বাস্তবে মহিলা সংরক্ষণের জন্য জনগণনার প্রয়োজন কোথায়
Women Reservation Bill

যার কোনও ব্যাখ্যা নেই

দু’দিন ধরে লোকসভা ও রাজ্যসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কেন মহিলা সংরক্ষণের জন্য আগে জনগণনা প্রয়োজন?

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৪০
Share:

একত্রে: রাজ্যসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশের পর প্রধানমন্ত্রীকে মহিলা সাংসদদের অভিনন্দন। ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩। ছবি: পিটিআই।

মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ করিয়ে সংসদে নরেন্দ্র মোদী নারী-শক্তির জয়গান গাইছেন। এই কাজের জন্যই তিনি নিজেকে ‘ঈশ্বরপ্রেরিত’ বলে দাবি করছেন। কিন্তু ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তিন ভাগের এক ভাগের আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে না। কারণ মোদী সরকারের বিলে বলা হয়েছে, আগে জনগণনা ও আসন পুনর্বিন্যাস হবে। তার পরেই মহিলা সংরক্ষণ কার্যকর হবে। না হলে কোন আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হবে, তা ঠিক করা যাবে না।

Advertisement

দু’দিন ধরে লোকসভা ও রাজ্যসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কেন মহিলা সংরক্ষণের জন্য আগে জনগণনা প্রয়োজন? কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও মন্ত্রী বা বিজেপির কোনও নেতা সংসদে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। কারণ, মহিলা সংরক্ষণের জন্য বাস্তবে জনগণনার প্রয়োজনই নেই।

মোদী সরকারের মহিলা সংরক্ষণ বিলে আরও একটি প্রশ্নের উত্তর মেলে না। তা হল, লোকসভা বা বিধানসভার কোন কোন আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হবে, তা কিসের ভিত্তিতে ঠিক হবে? কী সেই নিয়ম? বিলে এর ব্যাখ্যা নেই। কেন? কারণ এর কোনও নিয়ম তৈরি করাই সম্ভব নয়।

Advertisement

চলুন, বিশদে যাওয়া যাক।

জনগণনা হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালে। কোভিডের কারণে জনগণনা করা যায়নি বলে মোদী সরকারের দাবি। এখন শোনা যাচ্ছে, লোকসভা ভোটের পরে জনগণনা হবে। শেষ জনগণনা হয়েছিল ২০১১ সালে। সেই জনগণনা অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যায় মহিলাদের হার ছিল শতকরা ৪৮.৫ ভাগ। রাজ্য বিশেষে জনসংখ্যায় মহিলাদের হারে সামান্য তারতম্য ছিল। তবে সেটা বিরাট কিছু নয়— ওই ৪৭ শতাংশ থেকে ৪৯ শতাংশের মধ্যে। কেরলের মহিলাদের জনসংখ্যার হার কিছুটা বেশি। ৫২ শতাংশের বেশি। আর হরিয়ানায় কিছুটা কম। ৪৬ শতাংশের ঘরে। বাকি সব রাজ্যেই জনসংখ্যায় মহিলাদের ভাগ ওই ৪৭, ৪৮ বা ৪৯ শতাংশের ঘরে। রাজ্যগুলির লোকসভা বা বিধানসভা কেন্দ্রেও মহিলাদের জনসংখ্যার হার কম-বেশি একই রকম। অর্থাৎ, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্র ও সুকান্ত মজুমদারের বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের জনসংখ্যায় মহিলাদের হার প্রায় একই রকম। একই ভাবে বিধানসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবানীপুর ও শুভেন্দু অধিকারীর নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের জনসংখ্যায় মহিলাদের হারেও বিরাট ফারাক নেই।

এই কারণেই ডায়মন্ড হারবার ও বালুরঘাটের মধ্যে কোন লোকসভা কেন্দ্র মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হবে, তার কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম বার করা মুশকিল। যদি ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের জনসংখ্যায় মহিলাদের হার ৭০ শতাংশ হত আর বালুরঘাটে ৩০ শতাংশ, তা হলে বলা যেত, ডায়মন্ড হারবার মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করা উচিত। সেখান থেকে মহিলারাই প্রার্থী হবেন। কিন্তু সব লোকসভা কেন্দ্রে মহিলাদের জনসংখ্যার হারে কম-বেশি একই রকম। ২০১১-র জনগণনায় তা দেখা গিয়েছিল। লোকসভা ভোটের পরে নতুন করে জনগণনা হলে যে এই ছবিটা বদলে যাবে, এমন নয়। তাই কোন লোকসভা বা বিধানসভা কেন্দ্র মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করা হবে, তা জনগণনা করে ঠিক করা যাবে না। ঠিক এই কারণেই মহিলা সংরক্ষণ কার্যকর করার আগে জনগণনার প্রয়োজন নেই।

জনগণনার প্রয়োজন হয় তফসিলি জাতি, জনজাতিদের জন্য আসন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে। যে সব লোকসভা বা বিধানসভা কেন্দ্রে তাঁদের জনসংখ্যার হার বেশি, সেই আসনগুলি এসসি, এসটি সংরক্ষিত করা হয়। জনসংখ্যায় মহিলাদের ভাগ দেশের সর্বত্র কম-বেশি একই রকম। তাই কোন কোন আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হবে, তা বার করার একটিই উপায়। তা হল, লটারি।

বিলে বলা হয়েছে, লোকসভার ৫৪৩টি আসনের তিন ভাগের এক ভাগ বা ১৮১টি আসন সংরক্ষিত থাকবে। ১৫ বছর এই ব্যবস্থা চালু থাকবে। অর্থাৎ, তিনটি লোকসভা নির্বাচনে মহিলা সংরক্ষণের নীতি বজায় থাকবে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সব আসনই মহিলা সংরক্ষিত থাকবে। সে ক্ষেত্রে লটারি করেই ঠিক করতে হবে, প্রথম বার লোকসভার কোন ১৮১টি আসন মহিলা সংরক্ষিত থাকবে। পরের বার আবার অন্যগুলি। এক বার ডায়মন্ড হারবার মহিলা সংরক্ষিত হলে পরের বার বালুরঘাট। এক বার ওয়েনাড় হলে পরের বার বারাণসী। এই লটারির দায়িত্ব নিশ্চিন্তে নির্বাচন কমিশনের উপরে ছেড়ে দেওয়া যেত। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটেই মহিলা সংরক্ষণ কার্যকর করা যেত।

তা হলে কেন জনগণনা, আসন পুনর্বিন্যাসের শর্ত লাগিয়ে দিয়ে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা মহিলা সংরক্ষণ পিছিয়ে দিলেন?

কারণ খুব সহজ। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে মহিলা সংরক্ষণ বিল কার্যকর হলে বিজেপিকেও প্রায় ৩৩ শতাংশ আসনে মহিলা প্রার্থী দিতে হত। ভোটের মাত্র ছয় মাস বাকি। অধিকাংশ লোকসভা কেন্দ্রেই সাংসদরা পরের ভোটে লড়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। তাঁদের সিংহভাগই পুরুষ। কারণ বিজেপির ৩০৩ জন সাংসদের মধ্যে মাত্র ৩৪ জন মহিলা। ২০১৯-এ বিজেপি ৫৪৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৪৩৭টি আসনে লড়েছিল। লোকসভা ভোটে এত বেশি আসনে বিজেপি আগে কখনও লড়েনি। এখন বিজেপি নারী-শক্তির ঢাক পেটাচ্ছে ঠিকই, তখন ওই ৪৩৭ জন বিজেপি প্রার্থীর মধ্যে মহিলা ছিলেন মাত্র ৫৩ জন। নরেন্দ্র মোদী যে-বার প্রথম ক্ষমতায় এলেন, সেই ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি গোটা দেশে ৪২৮টি লোকসভা কেন্দ্রে লড়েছিল। তার মাত্র ৮.৮ শতাংশ কেন্দ্রে বিজেপি মহিলা প্রার্থী দিয়েছিল। ২০১৯-এ সেটা বেড়ে ১২.৬ শতাংশ হয়। এখন কি বিজেপির পক্ষে আচমকা দলের পুরুষ নেতাদের একটা বড় অংশকে সরিয়ে মহিলাদের প্রার্থী করা সম্ভব? বিজেপি কেন, কোনও দলের পক্ষেই সেটা সম্ভব নয়। সাংগঠনিক কারণেই ২০২৪-এ মহিলা সংরক্ষণ বিল কার্যকর করা বিজেপির পক্ষে সম্ভব ছিল না। বিজেপি নেতারা যুক্তি দিচ্ছেন, মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হওয়ায় মহিলারা তাঁদের আরও বেশি করে ভোট দেবেন। এখন মহিলা সংরক্ষণ কার্যকর হবে না, শুধু বিল পাশের জন্যই মহিলারা ভোট দেবেন, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা নিশ্চিত ভাবেই মহিলাদের এত বোকা ভাবছেন না। কারণ তাঁরা নিজেরাও এতটা বোকা নন। আর মহিলা ভোটই পাখির চোখ হলে লোকসভা ভোটের আরও কাছাকাছি সময়ে, ডিসেম্বরে শীতকালীন অধিবেশনে বা ফেব্রুয়ারির বাজেট অধিবেশনে বিল পাশ করানো হত। ভোটের ছয় মাস আগে নয়।

তা হলে কেন আচমকা সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ করানো হল? এর একটাই কারণ। নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি অক্ষু্ণ্ণ রাখা। তার জন্য আদানি-কাণ্ড থেকে নজর ঘোরানো। সেপ্টেম্বরের গোড়ায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার দরে কারচুপি, বিদেশে টাকা পাচার, তা দেশে ঘুরপথে ফেরত আনা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। তাতে কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু তাবড় বিদেশি সংবাদপত্রে আদানিকে ‘নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচয় দেওয়া হয়। দু’জনের পাশাপাশি ছবি ছাপা হল। তার পর থেকেই রাজনীতিতে রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ় শুরু। প্রথমে ‘এক রাষ্ট্র, এক ভোট’ নিয়ে রহস্য। এই বুঝি লোকসভা ভোটের সঙ্গেই সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট ডেকে ফেলা হল! বাস্তবে হল না। তার পর সংসদের বিশেষ অধিবেশন। সেখানে কী হবে, তা নিয়ে দু’সপ্তাহ টানটান উত্তেজনা। শেষে ঝোলা থেকে বার হল মহিলা সংরক্ষণ বিল। এ নিয়ে এত গোপনীয়তার প্রয়োজন ছিল কি? ছিল। বিজেপিকে স্বস্তি দিয়ে তিন-চার সপ্তাহে আদানি-কাণ্ড থেকে প্রচারের আলো সরে গেল। নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তিটি অক্ষুণ্ণ রইল। বিজেপির যে এখন ওইটিই পুঁজি। ‘ব্র্যান্ড নরেন্দ্র মোদী’ না থাকলে বিজেপির কী হবে, তা কারও কিচ্ছুটি জানা নেই।

মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ করিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সাফল্য এই একটিই। ‘আদানির বন্ধু’ ছাপ ঝেড়ে ফেলে ‘ঈশ্বরপ্রেরিত’ রূপে আবির্ভাব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement