওয়াল লিখন পড়তে পারার কথাটা সে দিন আমার মাথার মধ্যে যেন একটা ঝড় তুলল।

Advertisement

যাঁদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তাঁরা সকলেই নব সাক্ষর। বয়স ৩৫ থেকে ৭০-এর মধ্যে। গত এক বছর তাঁরা বয়স্ক সাক্ষরতা কর্মসূচির অন্তর্গত এক শিক্ষাক্ষেত্রে আসেন। সাধারণত, ব্যাঙ্কে গিয়ে নামসই করতে পারা, বাস-ট্রেনের গন্তব্য পড়তে পারা, বাড়িতে বাচ্চাদের পড়ায় সাহায্য করতে পারা— এ সব কারণ দেখিয়ে মেয়েদের বয়স্ক সাক্ষরতা কেন্দ্রের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা হয়। মেয়েরা যখন সাক্ষর হতে চাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন, তাঁরা নিজেরাও বেশির ভাগ সময় এগুলোই বলেন। কিন্তু দলবদ্ধ ভাবে সাক্ষর হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে কী ভাবে এঁদের ইচ্ছা/আকাঙ্ক্ষার পুনর্বিন্যাস ঘটে, বদলে যায় জীবনবোধ— সেটা কিছু দিন ধরেই টের পাচ্ছিলাম ওই আড্ডাধারী মেয়েদের মধ্যে।

সাক্ষরতা কেন্দ্রে কেউ যে তাঁদের রাজনীতি-সচেতনতার পাঠ দিয়েছে, তা তো নয়। তবে তাঁরা নিজেরা নানা অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। যেমন, বিদ্যাসাগরের জন্মদিন উপলক্ষে বিদ্যাসাগর ও সাবিত্রীবাই ফুলের জীবন-ভিত্তিক অনুষ্ঠানে তাঁদের এতটাই উৎসাহ ছিল যে, তাঁরা তৈরি হয়েছেন বাড়িতে রান্নার ফাঁকে ফাঁকে, রাতে সবাই শুয়ে পড়লে অথবা মাঠে গরু-ছাগল চড়াতে চড়াতে। ক্লাস করতে এসে তাঁরা পারিবারিক বঞ্চনা ও দৈনন্দিন গার্হস্থ হিংসার ঘটনাগুলো নিজেদের মধ্যে বলার একটা জায়গা পান, হয়ে ওঠেন পরস্পরের সহায়। রাস্তায় কোনও মেয়েকে নির্যাতিত হতে দেখলে প্রতিবাদ করেন একজোট হয়ে।

Advertisement

এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভোটের আগে ভোটপ্রার্থীদের নাম ও দেওয়াল লিখনগুলো নিজেরা পড়ে ভোট দিতে যাওয়ার মধ্যেকার আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ব্যক্ত হয় তাঁদের কথায়। একটা ভয়ও কাজ করে কারও কারও মনে— ভোট না-দিলে নাগরিকত্ব চলে যাবে না তো? তাঁরা সকলেই হিন্দু। কথা বলে বুঝতে পারি, নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের খবর আবছা আবছা জেনে সংশয়ে আছেন।

তবে এঁদের সবচেয়ে বড় সমস্যা জলের। জেরবার হচ্ছেন প্রতি দিন দূর থেকে জল আনতে গিয়ে। অবশ্য মহিলা ভোটার হিসেবে কোনটা তাঁদের এলাকার দুরূহ সমস্যা, কোনটার সুরাহা হলে তাঁদের বেঁচে থাকা একটু সহজ হয়, এগুলো বোধ হয় কেউ কখনও তাঁদের কাছে জানতে চাননি।

ইদানীং মহিলা ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে বিস্তর আলোচনা দেখছি। বিশেষত সর্বভারতীয় গড় অনুপাত ১০০০ পুরুষে ৯৪৮ মহিলা ভোটদাতার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে যখন ১০০০: ৯৬৮ নারী ভোটার, তখন কাকে ভোট দেওয়া কেন তাঁরা লাভজনক মনে করছেন, তার বিশ্লেষণ চলছে উচ্চৈঃস্বরে। ভোটদানের মধ্যে যে তাঁদের বেশির ভাগ মতামতই নিহিত নেই, এটা যেন ভুলে যাওয়া হচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী ও অঞ্চলের নারী-ভোটারদের নিজস্ব দাবির কথা শুনে, রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয়দের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার তেমন কোনও সংগঠিত নাগরিক প্রয়াস এ রাজ্যে দেখা যাচ্ছে না।

দেশের অন্য কিছু এলাকায় ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকে মেয়েদের মধ্যে গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে এই কাজটা শুরু হয়েছে। যেমন, মহারাষ্ট্রের বীড জেলার আখ-কাটা মেয়েদের সংগঠন আখের খেতে কাজ করা কয়েকশো মেয়ের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে তাঁদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও মজুরিসংক্রান্ত মূল সমস্যাগুলোর ভিত্তিতে একটা ইস্তাহার তৈরি করে। তার পর সেই ইস্তাহার নিয়ে এলাকার বিধায়ক ও লোকসভায় সব দলের প্রার্থীর মধ্যে প্রচার করা হয়। অন্ধ্রপ্রদেশ, পঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে বিশেষ ভাবে সক্রিয় মহিলা কিসান অধিকার মঞ্চ নামে একটি সংগঠন কৃষিজীবী মেয়েদের অধিকার ঘিরে ভোটের আগে দাবিসনদ পেশ করে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। ২০২০-র শেষ থেকে পঞ্জাবের কৃষক-মেয়েদের সঙ্ঘবদ্ধতা তো সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে।

তবে নানা ভাবে প্রান্তিক মহিলা-ভোটারের কণ্ঠস্বর যেমন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অশ্রুত থেকে যাচ্ছে, তেমনই আমাদের দেশের মেয়েদের একটা বড় অংশ কেন ভোট দিতে পারেন না আজও, তা নিয়েও কোনও কথা প্রায় শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁরা কাজ নিয়ে অন্য রাজ্যে গেছেন, সে সব মেয়ের মধ্যে খুব কম জনের পক্ষেই সম্ভব পাঁচ-সাত দিনের রোজ খুইয়ে, গাঁটের কড়ি খরচ করে ভিন রাজ্য থেকে বাড়ি ফিরে ভোট দেওয়া। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে ফর্ম ৮ পূরণ করার মাধ্যমে যদিও যে কোনও নাগরিক নতুন ঠিকানাযুক্ত ভোটার কার্ডের আবেদন করতে পারেন, ডিজিটাল বিভাজিকার ও পারে থাকা অনাবাসী শ্রমিকের— বিশেষ করে নারী-শ্রমিক, যাঁদের প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের জগতে আরও পিছিয়ে রাখা হয়েছে— তাঁদের পক্ষে এ কাজটা প্রায় অসম্ভব।

নির্বাচন কমিশন ২০২২-২৩’এ পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য রিমোট ভোটিং মেশিনের (আরভিএম) প্রস্তাব পেশ করেছিল, যাতে তাঁদের পক্ষে ভোট দেওয়া সহজ হয়। কিন্তু বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ‘রিমোট ভোটিং’ প্রক্রিয়ায় ভোট দেওয়ার ব্যাপারে নানা রকম আপত্তি জানানোয় মুলতুবি হয়ে যায় বিষয়টি। বাদ পড়েন কয়েক কোটি মানুষ, যাঁদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাটা নগণ্য নয়।

প্রণয় রায় ও দোরাব সোপারিওয়ালা তাঁদের বই দ্য ভারডিক্ট: ডিকোডিং ইন্ডিয়া’জ় ইলেকশনস (২০১৯)-এ দেখিয়েছেন যে, প্রতি লোকসভা নির্বাচন কেন্দ্রে গড়ে ৩৮,০০০ মহিলা-ভোটার নিখোঁজ। এ বছরের লোকসভা নির্বাচনেও তাঁদের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে ২১ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের নাম ভোটার লিস্টে নেই।

লিস্টে নাম থাকলেই কি আর সব সময় ভোট দেওয়া সম্ভব হয়? আমরা তো ভুলে যাই যে, এ দেশে মেয়েদের পরিযাণ বা মাইগ্রেশন-এর প্রধান কারণ বিয়ে হয়ে স্থানান্তরণ। আমাদের সেই আড্ডাধারী মেয়ের দলেই দু’চার জন আছেন যাঁরা গত দু’বার ভোট দিতে পারেননি, কারণ ভোটার কার্ডের ঠিকানা বদলে এখনকার ঠিকানায় করানোটা বিরাট ঝামেলার ব্যাপার, আর ভোটের সময় একা নদীপথ পেরিয়ে দূরে বাপের বাড়ির গাঁয়ে গিয়ে ভোট দিয়ে আসাটাও তাঁদের হয়ে ওঠেনি।

দু’বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে হতে চলেছে আর একটা নির্বাচন। এ সব নিয়ে কথা বলা কি শুরু হবে এ বার? গোটা মে মাস জুড়ে দেখলাম নতুন তৈরি হওয়া ‘নারী দিবস উদ্‌যাপন মঞ্চ’ সমাজমাধ্যমে একটি পোস্টার সিরিজ় ছড়িয়ে দিল শ্রমজীবী মেয়েদের চাহিদা, দাবি ও অধিকার নিয়ে। দেখা যাক, সেটা প্রসারিত হয়ে অনেকের মধ্যে একটা সংলাপ তৈরি করে কি না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement