কণ্ঠস্বর: পরিস্রুত পানীয় জলের দাবিতে গ্রামবাসীদের পথ অবরোধ। ১৭ এপ্রিল ২০২৩, বাগনান, হাওড়া। —ফাইল চিত্র।
বোমা, গুলি, বাইক, উইকেট, খুন, জখম, হুমকি, সাদা থান, কেন্দ্রীয় বাহিনী, আদালতের পর আদালতে মামলার পর মামলা— পশ্চিমবঙ্গের ফলিত গণতন্ত্রের অবিরাম প্রলয়নাচনের আদিপর্বে একটি সমাপতন ঘটে গেল। এ-মাসের গোড়ায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের নবনিযুক্ত কর্ণধারের সাংবাদিক বৈঠকে যে দিন পঞ্চায়েত ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ল, সেই দিনই নবান্নে ঘোষিত হল নতুন কর্মসূচি: সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের নাগরিকরা তাঁদের অভাব অভিযোগ দাবিদাওয়ার কথা জানাতে পারবেন একটি বিশেষ টেলিফোন নম্বরে, তাঁদের বক্তব্য শুনে সেগুলি গুছিয়ে নিয়ে এবং প্রয়োজনীয় ঝাড়াই-বাছাই করে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পেশ করা হবে, রাজ্যবাসী ‘সরাসরি’ পৌঁছে যাবেন সর্বোচ্চ দরবারে। এর আগেও নিজের কথা জানানোর একটি সিধে রাস্তা তৈরি হয়েছিল, তার নাম ‘দিদিকে বলো’। তবে সেটা ছিল দলীয় প্রকল্প, এ-বারেরটি সরকারি। কী বা তাতে এল গেল? পশ্চিমবঙ্গবাসী জানেন সরকার মানেই দল, যিনি দিদি তিনিই মুখ্যমন্ত্রী। কূটবুদ্ধির অনুপ্রেরণায় কেউ কেউ হয়তো বেসুর গাইবেন— একটা গোটা সরকার স্তরে স্তরে বিরাজমান, তার সাতমহলা ভুবনে এত মন্ত্রী-সান্ত্রি, এত এত দফতর, ঝকঝকে নেমপ্লেট, নীল আলো, বড় চেয়ার মেজো চেয়ার ছোট চেয়ার, তার পরেও কেন মুখ্যমন্ত্রী/দিদিকে থেকে থেকেই প্রজাকুলের উদ্দেশে ‘মামেকং শরণং ব্রজ’ বলে বিজ্ঞাপন দিতে হয়? এমন সব প্রকল্পের আদৌ প্রয়োজন হয় কেন? তবে কি সরকারি ব্যবস্থায় সরকার-প্রধানের নিজেরই আস্থা নেই? কিন্তু আমরা এ-সব বেয়াড়া প্রশ্ন কানে না তুলতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। মানুষ অভ্যাসের দাস।
অভ্যাস দৃঢ়মূল হয়েছে বলেই সে-দিন সরকারি অলিন্দ থেকে কার্যত সমস্বরে ওই দু’টি ঘোষণা শুনে আমরা, পশ্চিমবঙ্গের ‘রাজনীতি-সচেতন’ নাগরিকরা, প্রশ্ন তুলিনি: এই সমাপতন কি বিসদৃশ নয়? স্ববিরোধিতার এক দগদগে নিদর্শন নয়? পঞ্চায়েত তো শাসনতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণের ভিত, সেই ভিতটাকে যথেষ্ট শক্তিশালী করে তুলতে পারলেই আমাদের গণতান্ত্রিক ইমারত যথেষ্ট পাকাপোক্ত হতে পারে, সে জন্য পঞ্চায়েতের হাতে মানুষের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আরও অনেক বেশি ক্ষমতা দেওয়া দরকার; অথচ পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণার সঙ্গে দিনক্ষণ মিলিয়ে ঘোষণা হচ্ছে: জনসাধারণ মুশকিল আসানের জন্য ইমারতের অন্য সমস্ত মহলকে তুচ্ছ করে একেবারে উপরতলায় ফোন করুন! অভ্যাসের ঠুলি সরিয়ে খোলা চোখে তাকালেই এই ঘোষণায় ধরা পড়ে যায় চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণের ব্যাধি, যা গণতন্ত্রের ইমারতে বাসা বাঁধে এবং ছড়িয়ে পড়ে, যে ইমারতের নীচের তলায় ধুন্ধুমার উত্তেজনায় নির্বাচিত হয় ত্রিস্তর পঞ্চায়েত, উপরে— সবার উপরে— বিরাজ করে এক এবং অদ্বিতীয় একতন্ত্র।
বর্তমান জমানার নানা ব্যাধির মতোই এটিরও বীজ বোনা হয়েছে অতীতেই। তিন দশক আগে পঞ্চায়েতি রাজের সাংবিধানিক ভিতটি তৈরি হওয়ার পরে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের যে সম্ভাবনা দেখা দেয়, পশ্চিমবঙ্গে প্রথম পর্বে তার সম্পূরণের পথে কিছুটা অগ্রগতি ঘটেছিল, গ্রামের মানুষ গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজের ব্যবস্থাপনায় এবং উন্নয়নে নিজেদের আংশিক ভূমিকা খুঁজে পেয়েছিলেন, অন্তত রাজ্যের কিছু কিছু এলাকায়। গোড়া থেকেই অবশ্য গোটা ব্যবস্থাটিতে একটা বড় দুর্বলতা ছিল— পঞ্চায়েতের হাতে রাজস্ব সংগ্রহের পর্যাপ্ত ক্ষমতা কোনও দিনই দেওয়া হয়নি, ফলে প্রকৃত স্বশাসনের অবকাশ মেলেনি। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও স্থানীয় স্বশাসনের আংশিক স্বাদ পেয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। সেই প্রক্রিয়া ক্রমশ জোরদার হবে, এমনটাই ছিল গণতন্ত্রের প্রত্যাশা। সে আশা মেটেনি। দেখতে দেখতে উল্টোরথ চালু হয়ে যায়, উপরতলার নির্দেশ মেনে চলাই উত্তরোত্তর নীচের তলার জনপ্রতিনিধিদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, গ্রামসভাগুলি যথার্থ আলোচনা ও বিতর্কের বদলে কর্তাদের কর্তৃত্ব যাচাই করে নেওয়ার প্রকরণে পরিণত হয়, ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র নামাবলি পরিহিত উপরতলার শাসনতন্ত্র যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণের পথ রোধ করে।
অতঃপর জমানা বদলাল, এবং নতুন শাসকরা এসেই বুঝিয়ে দিলেন, বিকেন্দ্রীকরণে তাঁদের কোনও আগ্রহই নেই। পঞ্চায়েতের যেটুকু স্বক্ষমতা ছিল, অতি দ্রুত তা খোয়া গেল, নীচের তলার জনপ্রতিনিধিরা প্রশাসনের আধিকারিকদের মুখাপেক্ষী হলেন, আধিকারিকরা আরও বড় আধিকারিকদের মুখাপেক্ষী, অন্তিমে সবাই নিজের নিজের আসনে সূর্য-মুখী হয়ে বসে কায়মনোবাক্যে জপ করে চললেন একটি মন্ত্র: যথা নিযুক্তোঽস্মি তথা করোমি। এই সাধনমার্গে যথার্থ পঞ্চায়েতি রাজের কোনও জায়গা থাকতে পারে না। পঞ্চায়েত এখানে শাসকের ক্ষমতা তৃণমূল অবধি চারিয়ে দেওয়ার এবং জারি রাখার একটি প্রকরণ। সেই প্রকরণ কার্যকর রাখার খরচ আছে, সেই খরচ মেটাতে খাজনা আদায়ের তাগিদ আছে, সেই খাজনা থেকে নিজ নিজ ভাগ বুঝে নেওয়ার তাড়না আছে, ভাগের অনুপাত বাড়ানোর জন্য স্থানীয় ক্ষমতা প্রসারের চেষ্টা চালাতে হয়। পঞ্চায়েত ভোটের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা ঘটছে এবং ঘটবে, তা এই গভীরতর ব্যাধির উপসর্গ। আমরা তার ভয়ানক রূপ দেখে শিহরিত হচ্ছি, শাসকরা সেই রূপ দেখে একটুও বিচলিত বোধ না করে ‘ও-সব দু’একটা জায়গার গন্ডগোল’ বলে উড়িয়ে দিলে আমাদের শিহরন প্রবলতর হচ্ছে, কিন্তু সত্য সে যে সুকঠিন।
তাই বলছিলাম, ওই ছোট্ট সমাপতনটি নিয়ে এ-বার বোধ করি একটু ভাবা দরকার। বিশেষ করে ভাবা দরকার তাঁদের, যাঁরা শাসকের রাজনীতির জবাবে একটি প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি অনুশীলনের কথা বলছেন। বোমা, গুলি, বাইক, উইকেট, খুন, জখম, হুমকি, সাদা থান চলছে চলবে। তা নিয়ে উদ্বেগ, প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ নিশ্চয়ই জরুরি। নির্বাচনের প্রচার, উদ্যোগ এবং ভোটদানের প্রক্রিয়ার নিজস্ব রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক চাহিদা আছে, সেই চাহিদা মেটানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করাও বিরোধীদের কাজ। কিন্তু তার পাশাপাশি ত্রিস্তর পঞ্চায়েতকে তার হৃতমর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া দরকার, তা না হলে সত্যিকারের প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি নির্মাণ করা সম্ভব হবে না, বড়জোর এক দলের জায়গায় আর এক দলের কর্তৃত্ব জারি হবে।
কাজটা সহজ নয়। সবচেয়ে বড় বাধা অন্তরের। সাধারণ মানুষ নিজেদের প্রয়োজন, সামর্থ্য এবং বিচারবুদ্ধি অনুসারে পারস্পরিক আলোচনার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলার পথ ঠিক করবেন, রাজনৈতিক দল এবং সরকারি প্রশাসন সেই পথটিকে যথাসম্ভব প্রশস্ত ও সুগম করে তোলার কাজে তাঁদের সহায় হবেন, প্রাসঙ্গিক পরামর্শ দেবেন, বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবেন, প্রয়োজনে তর্ক বা বিবাদের মীমাংসায় যথাসম্ভব গণতান্ত্রিক উপায়ে সাহায্য করবেন, এবং এই যাবতীয় অনুশীলনের মধ্য দিয়ে লোকসাধারণের বিচারবুদ্ধি, সামর্থ্য এবং তাঁদের প্রয়োজনের ধারণাও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে— আমাদের রাজনৈতিক নেতারা এমনটা ভাবতে একেবারেই অভ্যস্ত নন। এক কালে যাঁদের সেই অভ্যাস হয়তো কিছুটা ছিল, অন্তত সাধারণ মানুষের কথা শোনার অভ্যাস, সাড়ে তিন দশকের রাজ্যশাসনের ফেরে পড়ে তাঁরাও ক্রমে ক্রমে বিকেন্দ্রীকরণের ধর্ম পরিত্যাগ করে কেন্দ্রীয় কমিটির মুখাপেক্ষী হয়ে ওঠেন। আজও, ক্ষমতার স্বর্গ হতে বিদায়ের পরে এক যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও, সেই সদর-নির্ভরতা থেকে মুক্তির কোনও লক্ষণ নেই। পঞ্চায়েত নির্বাচন তাঁদের সামনে একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। সর্বশক্তিমান নেতা কিংবা সর্বময়ী নেত্রীর প্রতি ভক্তিযোগের ব্রতপালন ছেড়ে লোকসমাজ যাতে আত্মশক্তি খুঁজে নিতে পারে, তার জন্য মানুষকে সচেতন ও সক্রিয় করার সুযোগ, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ।
সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলে তাঁদের অবিলম্বে সমস্বরে এবং অন্তর থেকে বলতে হবে: ক্ষমতার যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণ চাই। অর্থাৎ— সরাসরি পঞ্চায়েত।