বাজেট পেশ করার আগেই নির্মলা সীতারামন বলেছিলেন যে, ২০২১-২২ সালের বাজেট গত একশো বছরের শ্রেষ্ঠ বাজেট হবে। বাজেটটি যে পরিপ্রেক্ষিতে পেশ করা হল, তা শতাব্দীর কঠিনতম স্বাস্থ্য ও আর্থিক সঙ্কট। তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বাজেট হল কি?
লকডাউন শুরু হওয়া থেকেই অর্থনীতিবিদরা দাবি করছিলেন যে, অবিলম্বে মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়া দরকার— সরকারি খরচ বাড়িয়ে এই অতিমারির মোকাবিলা করতে হবে। ২০২০-২১ সালের বাজেটে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে, এই বছর মোট কেন্দ্রীয় সরকারি খরচ হবে ৩০.২২ লক্ষ কোটি টাকা। সংশোধিত হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে, এই বছর মোট সরকারি খরচ হয়েছে ৩৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এই অতিমারির আবহে সরকার খরচ করেছে বাড়তি চার লক্ষ কোটি টাকা।
কিন্তু এই বাড়তি চার লক্ষ কোটি টাকাও কি খরচ হয়েছে, বা হবে? এর উত্তর ‘না’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে দু’টি কারণে। প্রথম, ২০২০ সালের ডিসেম্বর অবধি সরকারের মোট খরচ হয়েছে ২২.৮ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ, আর মাত্র তিন মাসে সরকারকে খরচ করতে হবে অতিরিক্ত ১১.৭ লক্ষ কোটি টাকা, যার জন্য সরকারি খরচ বাড়াতে হবে ৫০ শতাংশের বেশি। বিগত তিন বছরের হিসেব বলছে, ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে খরচ বেড়েছে ২৬-২৭ শতাংশ। তাই ২০২০-২১ অর্থবর্ষের একই সময় খরচ হঠাৎ এতটা বেড়ে যাবে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, এই চার লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে নিহিত রয়েছে প্রায় ১.২ লক্ষ কোটি টাকা, যা আসলে ফুড কর্পোরেশনের খাতা থেকে সরকারি খাতায় খরচ দেখানো। অতএব ২০২০-২১ সালের বাজেটের তুলনায় বাড়তি খরচ হবে আসলে ৩ লক্ষ কোটি টাকা, জিডিপি-র ১.৫%।
২০২০-২১ অর্থবর্ষে সরকার যত টাকা খরচ করেছে, তার তুলনায় ২০২১-২২ সালে সরকার মাত্র ৩৩,০০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ করবে। এই যৎসামান্য খরচ বাড়ানোর মধ্যেই নিহিত রয়েছে আগামী বছর সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি। সরকার মনে করছে যে, ২০২১-২২ সালে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তাই একশো দিনের কাজে ২০২০-২১ সালের খরচের তুলনায় ২০২১-২২ সালে বাজেট বরাদ্দ কমানো হয়েছে প্রায় ৪০০০০ কোটি টাকা; খাদ্য ভর্তুকি, পেট্রো-পণ্যে ভর্তুকি, এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বাজেট বরাদ্দও কমানো হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ ব্যয় সঙ্কোচ করে সরকার বাজেট ঘাটতি কমাতে চাইছে— এমন এক পরিস্থিতিতে, যখন অতিমারির কবল থেকে পৃথিবী এবং দেশ মুক্ত হয়নি, যখন মানুষের কর্মসংস্থান এবং আয় কমেছে, ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। সরকার অনুমান করছে যে, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে জিডিপি-র বৃদ্ধি হবে ১৪.৪ শতাংশ। জিডিপি বৃদ্ধির এই হার বাস্তবায়িত হবে কি না, তার উপর নির্ভর করছে সরকারের বাজেটের অধিকাংশ সংখ্যা।
২০২১-২২ সালে সরকার এক দিকে খরচ কমিয়ে বাজেট ঘাটতি কমানোর কথা বলছে। অন্য দিকে তারা দাবি করছে যে, আর্থিক বৃদ্ধির হার বিপুল ভাবে বাড়বে। যেখানে সরকারি খরচ আসলে কমছে, সেখানে এই বৃদ্ধি তখনই হতে পারে, যখন বেসরকারি কর্পোরেট ক্ষেত্র তাদের বিনিয়োগ বাড়াবে। কর্পোরেটদের উৎসাহ দান করাই তাই বাজেটের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা অতিমারি শুরু হওয়ার আগে থেকেই সরকার লাগাতার কর্পোরেট ক্ষেত্রকে কর ছাড় দিয়ে চলেছে। ২০১৮-১৯ সালে কর্পোরেটদের থেকে মোট কর সংগ্রহ হয় ৬.৬৩ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০১৯-২০ সালে লক্ষাধিক কোটি টাকা কম। ২০২০-২১ সালে এই কর্পোরেট কর আরও কমেছে; ২০২১-২২ সালে বাজেটে অনুমান করা হয়েছে যে, এই বছর মোট কর সংগ্রহ হবে ৫.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ সালে সংগৃহীত কর্পোরেট করের তুলনায় অনেকটাই কম। অর্থাৎ, সরকারের তথ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, আর্থিক বৃদ্ধি হলেও কর্পোরেটদের করের ভার কমবে।
এই প্রবণতা অনেক দিন ধরেই চলছে। ২০১৪-১৫ সালে যখন মোদী সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন কর্পোরেট কর এবং জিডিপি-র অনুপাত ছিল ৩.৪ শতাংশ, যা ২০১৯-২০ সালে কমে হয় ২.৭ শতাংশ এবং যা ২০২১-২২ সালে আরও কমে ২.৫ শতাংশ হবে। কর্পোরেট কর জিডিপি-র অনুপাতে কমছে, আয়করের অনুপাত মোটামুটি অপরিবর্তিত রয়েছে। কিন্তু বেড়েছে উৎপাদন শুল্ক এবং অন্যান্য অপ্রত্যক্ষ কর। ২০২০-২১ সালে, অতিমারির আবহেও সরকার পেট্রল ও ডিজ়েলের উপর উৎপাদন শুল্ক উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি করে। সাধারণ মানুষের উপর অতিমারির সময় এই বাড়তি উৎপাদন শুল্ক চাপিয়ে ২০২০-২১ সালে সরকার আয় করেছে ৩.৬১ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০১৯-২০ সালের তুলনায় ১.২ লক্ষ কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ, কর্পোরেট ক্ষেত্রে করের ভার কমিয়ে দেওয়া হল, কিন্তু অপ্রত্যক্ষ করের ভার বাড়িয়ে সরকার বাড়তি রাজস্ব মানুষের পকেট থেকে তুলে নিল। মনে রাখতে হবে, অতিমারির আবহে দেশের কর্পোরেট ক্ষেত্র নিজেদের সম্পদ বিপুল পরিমাণ বাড়িয়ে নিয়েছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নভেম্বর মাসের রিপোর্ট বলছে যে, মন্দার মধ্যেও কর্পোরেটদের মুনাফা বেড়েছে। অথচ, তাদেরই করের পরিমাণ কমে গেল।
এই সুসময়কে আরও সুরক্ষিত করতে বাজেটে ঘোষণা করা হল যে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে বিপুল ভাবে বেসরকারিকরণ করা হবে। দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ হবে। এমনকি এলআইসি-র শেয়ার বিক্রি হবে শেয়ার বাজারে। প্রচলিত ধারণা হল, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি অকুশলী, লোকসানে চলে ইত্যাদি। সরকারি তথ্য জানাচ্ছে, ২০১৮-১৯ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্থাগুলির মুনাফা ছিল ১.৪২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি কেন্দ্রীয় সরকারকে ডিভিডেন্ড দেয়। ২০১৯-২০ সালে তার পরিমাণ ছিল ৩৫,৫৪৩ কোটি টাকা। অথচ সরকার জানাচ্ছে যে, তারা ন্যূনতম রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মালিকানা রাখবে, বাকি বেচে দেওয়া হবে। ২০২১-২২ সালে বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে কেন্দ্র ১,৭৫,০০০ কোটি টাকা আদায় করবে। এত বিপুল বিলগ্নিকরণের ঘোষণা আগে কোনও সরকার করেনি।
তিনটি প্রবণতাকে চিহ্নিত করা যায়। এক, কর্পোরেট ক্ষেত্রের করের পরিমাণ কমেছে। দুই, শ্রম আইন শিথিল করার মাধ্যমে সংগঠিত শিল্পে শ্রমিকের অধিকার খর্ব করা হয়েছে; অন্য দিকে, কর্পোরেট ক্ষেত্র যাতে কৃষিপণ্যের বাজার এবং ফলনে তাদের ব্যবসা বৃদ্ধি করতে পারে, কৃষি আইনের মাধ্যমে তার ব্যবস্থাও সরকার পাকা করেছে। তিন, বিপুল পরিমাণ বেসরকারিকরণের ঘোষণার মাধ্যমে সরকারি সম্পত্তি কর্পোরেট ক্ষেত্রের হাতে তুলে দিয়ে তাদের ক্ষেত্রকে আরও বড় করার চেষ্টা করছে সরকার। অতএব, এই অতিমারির আবহে বাজেট ও অন্যান্য ঘোষণার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেট ক্ষেত্রের মুনাফা এবং তাদের আর্থিক ক্ষেত্র বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত রয়েছে।
সরকার ভাবছে, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়বে। এই ক্ষেত্রে দু’টি কথা মাথায় রাখতে হবে। ২০১৬ সালের পরে প্রত্যেক বছর আর্থিক বৃদ্ধির হার কমেছে। এই সময় কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেটদের করের হার কমিয়ে তাদের বিপুল কর ছাড় দিয়েছে। অথচ, তার পরেও আর্থিক বৃদ্ধির হারের কোনও উন্নতি হয়নি। দ্বিতীয়ত, গোটা পৃথিবীতেই মন্দা চলছে। লগ্নি হচ্ছে না। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলে কর্পোরেট ক্ষেত্রের বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিদেশে সুদের হার শূন্যে এসে ঠেকলেও বিনিয়োগ হচ্ছে না। ভারতে সুদের হার লাগাতার কমিয়েও ঋণগ্রহণের হার বাড়ানো যায়নি। অধিক মুনাফার আশায় যে অর্থ ঘুরছে, তা শেয়ার বাজারের ফাটকায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে শেয়ার বাজার ফুলে ফেঁপে উঠছে।
এই প্রক্রিয়াকে সরকার নষ্ট করতে চাইছে না। তাই কর্পোরেটদের বিপুল কর ছাড় এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার বাজারে ছেড়ে, শেয়ার বাজারের সূচকের বৃদ্ধি বজায় রাখতে চাইছে। এক দিকে সাধারণ মানুষের জন্য খরচ কমানো, এবং অন্য দিকে কর্পোরেট ক্ষেত্রের সুবিধার্থে নেওয়া একাধিক সিদ্ধান্ত— মোদী সরকার কাদের জন্য অচ্ছে দিন এনে দিল, তাতে সংশয় নেই।
অর্থনীতি বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা