Protests

স্বচ্ছ নিয়োগ নিশ্চিত করতে

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন দফতরে ও সরকার-পোষিত সংস্থায় কর্মী নিয়োগে নানা দুর্নীতি, বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ও মামলা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে রাজ্য রাজনীতি সরগরম।

Advertisement

তূর্য বাইন

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৪ ০৮:৪৯
Share:

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির দিন কি শেষ হতে চলেছে? সম্প্রতি ভারত সরকার দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ নিয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক অভিনব আইন প্রণয়ন করেছে: ‘দ্য পাবলিক এগজ়ামিনেশন (প্রিভেনশন অব আনফেয়ার মিনস) অ্যাক্ট, ২০২৪’ বা ‘জন পরীক্ষা (অন্যায্য উপায় প্রতিরোধ) আইন, ২০২৪’। সরকারি চাকরিতে নিয়োগে দুর্নীতি প্রমাণিত হলে তার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির সংস্থান রাখা হয়েছে এই আইনে।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন দফতরে ও সরকার-পোষিত সংস্থায় কর্মী নিয়োগে নানা দুর্নীতি, বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ও মামলা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে রাজ্য রাজনীতি সরগরম। গান্ধী মূর্তির পাদদেশে এসএলএসটি-উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীদের ধর্না চলছে; চাকরিপ্রার্থীরা মুখে কালি মেখে, খালি গায়ে, এমনকি রক্ত দিয়ে চিঠি লিখে দ্রুত নিয়োগের আবেদন করে চলেছেন। ধর্নার সহস্রতম দিনে এক মহিলা চাকরিপ্রার্থীকে মস্তক মুণ্ডন করতেও দেখা গেছে। অন্য দিকে, ২০১৪-র টেট-উত্তীর্ণ ‘নট ইনক্লুডেড’ চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন আজও অব্যাহত। ও দিকে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী-সহ শিক্ষা দফতরের বেশ কিছু কর্তাব্যক্তি কারাবন্দি। শিক্ষাক্ষেত্র ছাড়াও রাজ্যের পুরসভাগুলিতে এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে কর্মী ও আধিকারিক নিয়োগে কারচুপির একাধিক অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগের অপেক্ষায় দিন গুনছেন বহু প্রার্থী।

নিয়োগ-দুর্নীতির অভিযোগ যে শুধু এ রাজ্যেই তা নয়। অন্য রাজ্যেও সরকারি চাকরিতে নিয়োগ-দুর্নীতির ভূরি ভূরি অভিযোগ। কর্নাটকে ২০২২ সালে পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর পদে নিয়োগের পরীক্ষায় ‘কর্নাটক পাবলিক সার্ভিস কমিশন’-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তাতে এক আইপিএস অফিসার-সহ অন্তত ১৫ জন পুলিশ আধিকারিক গ্রেফতার হন। কয়েক মাস আগে ‘উত্তরাখণ্ড সাবঅর্ডিনেট সার্ভিস সিলেকশন কমিশন’-এর চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস দুর্নীতি নিয়ে তোলপাড় হয়। তদন্তকারী সংস্থার অনুমান, প্রশ্ন ফাঁস করে দুষ্কৃতীরা অন্তত ২০০ কোটি টাকা বেআইনি ভাবে রোজগার করেছে। ২০২২-এ মধ্যপ্রদেশ সরকারের বিরুদ্ধেও টাকার বিনিময়ে সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। উত্তরাখণ্ডে স্টাফ সিলেকশন কমিশন-সহ নানা ক্ষেত্রে সরকারি চাকরির নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে বেকার যুবক-যুবতীদের বিক্ষোভ ও তা দমনে পুলিশের লাঠিচালনা দেশের সংবাদমাধ্যমগুলির নজর কেড়েছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে উত্তরাখণ্ডের গভর্নর, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) গুরমিত সিংহ ‘উত্তরাখণ্ড কম্পিটিটিভ এগজ়ামিনেশন অর্ডিন্যান্স’ জারি করে নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত থাকলেই যাবজ্জীবন জেল-সহ কঠোরতম সাজা ঘোষণা করেছেন।

Advertisement

‘জন পরীক্ষা (অন্যায্য উপায় প্রতিরোধ) আইন, ২০২৪’ অনুযায়ী আর্থিক লাভ বা অবৈধ সুবিধা লাভের জন্য জন পরীক্ষা পরিচালনায় কোনও ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের অসাধু কাজ বা বিচ্যুতি বিবেচিত হবে অন্যায্য পন্থা ও অপরাধ হিসাবে। প্রশ্নপত্র, উত্তর, সূত্র বা এগুলির কোনও অংশ ফাঁস, এ কাজে অন্যের সঙ্গে যোগসাজশ, অধিকার-বহির্ভূত ভাবে প্রশ্নপত্র বা ওএমআর শিট দেখা, জন পরীক্ষা চলাকালীন অনধিকারী ব্যক্তি দ্বারা সমাধান সরবরাহ, পরীক্ষার্থীকে অবৈধ ভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা, প্রশ্নপত্র বা ওএমআর শিটে কারচুপি, প্রকৃত ভ্রম সংশোধন ছাড়া মূল্যায়নে পরিবর্তন, কেন্দ্রীয় সরকারের স্থির করা মান বা নিয়মকে ইচ্ছাকৃত ভাবে লঙ্ঘন, চূড়ান্ত মেধা তালিকা প্রস্তুতির জন্য আবশ্যক কোনও নথিতে কারচুপি, জন পরীক্ষায় অন্যায্য সুবিধা দিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সুরক্ষা ব্যবস্থা লঙ্ঘন-সহ ১৫টি অন্যায্য কৌশলকে অপরাধের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে— যদিও আইনে আরও নানা বিষয় এই তালিকায় সংযোজনের সংস্থান রাখা হয়েছে। জন পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত সকল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও এজেন্সিকে এই আইনে দায়বদ্ধ করারও সংস্থান রাখা হয়েছে। জন পরীক্ষায় সংঘটিত যে কোনও অপরাধই এই আইনে আদালতগ্রাহ্য, মীমাংসা-অযোগ্য ও জামিন-অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীর তিন থেকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং সঙ্গে দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আর্থিক জরিমানা হবে, অনাদায়ে বাড়বে কারাদণ্ডের মেয়াদ।

তবে এই আইনে ‘পাবলিক এগজ়ামিনেশন’ বা জন পরীক্ষা বলতে সুনির্দিষ্ট তালিকাভুক্ত ‘পাবলিক এগজ়ামিনেশন অথরিটি’ বা কেন্দ্রীয় সরকার প্রজ্ঞাপিত কোনও সংস্থা দ্বারা গৃহীত পরীক্ষাকে বোঝানো হয়েছে। ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন, স্টাফ সিলেকশন কমিশন, রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ড-সহ মোট ছ’টি কেন্দ্রীয় সংস্থার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার প্রজ্ঞাপিত সংস্থাকে ‘পাবলিক এগজ়ামিনেশন অথরিটি’ হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, মূলত কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যাতে দুর্নীতি না হয়, তা নিশ্চিত করাই আইনটির উদ্দেশ্য।

কিন্তু দেশে ক্রমবর্ধমান বেকার সংখ্যার নিরিখে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির সুযোগ যে অতি সীমিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তুলনায় রাজ্য সরকারি চাকরির সুযোগ বেশি, শিক্ষিত বেকারদের একটা বড় অংশ তারই প্রস্তুতি নেন। তাই রাজ্য সরকারি চাকরিতে যত দিন না স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ নিশ্চিত হচ্ছে, তত দিন হয়তো ন্যায্য চাকরির দাবিতে পথে কাটানো আর পুলিশি হেনস্থা থেকে বেকারদের নিস্তার নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement