বাংলা টাইপরাইটার। — ফাইল চিত্র।
ভারতের স্বাধীনতার আগে ইংরেজ ও ইংরেজির বিরুদ্ধে লড়াই, এবং হিন্দির পক্ষে ও ভারতীয় হওয়ার লড়াইকে কৌশলে সমার্থক করে তোলা হয়েছিল। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে কেন্দ্রে অনেক সরকার এসেছে, চলেও গিয়েছে, তবু সেই কৌশল আজও অব্যাহত। কিন্তু বাঙালি তো হিন্দুও নয় মুসলমানও নয়, একটা জাতি। আর তাই বোধ হয় বাংলা ভাষার অধিকার আজও আমরা এই দেশে বা রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি।
১৯১২-র মানভূম ভাষা আন্দোলন দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চলার পর ১৯৫৬-র ১ নভেম্বর অংশত হলেও জয়লাভ করেছিল। অবিভক্ত বাংলার আইনসভার প্রথম অধিবেশন হয় ১৯৩৭-এর ৭ ও ৮ এপ্রিল। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইন অনুযায়ী, শুধু ইংরেজিই হবে আইনসভার ভাষা। কিন্তু ১৯৩৭-এর ২৭ অগস্ট থেকেই বাঙালি সদস্যদের কেউ কেউ বাংলায় বক্তব্য বলেন, তখন অবশ্য তার ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করতে হত ও সেই অনুবাদই আইনসভার ধারাবিবরণীতে ঠাঁই পেত, বাংলা ভাষা নয়। ক্রমশ বাংলা ভাষার বক্তা বাড়তে থাকল, ফলে ১৯৩৮ থেকেই বাংলা হরফে ও বাংলা ভাষায় ধারাবিবরণী লিখিত হতে থাকল। ১৯৪৩-এর ৮ জুলাই মাননীয় অধ্যক্ষ বললেন যে, তিনি বাংলায় বলার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দেন, কিন্তু ‘বেঙ্গলি শর্টহ্যান্ড রিপোর্টার্স’-এর খামতির জন্য তা পারছেন না। এই সমস্যা আজও চলছে, এর সঙ্গে আছে টাইপিস্ট, টাইপরাইটার, পরিভাষা ও অনুবাদকের সমস্যা, সর্বোপরি অর্থের সমস্যা (‘অনুবাদ করার মতো অর্থ আমাদের নেই’, ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮, আইনসভার প্রশ্নোত্তর পর্ব)। ও দিকে বাংলা টাইপিস্টদের প্রশিক্ষণ কখনও চলছে, কখনও নয়। টাইপরাইটারের ডিজ়াইন চূড়ান্ত করা হচ্ছে, কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দও। ইতিমধ্যে এল কম্পিউটারের যুগ, অতএব উত্তরও গেল পাল্টে: “বাংলা সফটওয়্যার ‘শ্রীলিপি’ বিনামূল্যে সরকারি দফতরগুলিতে সরবরাহ করা হচ্ছে এবং প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।” (৮ জুলাই ২০০৪)। বিধানসভাতেও ‘সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রয়োগ’ সম্পর্কে প্রশ্ন করা চলছে। উত্তরও আসছে— ‘সরকার সার্বিক প্রচেষ্টা করছে’ (৮ এপ্রিল ১৯৯৭) ইত্যাদি।
আর পরিভাষা? ১৩৫৫ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ, ইংরেজি ১৯৪৮-এই প্রকাশিত হয়েছে তার ‘প্রথম স্তবক’, তার পর একুশ বছরে আরও পাঁচটি স্তবক। মনে রাখতে হবে ‘স্তবক’-এর সাধারণ বাংলা ‘খণ্ড’। এমন কেন? প্রথম স্তবকের মুখবন্ধে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন প্রধান সচিব সুকুমার সেন লিখলেন, “কিছুকাল পূর্বে সরকারি কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।” (১৯ জানুয়ারি ১৯৪৮) মুখবন্ধে তিনি ‘পরিভাষা সংসদ’ গঠনের কথা উল্লেখ করে সদস্যদের নাম ও সংসদের উদ্দেশ্যও ব্যাখ্যা করেন। পরিভাষা সংসদও প্রথম স্তবকের ‘ভূমিকা’য় ব্যাখ্যা করে, কেন তারা অতিমাত্রায় সংস্কৃতের দ্বারস্থ হয়েছে, যেমন: ‘অ্যাকাউন্টস’ শব্দটির পরিভাষা ‘হিসাব’ না করে কেন ‘গণন’ করা হয়েছে, ‘কোর্ট’ শব্দটির পরিভাষা ‘আদালত’ বা ‘বিচারালয়’ না করে কেন ‘ধর্মাধিকরণ’ করা হয়েছে ইত্যাদি। এই পরিভাষা কতটা সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিতদের, আর কতটুকু ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ বাঙালির জন্য, তার বিচার না করাই ভাল। এর উপর আবার বাংলা ভাষাকে রোমান বা দেবনাগরী হরফে লেখার প্রস্তাবও বেশ সক্রিয় ছিল।
১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন সারা বিশ্বে স্বীকৃত হয়ে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সেই ১৯৫২ সালেরই ৪ জুলাই বিধানসভায় আমরা মাননীয় অধ্যক্ষের কাছে ‘রাষ্ট্রভাষা’য় (হিন্দি) কথা বলার জন্য অনুমতি চেয়েছি। এখানেই শেষ নয়। সে বছরেই ২৫ জুলাই এই বাংলার বিধানসভায় বলা হয়েছে, “আজকের দিনে বাংলা ভাষার অজুহাতে বা অন্য কোনও অজুহাতে হিন্দি শিখতে অবহেলা করি... তা হলে ইংরেজের আমলে, প্রথমে ইংরেজি শিখতে মুসলমানেরা অগ্রসর না হওয়ায় তাদের সমাজের যে অবনতি ঘটেছিল, আমরাও সেই দুর্দশায় পতিত হব।” বলা হয়েছে, আমরা যদি হিন্দির দিকে এগিয়ে না যাই, ওড়িশা বা অসমের চেয়ে কয়েক গুণ এগিয়ে না যাই, তা হলে ভবিষ্যতে শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, কর্মক্ষেত্রেও আমাদের সন্তানেরা উপযুক্ত মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে না!
১৯৬১ সালের জনগণনা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে দশ হাজার বা তার বেশি বক্তা আছে এমন ভাষার সংখ্যা ছিল ২৬টি, এবং এর মধ্যে ১৮টি ভাষার বর্ণমালাও আছে। কে জানে, আজ তারা সত্যিই আছে কি না? ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের কি কোনও দায়িত্ব নেই? কেবল আবেগ, শুধুই উদ্যাপন? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কি আমাদের কাছে কিছু অঙ্গীকারও দাবি করছে না?