গত ১১ জুলাই ছিল ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’। এ দিন রাষ্ট্রপুঞ্জ একাধিক রিপোর্ট প্রকাশ করল— আগামী বছরগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি কী হবে, সে বিষয়ে। রিপোর্ট বলছে, ২০২২ থেকে ২০৩০-এর মধ্যে পৃথিবীর লোকসংখ্যা ৮০০ কোটি থেকে ৮৫০ কোটিতে পৌঁছবে। ২০৫০ সালে সংখ্যাটি হবে ৯৭০ কোটি, এবং ২১০০-য় সেটি বেড়ে ১০৪০ কোটিতে পৌঁছনোর কথা।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৫০-এর পর ২০২০ সালেই প্রথম বার বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বার্ষিক হিসাবে ১ শতাংশেরও নীচে নেমে যায়। কারণ, পৃথিবীব্যাপী গড় জন্মহার— ১৯৫০ সালে যা ছিল মহিলাপিছু পাঁচটি সন্তান— তা কমে বর্তমানে ২.৩ হয়েছে। এই জন্মহার প্রতিস্থাপন-যোগ্য স্তর ২.১-এ পৌঁছনোর কথা ২০৫০ সালে। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী জন্মকালীন সম্ভাব্য গড় আয়ু দাঁড়ায় ৭২.৮ বছরে; ১৯৯০ সালের মানের চেয়ে যা প্রায় ন’বছর বেশি। ভবিষ্যতে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার আরও কমবে বলেই আশা; ফলে, ২০৫০ নাগাদ বিশ্বজনীন গড় আয়ু বেড়ে ৭৭.২ বছর হয়ে যাওয়ার কথা।
উল্লিখিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৭ সালের পরিবর্তে, ২০২৩ সালেই ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। এর কারণ এই নয় যে, ভারতে জন্মহার যথাযথ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি— আসলে চিনের জন্মহার পূর্বানুমানের চেয়ে দ্রুততর কমে যাওয়াতেই এই ঘটনা ঘটছে। চিন যখন ‘এক-সন্তান নীতি’ চালু করে, তখন সে দেশে মহিলা-পিছু গড় জন্মহার ছিল ২.৬। ২০১৬ সালে চিন যখন ‘দুই-সন্তান নীতি’ প্রবর্তন করে, তখনই এই জন্মহার কমে ১.৭ হয়ে গিয়েছিল। ২০২১ সালে যখন চিন তাদের নীতি ফের পরিমার্জন করে ‘তিন-সন্তান নীতি’ চালু করেছে, তখন এই জন্মহার আরও কমে দাঁড়িয়েছিল ১.৩। ২০২২-এ তা আরও কমে হয়েছে ১.১৬। এর কারণ, বেশ কয়েক দশক ধরে চিনা দম্পতিরা কেবলমাত্র একটি সন্তান নিয়ে জীবনধারণে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। বর্তমানে চিন তাদের বয়স্ক নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর ভার সামলাতে ব্যস্ত, ২০৫০ নাগাদ সেখানে এই সমস্যা তীব্রতর হয়ে উঠবে।
ভারতের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার পঞ্চম দফার রিপোর্ট (২০১৯-২১) অনুযায়ী, ভারতে জন্মহার ইতিমধ্যেই প্রতিস্থাপন-যোগ্য স্তরের চেয়ে কমে গিয়েছে— বর্তমানে হারটি ২.০। এখানেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বার্ষিক ১ শতাংশের চেয়ে কম। অনুমান, ২০৪৮ সালে ভারতের জনসংখ্যা পৌঁছবে তার সর্বোচ্চ স্তরে— ১৬০ কোটিতে। যদিও সেই সময় জন্মহার আরও হ্রাস পেয়ে ১.৩ হয়ে যাওয়া, এবং একই সঙ্গে প্রধানত বয়স্কদের মধ্যে মৃত্যুর হার বৃদ্ধির দরুন ২১০০ সালে জনসংখ্যা কমে গিয়ে ১১০ কোটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, জনসংখ্যার এই গতি পরিবর্তন ভারতের জন-নীতির ক্ষেত্রে কী তাৎপর্য বহন করে? আগামী পঁচিশ বছরে জনসংখ্যার পরিসর তিনটি ভিন্নধর্মী পরিবর্তন দেখতে চলেছে— ভারত ও অন্যান্য দেশের মধ্যে; ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে; এবং ভারতের আন্তঃপ্রজন্মের মধ্যে।
প্রথমত, আগামী পঁচিশ বছরের মধ্যে ভারতের জনসংখ্যার এক বড় অংশ কর্মক্ষম বয়সে পৌঁছবে। বিশ্বের প্রতি পাঁচ জন কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে এক জন হবেন ভারতীয়, দেশের ৬২% মানুষ থাকবেন কর্মক্ষম বয়স-বন্ধনীতে। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা ভাল: কর্মক্ষম বয়ঃসীমায় জনসংখ্যার সিংহভাগ থাকা মানেই অনেক সংখ্যক কর্মী, তা কিন্তু আদৌ নয়। ভারতে শ্রমশক্তির আয়তন মূলত দু’টি কারণে সীমাবদ্ধ। এক, শ্রমশক্তির দক্ষতার অভাব। ২০২১-এর ‘ইন্ডিয়া স্কিল রিপোর্ট’ অনুযায়ী, দেশের যুবক-যুবতীদের কেবল ৪৫.৯% নিয়োগযোগ্য। কারিগরি দক্ষতার ক্ষেত্রে সমস্যা আরও জটিল। ২০১৯-এর ‘ন্যাশনাল এমপ্লয়েবিলিটি রিপোর্ট ফর এঞ্জিনিয়ার্স’ অনুযায়ী, ভারতের ৮০% ইঞ্জিনিয়ার তাঁদের নিয়োগকর্তাদের সন্তুষ্ট করার মতো দক্ষ নন। দুই, কর্মশক্তির পরিসরে মহিলাদের সুস্পষ্ট অনুপস্থিতি। সাম্প্রতিকতম পর্যায়ক্রমিক শ্রমশক্তি সমীক্ষার (২০১৯-২০) রিপোর্ট অনুযায়ী, পনেরো বছর বা তদূর্ধ্ব মহিলাদের মাত্র ২৮.৭% উপার্জন করেন, যেটি ২০০৫ সালে ছিল ৩২%। যদিও নতুন শ্রমিক কোড অনুযায়ী সরকার শ্রমশক্তিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন উদ্যোগ করেছে— যেমন, সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ ১২ সপ্তাহ থেকে বাড়িয়ে ২৬ সপ্তাহ করা, পঞ্চাশ বা তার অধিক কর্মী নিয়ে চলা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক ভাবে শিশুদের দেখভালের ব্যবস্থা রাখা, এমনকি রাতে কাজ করার ক্ষেত্রে মহিলা কর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা ইত্যাদি। তা সত্ত্বেও কারখানা, পরিবহণ ক্ষেত্র বা সুদক্ষ উচ্চপদে মহিলাদের অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
দ্বিতীয়ত, আন্তঃরাষ্ট্রীয় জনসংখ্যার বিন্যাস একটি জরুরি বিষয় হয়ে উঠবে। দক্ষিণ, পশ্চিম এবং পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি ইতিমধ্যেই জন্মহার কমিয়ে ফেলেছে, যার ফলে দেশের ভবিষ্যৎ কর্মীরা মূলত আসবেন বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড এবং রাজস্থান থেকে, যে হেতু এখনও এ সব রাজ্য জন্ম নিয়ন্ত্রণে খানিকটা হলেও পিছিয়ে। ফলে, আগামী দিনের কথা মাথায় রেখে প্রথমেই উল্লিখিত রাজ্যগুলিতে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন, বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষার পর্যাপ্ত প্রসার জরুরি। যে হেতু এই রাজ্যগুলি থেকে শিল্পায়িত রাজ্যগুলিতে দক্ষ-অদক্ষ-নির্বিশেষে বহু শ্রমিকের পরিযাণ হবে, সেই জন্য কেন্দ্র তথা রাজ্যগুলির উচিত পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য একটি সুস্পষ্ট নির্ণায়ক নীতি গড়ে তোলা। তা না হলে, ভবিষ্যতে সামাজিক সংঘাত উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। অন্য দিকে, দক্ষিণে অবস্থিত রাজ্যগুলি এবং পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র ও পঞ্জাবে ইতিমধ্যেই সমাজের বৃহত্তর অংশের উপর ৬৫ বা তদূর্ধ্ব বয়স্ক জনগোষ্ঠীর দেখভালের ভার বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতে এ সমস্যা আরও প্রকট হবে।
তৃতীয়ত, আন্তঃপ্রজন্ম-ভিত্তিক সম্পর্কগুলিও আগামী দিনে বদলে যাবে। ২০৫০-এর পর দেশে বয়স্কদের সংখ্যা তীব্র ভাবে বৃদ্ধি পাবে। ২১০০ সালে পৌঁছে ৬৫ বছরের বা তার বেশি বয়স্করাই হয়ে উঠবেন ভারতের মোট জনসংখ্যার ৩০%। ছোট পরিবার হওয়ার দরুন এই প্রবীণদের দেখভালের দায়িত্ব বর্তাবে সর্বাধিক এক অথবা দুই সন্তানের উপরে। ফলে বয়স্কদের পক্ষে বৃহত্তর পরিবারে থেকে চিরাচরিত জীবনযাপন করা ক্রমশ দুরূহ হয়ে উঠবে। অন্য দিকে, কেন্দ্রীভূত পরিবারে কর্মরত দম্পতি এবং তাঁদের শিশু-সন্তানের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক ভারসাম্য বজায় রাখা হবে অন্যতম কর্তব্য। এর থেকেই বোঝা যায় যে, শুধুমাত্র বয়স্কদের যত্নের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা যথেষ্ট নয়, ছোট পরিবারের সন্তানদের জন্যও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা কাঙ্ক্ষিত। প্রবীণদের জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত সঞ্চয়, সামাজিক সুরক্ষা, অবসর-পরবর্তী ঠিকা কাজের সংস্থান এবং ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের সুযোগ। এ ছাড়াও, যে হেতু মহিলাদের প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেশি, ফলে অধিকাংশ বয়স্কই মহিলা ও সম্ভাব্য বিধবা হবেন— ফলে বিধবা-পেনশন ছাড়াও পারিবারিক সঞ্চয়, জমি-বাড়ি ইত্যাদির উপরেও মহিলাদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি প্রয়োজন।
ভবিষ্যতে বিকল্প ব্যবস্থার অভাবে আমাদের হয়তো খুঁজে নিতে হবে বদলে যাওয়া জনতাত্ত্বিক গঠন এবং ধরনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার উপায়। ২০০০ সালের জাতীয় জনসংখ্যা নীতি জোর দিয়েছিল ছোট পরিবার বিধি প্রণয়ন এবং জনসংখ্যার স্থিতিশীলতার উপরে। বর্তমানে আরও একটি জাতীয় জনসংখ্যা নীতির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, যা জোর দেবে পরবর্তী কয়েক দশকে দেশের বদলে যাওয়া জনসংখ্যার আকার, কাঠামো এবং ধরনকে সামাল দেওয়ার বিষয়টি বুঝতে। রাজ্য স্তরেও জনসংখ্যা নীতির প্রয়োজন, কারণ বিভিন্ন রাজ্যে জনসংখ্যার সমস্যাও বিভিন্ন হবে।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা